‘মেজ্জান দিয়ে মেজ্জান দিয়ে উইতারত উইতারত গরিব উল্ল্যাই মেইটট্যা বসি ডরমাইনশর লাই বাসনত কি সুন্দরয্যা বিছানত’ গানের কথা নিত্য শোনা যায়। মেজবান কীভাবে এল চট্টগ্রামে, সেটা একটু জানি। মেজবান শব্দটি ফারসি। এর অর্থ আপ্যায়ক, অতিথি সৎকারক, আতিথেয়তা, মেহমানদারি বা বিশেষ ভোজের ব্যবস্থা করাকে মেজবান বা মেজবানি বলা হয়। চাটগাঁইয়াদের বহুল জনপ্রিয় ও পরিচিত বিশেষ ভোজনের নাম মেজবান। প্রতিবেশী সমাজের লোকজন ও অতিথি আপ্যায়নকেও মেজবান বলে। মেজবান শব্দটি চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় মেজ্জান হিসেবে প্রচলিত। চট্টগ্রামে সাধারণত কোনো উপলক্ষকে কেন্দ্র করে আয়োজিত বিশেষ গণভোজ; কেউ মৃত্যুবরণ করলে কিংবা কারও মৃত্যুবার্ষিকী বা জেয়াফত। মেজবানের মেনু গরু বা মহিষের ঝাল মাংস, ছোলা বা বুটের ডাল, নলা বা নেহারির ঝোল ইত্যাদি। মেজবান চট্টগ্রামের ভোজ হলেও অন্যান্য জেলার লোকজন এটি খাওয়ার জন্য ব্যাকুল থাকেন।
মেজবানের ইতিহাস জানতে গিয়ে সমাজবিজ্ঞানী একুশে পদকপ্রাপ্ত শিক্ষাবিদ ড. অনুপম সেনের সঙ্গে কথা বলেছিলাম। তিনি জানান, ১৪ শ শতকের পূর্বে চট্টগ্রাম অঞ্চল ছিল হিন্দু ও বৌদ্ধ–অধ্যুষিত আরাকান রাজ্যে। বাংলাদেশের প্রবেশদ্বার চট্টগ্রাম বন্দরকে কেন্দ্র করে ব্যবসা-বাণিজ্যের শুরু হয় সেই সময় থেকে। বাংলার সুলতানি আমল থেকেই পর্তুগিজ ছাড়াও আরব কিংবা বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বহু মুসলিম মনীষী এ অঞ্চলে আসতে থাকেন। প্রাচ্যের সৌন্দর্যের রানি চট্টগ্রামে পীর, আউলিয়া, দরবেশ বিশেষ করে হজরত বায়েজিদ বোস্তামী (রহ.), বদর শাহ (রহ.) এঁদের পাশাপাশি বার আউলিয়া চট্টগ্রামে এসে ইসলাম প্রচার শুরু করেন। ধর্মপ্রচারকরা পরিবর্তিত নব্য মুসলমানদের নতুন খাদ্যাভ্যাসের সঙ্গে পরিচিত করাতে মেজবান বা গরুর মাংসের মাধ্যমে ভোজের ব্যবস্থা করাতেন। ধর্ম প্রচারের পাশাপাশি নব্য মুসলমানদের সঙ্গে পরিচিতি ও সামাজিক সংহতি প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে মেজবানের আয়োজন করা হতো।
পনেরো শ ও ষোলো শ (১৫০০-১৬০০) শতাব্দীর প্রাচীন পুথিসাহিত্যে ‘মেজোয়ানি’ ও ‘মেজমান’ দুটি শব্দ পাওয়া যায়। মেজোয়ানি অর্থ আপ্যায়নকারী ও মেজমান অর্থ আপ্যায়ন। ১৫০০ শতকের কবি বিজয় গুপ্তের পদ্মপুরাণ কাব্যগ্রন্থে একটি পঙ্ক্তি আছে, ‘কাজীর মেজমান হইলে আগে করে আনে।’ আরেক কবি শাহ বারিদ খানের রচনায় ‘মেজোয়ানি’ শব্দটা পাওয়া যায়। আবার ১৬০০ শতাব্দীর সৈয়দ সুলতানের নবীবংশ কাব্যগ্রন্থে একটি লাইন রয়েছে, ‘ভালারূপ করিলা বিভার মেজোয়ানি।’ যা বোঝানো হয়েছে ভোজ অর্থে।
‘আবোলাইয়্যা’ বা ‘আবোলাইন্যা’ চট্টগ্রামের আঞ্চলিক শব্দ, যার আভিধানিক অর্থ অনিমন্ত্রিত বা অযাচিত মেহমান হওয়া। বিনা দাওয়াতে নিমন্ত্রণ বা মেজবান খাওয়াকে আবোলাইয়্যা বা আবোলাইন্যা মেজবান বা দাওয়াত বলে। চাটগাঁয় প্রচলিত আছে, বিনা দাওয়াতে বা নিমন্ত্রণ না পেয়েও যে নিমন্ত্রণ খেতে চলে যায় তাকেও আবোলাইয়্যা বলে থাকে।
