শিবরাম চক্রবর্তীর ‘দেবতার জন্ম’ গল্পটির সঙ্গে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ‘লালসালু’ উপন্যাসের কাহিনির মিল আছে। ‘দেবতার জন্ম’ গল্পে চলতি পথে রাস্তার ওপর মাথা তোলা একটা বড় গোছের নুড়িপাথর অন্যত্র সরানোর পর জনমানসে দেবতার মর্যাদা পেয়েছিল। ‘লালসালু’ উপন্যাসেও একটি পরিত্যক্ত কবরের ওপর লালসালু বিছিয়ে দিয়ে জনমানসে পীরের কবররূপে হাজির করে, মানুষের অন্ধবিশ্বাসকে পুঁজি করে এক ভণ্ড ধর্ম ব্যবসায়ী নিজের আধিপত্য বিস্তার করেছে। পরিত্যক্ত কবরকে পীর মুদাসেরের কবর বলে মানুষের মধ্যে চালিয়ে দেওয়া হয়েছে। অথচ গ্রামের অনেক বয়স্ক মানুষও বাপ–ঠাকুদ্দার কাছে কখনো এমন পীরের নাম শোনেনি। কিন্তু যেকোনো ধর্ম ব্যবসায়ীর মূল শক্তি হলো মিষ্টি কথার সম্মোহনী শক্তি। যেকোনো মিথ্যাকেও তারা সত্যরূপে প্রতিষ্ঠা করতে পারে।
আবার ‘লালসালু’ উপন্যাসের কাহিনি যে ভণ্ড হুজুর বা ইমামের জীবনযাপনের ধারাকে কেন্দ্র করে বিস্তৃত হয়েছে, সেই বিস্তারের সঙ্গে সাধক ‘রামকৃষ্ণের কথা ও গল্প’-এর একটা কাহিনির সঙ্গে বেশ মিল আছে। গল্পটা হলো এ রকম—এক সাধু বনে একা তপস্যা করেন। ভিক্ষা করে জীবন ধারণ করেন। তার পরনের কৌপীন রোজ ইঁদুর কেটে দেয়। ইঁদুরের হাত থেকে মুক্তি পেতে তিনি বিড়াল আনলেন। বিড়ালকে দুধ খাওয়াতে গাই আনলেন। গাইয়ের দেখাশোনার জন্য চাকর রাখতে হলো। চাকরের জন্য ঘর হলো। চারপাশে বাগান হলো। ক্রমে এক চাকর থেকে অনেক চাকর। থাকার জন্য পাকা বাড়ি হলো। বাড়ির চারপাশে অনেক প্রজার আস্তানা গড়ে উঠল। গহিন নির্জন বন পরিণত হলো একটা গ্রামে। সাধুর জীবনযাপনে অনেক পরিবর্তন এল। সাধু থেকে সংসারী হতে গিয়ে কেবল হারিয়ে গেল মন ও জীবনের নিভৃত সাধনা। একদিন পুরোনো গুরুদেবের দর্শন পেতেই পুনরায় ভক্তিভাব জেগে উঠল। বিষয়–বাসনা সবকিছু ত্যাগ করে তিনি পুরোনো জীবনে ফিরে গেলেন। রামকৃষ্ণের গল্পের এই সাধু হলেন প্রকৃত সাধু। ভক্তিসাধনা, বিবেক, বৈরাগ্যে যাঁর মতি ও মুক্তি।
হিন্দু–মুসলিম–নির্বিশেষে প্রতিটি ধর্মের মধ্যে এ ধরনের মানুষ আছেন, যাঁরা অলৌকিক ঈশ্বর, ধর্ম এসব মানেন না; যুক্তিবাদী, ব্যক্তিজীবনে নাস্তিক, তাঁদের মধ্যেও বিষয়-বাসনা ত্যাগী, মানবের তরে জীবসেবায় জীবন বিলিয়ে দেওয়া মহামানবেরাও ব্যতিক্রম নন। কিন্তু ‘লালসালু’ কাহিনির ইমামকে দেখলাম, ধর্মকে পুঁজি