খেলার সঙ্গীরাও কেউ নেই। কেমন যেন শূন্যতা। মাঝেমধ্যে খারাপ লাগে; মনে হয় শৈশবটা যদি আবার ফিরে পেতাম।
শৈশবে বছরের সবচেয়ে আকাঙ্ক্ষিত সময় ছিল ডিসেম্বর মাস। সারা বছর ধরে অপেক্ষায় থাকতাম, কবে আসবে ডিসেম্বর। সময়টা ছুটির। বার্ষিক পরীক্ষা শেষে নানুবাড়িতে ঘুরতে যাওয়ার। এ ছাড়া বার্ষিক পরীক্ষার ফলাফলের অপেক্ষা এবং নতুন ক্লাসে ওঠার উৎসাহ-উদ্দীপনা তো ছিলই।
আব্বার চাকরি সূত্রে থাকতাম গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার বড়গাঁও গ্রামে। বড়গাঁও বাইতুল উলুম আলিম মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল ছিলেন আব্বা। আমরা ভাইবোনেরা সেখানেই পড়তাম। বছরে একবার কি সর্বোচ্চ দুইবার যাওয়া হতো গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে। এর মধ্যে ডিসেম্বর মাসে বার্ষিক পরীক্ষা শেষে একবার; অন্যবার কুরবানির ঈদের ছুটিতে। যেবার কুরবানির ঈদ নভেম্বর ও ডিসেম্বরে ছিল, সেসব বছর কেবল একবারই গ্রামের বাড়িতে যাওয়া হতো।
কুরবানির ঈদের ছুটিতে বাড়িতে গেলে এক সপ্তাহ থাকা হতো। এর মধ্যে নানুবাড়িতে পাঁচ দিন এবং দাদাবাড়িতে দুই দিন। পথে আগে নানুবাড়ি পড়ে, ভাঙাপুস্কুরনি গ্রাম। আমাদের গন্তব্য সেখানেই থাকত। যে কয় দিন আগেই যাই না কেন, সেখানে থেকে তারপর চাঁদরাতের দিন দাদুবাড়িতে যেতাম, ভাইজকরা গ্রামে। ঈদের দিন থেকে পরদিন আবার নানুবাড়িতে চলে আসতাম। দুই গ্রামের দূরত্ব পায়ে হেঁটে বিশ মিনিটের পথ। ডিসেম্বরে গেলেও অলিখিত নিয়ম ছিল। যত দিনই ছুটি থাকত—সর্বোচ্চ দুই দিন দাদাবাড়িতে এবং বাকি দিনগুলো নানুবাড়িতে।
আমরা ছয় ভাইবোন; এর মধ্যে পাঁচজনের জন্মস্থান নানুবাড়িতে, আরেকজনের জন্ম হাসপাতালে। অন্যদের বেলায় একটা প্রবাদ প্রচলিত আছে ‘মামার বাড়ি মধুর হাড়ি’; আমাদের বেলায় সেই প্রবাদের একটু পরিবর্তন হয়েছে, ‘নানুর বাড়ি মধুর হাড়ি’। তখন নানুবাড়িকেই নিজের বাড়ি ভাবতাম।
ডিসেম্বরে বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হওয়ার আগে থেকেই শুরু হতো ব্যাগ গোছানোর আয়োজন। আব্বাও আগে থেকেই গাড়ি ঠিক করে রাখতেন। অপেক্ষা সহ্য হতো না। সবার পরীক্ষা শেষ হওয়ার পরদিনই গ্রামের বাড়ির উদ্দেশে রওনা দিতাম। বাড়িতে পৌঁছাতেই আমাদের জন্য সে কী আয়োজন! নানু আগে থেকেই নবান্নের নতুন ধানের চাল থেকে ঢেঁকির মাধ্যমে পিঠা বানানোর জন্য গুঁড়ি তৈরি করে রাখতেন। প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যা দুইবেলা করে পিঠা খাওয়ার উৎসব। চিতই পিঠা, ভাপা পিঠা, তেলের পিঠা, নারকেলের পিঠা, গোডা পিঠা, পাটিসাপটা পিঠা, চড়া পিঠাসহ নানা পদের মুখরোচর সব পিঠা। নিজেদের খেজুরগাছ থেকে সংগ্রহ করা রস দিয়ে গুড় বানাতেন নানু। সেই গুড় দিয়ে পিঠা খাওয়ার উৎসব চলত।
বাড়ির পাশেই চৌমুহনী বাজার। প্রতিদিন সকালে বাজার থেকে নানা আমাদের জন্য পরোটা-ভাজি নিয়ে আসতেন। স্বাদে অমৃত মনে হতো।
এ সময় অন্য ভাইবোনেরাও বেড়াতে আসত। কয়েকজন ছিল সমবয়সী। সবাই মিলে সারা দিন খেলতাম। আমাদের খেলার সঙ্গী ছিল নানুবাড়ির মেয়েরা। তারা সবাই সম্পর্কে আমাদের খালাম্মা। কাছাকাছি বয়সের হওয়ায় আমাদেরও তাদের দলে নিয়ে নিত। গোল্লাছুট, কানামাছি, জিক খেলা, ব্যাঙের লাফসহ নাম না জানা অসংখ্য গ্রামীণ খেলা। ওই বাড়িতে তখন কাছাকাছি বয়সের খুব বেশি ছেলে ছিল না। যাঁরা ছিল, সবাই বড়।
টেলিভিশন দেখার আয়োজন চলত পালা করে। নানুদের পাশের বাড়িতেই একটি টেলিভিশন ছিল। রঙিন টিভি। বুধবার বিকেলে বিটিভিতে ছায়াছন্দ ও সিসিমপুর অনুষ্ঠান দেখাত; বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার বিকেলে বাংলা ছায়াছবি। পরবর্তীকালে এটা শুক্রবার ও শনিবার হয়। সাধারণত পুরোনো দিনের চলচ্চিত্র দেখাত। ছবি দেখার মাঝখানে বারবার বিজ্ঞাপন দিত। প্রতিটি বিজ্ঞাপনে অন্তত আধা ঘণ্টা বিরতি। তবু টিভির ঘরে বসে থাকতাম। বাড়ির মহিলারা সে সময় জরুরি কাজ থাকলে সেসব সেরে আসতেন।
শীতের সময়ে রাতের আনন্দ ছিল অন্য রকম। সন্ধ্যায় পিঠাপুলি খাওয়ার ধুম। রাত ৮-৯টা বেজে গেলে রাতের খাবার; ১০টা নাগাদ ঘুমের আয়োজন। তখন নানুদের বাড়িতে ঘর ছিল তিনটা। তিন ঘরে তিন খাট। তবে জায়গার অভাব ছিল না। সন্ধ্যার পরই ধানের খড়ের পালা থেকে খড় নিয়ে এসে মেঝেতে বিছিয়ে সেটার ওপর বিছানা করতেন নানু। সেই বিছানায় ভাইবোনেরা ঘুমাতাম। সবচেয়ে আরামদায়ক বিছানা ছিল সেটি।
নানা-নানু এখনো বেঁচে আছেন। কিন্তু তাঁদের বাড়িতে আর খুব একটা যাওয়া হয় না। গেলেও রাতে থাকা হয় না। দেখা করে কিছুক্ষণ থেকে চলে আসি। খেলার সঙ্গীরাও কেউ নেই। কেমন যেন শূন্যতা। মাঝেমধ্যে খারাপ লাগে; মনে হয় শৈশবটা যদি আবার ফিরে পেতাম।