ডায়েরি

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

পারিবারিক কোনো বিষয়ে মাথা ঘামায় না সেতু। তখন দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে। মায়ের সঙ্গে তাকে শহরে পাঠিয়ে দেন বাবা। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে, তৃতীয় বর্ষে। মাঝেমধ্যে গ্রামের বাড়িতে এলেও বেশি সময় থাকে না। ঠাকুমা মারা যাওয়ার পর কয়েক দিন বাড়িতে ছিল। ওই সময় ঘর গোছাতে গিয়ে ঠাকুমার পুরোনো ট্রাংকে একটা ডায়েরি পায় সে। দাদু মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। ডায়েরিজুড়ে বিভিন্ন ঘটনা, ভালো–মন্দ অনুভূতির কথা লেখা। কী চমৎকার হাতের লেখা দাদুর! বড় হয়ে বহুবার বাড়ির বড়দের কাছে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনতে চেয়েছে, দাদুর সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছে। সেতুর জন্মের অনেক আগে মারা যান দাদু। অল্পস্বল্প কেউ কেউ বললেও ডায়েরির কথা কেউ বলেনি।

সেতুদের আদি বাড়ি একই গ্রামের উত্তর পাড়ায়। মন্ডল মাতবর জোর করে বাড়িটা দখলে রেখেছে। ব্যাপারটা নিয়ে অনেক আক্ষেপের কথা লিখে গেছেন দাদু। বাবা–কাকারা বাড়িটা উদ্ধারের উদ্যোগ নেয়নি কেন! আর দখল–ই বা করল কীভাবে? প্রশ্ন করে ম্যানেজার সদানন্দ বাবুকে। এত দিনেও বিষয়টা নিয়ে বাড়ির কেউ যখন কিছু বলেনি, আজও বলবে না নিশ্চিত সে। সদানন্দ বাবু পুরোনো লোক, তাদের ব্যবসা দেখে।

‘তোমার বাবা চান না বাড়ির ছোটরা এ নিয়ে ভাবুক। তারপরও জোর করছ যখন বলছি, তোমার দাদু অসুস্থ হওয়ার পর বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেন। তার কিছুদিন পরই দলবল নিয়ে দাদুর কাছ থেকে বাড়িটা কিনেছে বলে দখলে নেয় মাতবর। কথা বলতে না পারলেও দাদু তখনো লিখতে পারতেন। বিক্রি করেননি লিখে জানান। তোমার বাবা–কাকারা তখন ছোট। তা ছাড়া মাতবর যেমন ভয়ংকর, তেমনই ক্ষমতাবান। তাই তোমার ঠাকুমা বাবা-কাকাদের ঝামেলায় জড়াতে দেননি।’

‘বাড়িটা উদ্ধারের কোনো উপায় কি নেই?’

‘চেষ্টা করে দেখা যেতে পারে। কিন্তু কাজ হবে কি না বলা মুশকিল।’

‘যা করতে হয় করেন। বাড়িটা উদ্ধার করতে হবে।’

‘তোমার বাবার সঙ্গে কথা বলে দেখছি কী করা যায়।’

দুই মাস আগে এ আশ্বাস দিয়েছিলেন সদানন্দ বাবু। কিন্তু কাজ এগোয়নি। বাড়িটা ফিরে পেলে দাদুর নামে একটি লাইব্রেরি করবে বলে মনস্থির করেছে সেতু। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত বাড়ি। দাদু ডায়েরিতে লিখেছেন, ‘পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ক্যাম্প করেছে মাঠে। সবার মধ্যে উৎকণ্ঠা। আমাদের বাড়ির যে দিকটায় বাঁশবাগান, পুকুর, ওইখানে একটা টংঘর ছিল। ওইখানে বসে বন্ধুরা মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম মুক্তিযুদ্ধে যাব। পরের দিন রাত পোহাতে না পোহাতে খবরটা কীভাবে যেন ছড়িয়ে যায়। তরুণদের একে একে ধরতে শুরু করে। আমাদের মধ্যে তিনজন ধরা পড়ে। স্বাধীনতার কথা বলায় বেশি যন্ত্রণা দিয়ে মারে তাদের। তারপরও তারা মাথা নত করেনি। আমরাও জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছি। কত প্রিয়জনের বলিদানের বিনিময়ে আজকের এই স্বাধীনতা…।’

দাদুর লেখা প্রতিটি কথা প্রেরণা জোগায়। তাই বাবা-কাকারা হার মেনে নিলেও শুরু থেকেই বাড়ি উদ্ধারের কতগুলো সাহসী পদক্ষেপের কথা ভাবছিল সেতু। শেষমেশ জমির কাগজপত্র ও বাড়ির কয়েকটা ছবি তুলে বিশদে লিখে পোস্ট করে ফেসবুকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ছাড়া কয়েকজন শিক্ষকও যুক্ত আছেন তার সঙ্গে। পোস্টটা মুহূর্তেই ভাইরাল হয়ে যায়। পোস্ট ডিলিট দিতে বিভিন্নভাবে হুমকি দেয় মন্ডলের ছোট ছেলে। কিন্তু সেতু দৃঢ়চেতা, সাহসী। পরপর কয়েকটি জাতীয় দৈনিকে বিষয়টা নিয়ে নিউজ হয়। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজরে আসে। তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়ায় বাড়িটা ফিরে পায় সেতু।

বন্ধু, ঢাকা মহানগর বন্ধুসভা