করে ভোগবাদী জীবনে আসক্ত হয়ে ওঠা একজন হতে। এই একজনও আসলে বর্তমানের হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে প্রতিটি ধর্মের অসংখ্য ভণ্ড ও প্রতারক যাজকের প্রতিনিধি। পরিত্যক্ত কবরকে পীরের মাজার বানিয়ে গ্রামের দরিদ্র, অশিক্ষিত, অন্ধবিশ্বাসী মানুষের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে ছন্নছাড়া জীবন থেকে নিজের আস্তানা ও বাড়িঘর গড়ে তোলে। জমিজমা বাড়িয়ে চাষাবাদ করে। একটা বিবি থেকে দুটো বিবি হয়। ত্যাগী মহাপুরুষ হওয়ার মহত্তর কোনো লক্ষণই তার চরিত্রে ফুটে ওঠে না। বর্তমান সমাজব্যবস্থায় এ ধরনের প্রতারকদের যখন রমরমা, তখন বিশিষ্ট লেখকের কালজয়ী রচনাকে চলচ্চিত্রায়িত করেছেন বিশিষ্ট পরিচালক তানভীর মোকাম্মেল।
কলকাতার ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি পত্রে প্রসঙ্গক্রমে লাল রঙের মহিমা বিস্তারে একবার আমি কিছু উপমা টেনে এনেছিলাম। এই যেমন লাল টকটকে সূর্য, লাল টুকটুকে বউ, লাল মাটির শান্তিনিকেতন, মায়ের পায়ের রাঙা জবা ইত্যাদি। রবীন্দ্রনাথের ‘রক্তকরবী’ চিরন্তন বিদ্রোহ-বিপ্লবের জাগরণের প্রতীক, আমরা সবাই জানি। লাল পতাকার কমিউনিস্ট পার্টিও সর্বজনমান্য সর্বহারা মানুষের পাশে থাকা আন্তর্জাতিক দল। আমাদের মা, ঠাকুমারাও ধর্মগ্রন্থ, পুঁথি, পাঁচালি চিরকাল লাল কাপড়ে বেঁধে রেখে এসেছেন। মসজিদে, মাজারে লালসালু দিয়ে পবিত্র স্থান ঢাকা হয়েছে। লাল সিঁদুর আর আলতার মতো পবিত্র হয়ে উঠেছে সেই লালসালু। এই পবিত্রতা যতক্ষণ অন্তরাত্মার শুদ্ধিকরণে ভক্তি ভাবধারার বিষয় হয়ে থেকেছে, আমাদের কারও কিছু বলার নেই। প্রত্যেকেরই অধিকার আছে আপন বিশ্বাসে নিজস্ব পথের ভাবধারায় বেঁচে থাকার। কিন্তু এই বিশ্বাস যখন অন্ধ হয়, অনুশাসন যখন শৃঙ্খল হয়, তখন এই মঙ্গলচিহ্নবাহী লাল কেতনও ফাঁসে পরিণত হয়। লাল ফিতার ফাঁসের দীর্ঘসূত্রতার মতোই লাল কাপড়ের ফাঁস মানুষের শ্বাস রুদ্ধ করে, যাবতীয় স্বাধীনতা হরণ করে তিলে তিলে একটা গোটা অন্ধ জাতিকে চরম ধ্বংসের পথে ঠেলে দেয়।
