শহরজুড়ে অবিরাম বৃষ্টি। ধমকা হাওয়া বইছে। একটু পরপর বিকট শব্দে বজ্রপাত হচ্ছে, যেন এখনি আকাশটা ফেটে পড়বে। এমন সময় অফিস থেকে বেরিয়ে মিনহাজ একটা ছাতা নিয়ে বাসস্ট্যান্ডে এসে দাঁড়াল। দুই দিনের ছুটিতে সে গ্রামের বাড়ি যাবে।
দিনের আলো তখন ফুরিয়ে আসছে। দ্রুত ছুটে আসা একটা বাস আচমকা ব্রেক কষতেই হুড়মুড়িয়ে কয়েকজন যাত্রী নেমে পড়ল। বাসের হেলপার চিৎকার করে বলল, ‘মামা, কই যাইবেন?’
‘ফুলতলি।’
‘খাড়ায়া রইছেন ক্যা? জলদি ওঠেন।’
বিলম্ব না করে মিনহাজ দ্রুত বাসে ওঠে। ভিজে পুরো শরীর জবজবে হয়ে আছে। সিটে বসে শরীরের পানি যথাসম্ভব মুছতে চেষ্টা করল। ধীরে ধীরে শরীর কিছুটা উষ্ণ হয়ে উঠতেই চোখে তীব্র ঘুম হানা দিতে লাগল। পাশের সিটে বসে থাকা মধ্যবয়সী লোকটা বলল, ‘বাসে ঘুমাবেন না। কখন কী বিপদ হয় তা বলা যায় না।’
ফুলতলি গ্রামের পাশেই মহাসড়ক মোড় নিয়েছে। সেখানে বাস থামল রাত নয়টায়। তখনো ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে। মিনহাজ ছাতাটাকে অবলম্বন করে হাঁটতে লাগল। মাটির সরু রাস্তাটার দুই পাশেই ধানখেত। সেখানে পানি থইথই করছে। মাটির রাস্তারও বেহাল দশা। একটু অসতর্ক হলেই পা পিছলে পড়ার প্রবল শঙ্কা। আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। চোখধাঁধানো আলোয় এলোমেলো গ্রামটা জীবন্ত হয়ে ওঠে বারবার। হঠাৎ ‘হিস্ হিস্’ শব্দ ভেসে আসতেই মিনহাজ দাঁড়িয়ে পড়ল। কয়েক গজ সামনেই একটা গোখরো সাপ ফণা তুলে আছে। মুঠোফোনের ফ্ল্যাশ লাইটের আলোয় সরীসৃপের চোখ দুটি ঝিলমিল করছে। এই অনাকাঙ্ক্ষিত মুহূর্তে হৃৎস্পন্দন অস্বাভাবিক বেড়ে গেল। এক পা নড়তে পারল না। মনে হলো চারদিক থেকে অসংখ্য সাপ তাকে ঘিরে ফেলেছে! কিন্তু তাকে সামনে এগিয়ে যেতেই হবে।
এক মুহূর্ত পর দয়া করেই হোক কিংবা বিরক্ত হয়েই হোক, সাপটা ধীরে ধীরে ধানখেতে প্রবেশ করল। মিনহাজ স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বহুগুণ সতর্ক হয়ে পা ফেলতে লাগল। পুরোনো টিন দিয়ে বাঁধানো ছোট্ট বাড়িটার সামনে আসতেই সে থমকে দাঁড়ায়। বাড়িটার এক পাশ কাত হয়ে গেছে। যেকোনো সময় ভেঙে পড়তে পারে। অস্থির হয়ে দরজায় কড়া নাড়ল, ‘মা, এসেছি। দরজা খোলো।’
অন্ধকার ঘরটিতে ক্ষুদ্র আলো জ্বলে উঠতেই মিনহাজের মনে আশার সঞ্চার হলো। বৃদ্ধ জননী সহসা দরজা মেলে নিজের ছেলেকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে প্রাণ ফিরে পেলেন। চোখেমুখে যে ভীষণ ভয় জড়ো হয়েছিল, তা এক নিমেষেই দূর হলো। ভগ্নপ্রায় গৃহে মায়ের করুণ অবস্থান শহরবাসী ছেলের চোখে ভেসেছিল হয়তো।
পনেরো বছর বয়সী সুলতানা অপলক চেয়ে থাকে। নিজেদের শেষ আশ্রয়টুকু এভাবে ভেঙে পড়তে দেখে অস্বাভাবিক বিচলিত হয়ে আছে সে। মায়ের মুখে অস্ফুট স্বরে একটিমাত্র বাক্য উচ্চারণ হয়, ‘তুই এসেছিস?’
মিনহাজ মায়ের হাতটি ধরে বলে, ‘চলো, মা, আমরা নিরাপদ আশ্রয়ে যাই।’
এক হাতে আলো জ্বেলে অন্য হাতে মা আর বোনের সীমাহীন দায়িত্ব নিয়ে সে এগিয়ে চলে। আকাশে বিদ্যুৎ চমকায়। বাতাসের বেগ বাড়ে। ঝড়ের রাতে তিনটি প্রাণ ছুটতে থাকে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে।
বন্ধু, ভৈরব বন্ধুসভা