বন্ধু সায়েম, সবাই ডাকে ডুবার। আসলে তিনি দেখতে আলিফ লায়লা সিরিয়ালের দৈত্যের মতো। মেজবান বিয়ের দাওয়াত যেখানে, সায়েমকে পাওয়া যাবে সেখানে। অনেকে সায়েমকে চেনে মেজবান সায়েম হিসেবে। সায়েমের বয়স পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই। ওজন ৯০ কেজি। দেখতে যেমন লম্বা তেমন মোটা। তাঁকে নিয়ে একবার কচুয়ায় আজিমপুর গ্রামের শ্বশুরবাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলাম। শ্যালিকা মিতু তাঁকে সম্বোধন করে বসল আংকেল বলে। আমি বললাম, সে তো আমার বন্ধু। শালিকা মিতু হেসে দৌড়। সায়েমের সঙ্গে আবোলাইয়্যা মেজবান খেতে আমিও ছুটে যেতাম। স্মৃতির ঝাঁপি থেকে ছেলেবেলার আবোলাইয়্যা মেজবান খাওয়ার কথা খুব মনে পড়ে। আবোলাইয়্যা মেজবানের গন্ধ পাওয়া মাত্রই বন্ধুবান্ধব সবাই দল বেঁধে মেজবান খেতে চলে যেতাম।
চট্টগ্রাম সরকারি কমার্স কলেজের খুব কাছের বন্ধু ছিল বরিশালের মেয়ে শেলী। কলেজে ক্লাসের প্রতি ঘণ্টায় তাকে দেখতাম পার্স থেকে বের করে কিছু না কিছু মুখের ভেতর দিয়ে জাবর কাটত। এ জন্য স্যারেরা তাকে খুব বকাঝকা করত। তাকে বলতাম সমারসেট মমের ‘দ্য লাঞ্চন গল্পের লেডি গেস্ট’, যে কিনা লেখককে একটির বেশি খায় না বলে ফতুর করে দিয়েছিল। চট্টগ্রামে অন্যান্য জেলার লোকদের চাটগাঁইয়ারা (বইঙ্গ্যা) বলে ডাকে।
আমিও বান্ধবী শেলীকে বইঙ্গ্যা ফ্যাঁসকান্ডি বলে ডাকতাম। সে খুব খেপে যেত। আমাকে ডাকে চইঙ্গ্যা রইস্যা এনু বলে। বিশ বছর পর রাজধানীতে তাঁর সঙ্গে দেখা। তাঁকে একবার মেজবানে দাওয়াত দিয়েছিলাম। সে আবার তাঁর কাজিন হানি ও এ্যানি নামে দুই ভদ্রমহিলাকে মেজবান খেতে নিয়ে এসেছিল। তাঁদের নাকি চট্টগ্রামের মেজবান খাওয়ার অনেক দিনের ইচ্ছা। ওরা দুজনে মেজবানি খেয়ে এত স্বাদ পেয়েছিল যে দুই বান্ধবী মিলে খাওয়ার পর হাঁপাচ্ছিল, নড়াচড়াও করতে পারছিল না!
কাজিন হানি শেলীকে বলছিল, ‘মুই জীবনে এত স্বাদের মেজবান খাইনি, বুঝছেন। যে খাওন খাইছি, মোর দু–এক বেলা না খেলেও চলবে।’ ভদ্রমহিলা হানি যাওয়ার সময় প্লাস্টিকের বক্সে মেজবানির মাংস নিয়ে ভ্যানিটি ব্যাগে ভর্তি করছিল। আমি দেখে ফেলাতে কিছুটা লজ্জা পেয়ে হেসে বললেন, ‘না ভাইজান, মাংস খুব স্বাদ হয়েছে কি না, তাই একটু মেজবানি নিয়ে যাচ্ছি। ফ্রিজে রেখে মুই খামু বুঝছেন।’
সত্যি, মেজবানি খানা চট্টগ্রাম ছাড়িয়ে শুধু দেশে নয়, বিদেশেও আয়োজন হচ্ছে আজকাল। কতজন যে আবোলাইয়্যা মেজবান খাচ্ছে তার হিসাব নেই। অনেকে বলে, ‘চাটগাঁইয়া মেজ্জাইন্যা খানা, খাইলি বুঝিবা, ন খাইলি পস্তাইবা।’
বছর ঘুরে আবার এসেছে চট্টগ্রাম সমিতির মেজবান। ছেলেবেলার আবোলাইয়্যা মেজ্জান খাওয়ার স্মৃতিগুলো মনে পড়লে মনে মনে হাসি।
মেজবান নিয়ে ছড়াকার সুকুমার বড়ুয়ার চমৎকার একটি আঞ্চলিক ছড়াও আছে। ‘ওরে দেশর ভাই/খুশির সীমা নাই/জলদি আইয়ু সাজিগুজি/মেজ্জান খাইবাল্লাই/ বদ্দা আইব বদ্দি আইব/মামু জেডা-জেডি/ঢাকার ভেতর চাটগাঁইয়া/যত বেডাবেডি, বেয়াগ্গুনে খুশি হইবা/ইষ্টিকুডুম পাই। জলদি আইয়ু, সাজিগুজি/মেজ্জান খাইবাল্লাই।’
‘চাটগাঁইয়া মেজ্জান’ গ্রন্থের লেখক