তানভীর মোকাম্মেল যেভাবে দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরে অনবদ্য চিত্রনাট্য সাজিয়ে কট্টর অনুশাসনের টুকরো বিষয়গুলো তুলে আনেন, তা আমাদের বোধশক্তিতে গিয়ে নাড়া দেয়। নিজের বউ আপন উঠানে দপদপিয়ে হাঁটলেও সেই ইমাম মজিদের তা পছন্দ নয়। ঘরের বাইরে স্ত্রীর শরীরের কোনো অংশ আঢাকা থাকুক, সে তা চায় না। এদিকে, স্ত্রী দাসীর মতো সারা দিন খাটে, রাতে দৈহিক মিলনের আগে স্ত্রীকে দিয়ে আবার নিজের পা টেপায়। পুরুষতান্ত্রিকতা ও প্রভুত্ববাদ একে অন্যের পরিপূরক। দ্বিতীয় স্ত্রী শব্দ করে হাসলে, তাকে শাসিয়ে যায় মজিদ। মুসলমান বাড়ির বউদের প্রাণ খুলে শব্দ করে হাসতে নেই। স্বামীর কট্টর জোরাজুরিতে নামাজ পড়তে গিয়ে সে ঘুমিয়ে পড়লে, নেমে আসে কঠোরতর শাস্তি। স্বামীর প্রতি তীব্র ধিক্কারে গায়ে থুতু দিলে, শরীরের মধ্যে জিন ভর করেছে তকমা পায়। তারপর জিন ছাড়াতে তাকে, নিজের সাজানো লোক ঠকানোর সেই মাজারে নিয়ে গিয়ে কবরের পাশে বেঁধে রাখা হয়।
কেবল বাড়িটাকে সে কারাগার বানিয়ে রাখেননি। নিজের আধিপত্য বিস্তার করা মহব্বতনগর গ্রামেও কেউ গানবাজনা করছে শুনলে সে গিয়ে শাসন করে। মুসলমানদের জীবনে গানবাজনা চলে না। কোনো যুবক খৎনা করায়নি জানতে পারলে, সে রেগে যায়। প্রত্যেকের সাচ্চা মুসলমানের মতো দাড়ি থাকা চাই। পানিপড়া, তাবিজ–কবচ, তুকতাক ইত্যাদি বুজরুকি কারবার তো আছেই। গ্রামের মানুষ সরল বিশ্বাসে শুধু টাকাপয়সা নয়, নিজের খেতের ফসল, পালন করা পশুও মাজারে এসে দিয়ে যায়। গ্রামের ইংরেজি শেখা একমাত্র উচ্চশিক্ষিত যুবক একটা স্কুল তৈরি করতে চাইলে মজিদ বাধা দেয়। পাশের গ্রামে মাদ্রাসা আছে। মুসলমান ঘরের সন্তানদের স্কুলের প্রয়োজন নেই। স্কুলের বিষয়টি চাপা দিতে সে গ্রামের মানুষের কাছে যার যা আছে, সবার সাহায্য নিয়ে একটা বড় মসজিদ নির্মাণ করার কথা বলে। মানুষ বেশি শিক্ষিত হয়ে উঠলে এসব বুজরুকি ধান্দাবাজি যে আর চলবে না, সেটা ভালোই বোঝে মজিদ। শুধু তা–ই নয়, গ্রামে অন্য ভণ্ড পীর এসে জায়গা করে নিতে চাইলে, নিজের ব্যবসার ক্ষতি হবে বুঝতে পেরে নিজে আসল পীর আর ওই পীর ভণ্ড, এটা প্রমাণ করতে নেমে পড়ে। শেষ পর্যন্ত প্রাকৃতিক দুর্যোগ এসে এই ভণ্ড ধর্ম ব্যবসায়ীর সবকিছু ভেঙে তছনছ করে ভাসিয়ে দিয়ে যায় একদিন। তানভীরের চিত্রায়িত এই অন্তিম দৃশ্য অবিস্মরণীয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কাছে মানুষমাত্রই অসহায়।
এসব ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে তানভীরের মননশীল চলচ্চিত্রের মূল বৈশিষ্ট্য অনবদ্য চিত্রায়ণ বা দৃশ্যায়ন হৃদয় ছুঁয়ে যায়। শিল্প নির্দেশক উত্তম গুহের অতি উত্তম সেট নির্মাণ, আনোয়ার হোসেনের অনবদ্য চিত্রগ্রহণ এবং সৈয়দ সাবাব আলী আরজুর হৃদয় মথিত করা আবহ সংগীত—সব মিলেমিশে অন্তরাত্মাকে ছুঁয়ে ফেলে। শুরুতে যেমন আমরা দেখি, নৌকায় চড়ে গ্রামের লোকেরা নিজস্ব কৌশলে মাছ ধরছে। একজন একটা মাছ ধরে ফেলে, তখনই মেঠো পথ দিয়ে অতি অল্প সম্বলসংবলিত ছন্নছাড়া মজিদ গ্রামে ঢুকছে। এই দৃশ্যকে সংযোগরূপকও বলা যেতে পারে। আবার গ্রামের লোক যখন পরিত্যক্ত কবরের জঙ্গল পরিষ্কার করতে শুরু করে, একটা সাপ সেখানে ঢুকে পড়ে। দক্ষ পরিচালকই এমন দৃশ্য কল্পনা করতে পারেন। পল্লিবাংলার প্রকৃত রূপকে ছবির পরতে পরতে ফুটিয়ে তুলতে পরিচালক তানভীরের কাব্যপ্রতিভা নিজেকে উজাড় করে দেয়। ঠিক যেভাবে পল্লিবাংলার গার্হস্থ্য জীবনের সেট নির্মাণে উত্তম গুহের শৈল্পিক দক্ষতা অনন্য।
মজিদ চরিত্রের প্রতিটি দিক রাইসুল ইসলাম আসাদ অসাধারণভাবে ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন। গ্রামে প্রবেশ করা দ্বিতীয় ভণ্ড পীরের চরিত্রে সংক্ষিপ্ত পরিসরে আলী যাকের মাতিয়ে দিয়েছেন। ভক্তদের অতি আবেগজনিত ভক্তির ঠেলায় তাঁর গাছে চড়ে বসার দৃশ্যটি চমৎকার। বেশ হাস্যরসের উদ্রেক করে। অন্য কলাকুশলী ও শিল্পীরা হলেন মুনিরা ইউসুফ মেমী, চাঁদনি, আমিরুল হক চৌধুরী, রওশন জামিল, তামান্না ইয়াসমিন তিথি, চিত্রলেখা গুহ, তৌকীর আহমেদ, উত্তম গুহ, ইকবাল আহমেদ, সগীর মোস্তফা, সৈয়দ সাবাব আলী আরজু, আহসানুল হক মিনু, মাসুদ আলী খান, এমদাদুর রহমান, সাইদুর রহমান বয়াতী, মৌসুমী, জাইবুল আনাম আবদুল্লাহ, তানভীর হাসান, মনোয়ার তমীজউদ্দিন, বাদশা মিয়া এবং আরও অনেকে।
‘লালসালু’ শিক্ষার্থীদের সিলেবাসে থাকা উপন্যাস। আজকের এই ইঁদুরদৌড়ের পরীক্ষায় পাস-ফেল প্রথা, বেশি নম্বর-কম নম্বর পাওয়ার উপায় ও কারণ নির্ধারণ এবং তোতাপাখির মতো মুখস্থবিদ্যার দৌলতে অনেক সময় কালজয়ী সাহিত্যের বিষয়বস্তু ও চরিত্রগুলোও বড্ড শক্ত হয়ে দাঁড়ায়। তাদের আবেগে, অনুভবে, উপলব্ধিতে আনা যায় না। সে ক্ষেত্রেও তানভীর মোকাম্মেলের মতো শিক্ষক পরিচালকের চলচ্চিত্র দেখলে কঠিন পথ সহজ হয়ে আসবে। চরিত্রগুলো চোখের সামনে নড়েচড়ে বেড়াবে এবং জীবনে চলার পথে অর্জিত শিক্ষা দ্বারা সমাজে পরিবর্তনও আনা সম্ভব।
হাওড়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত