নিত্যদিনের ব্যস্ততার ধকল নিতে নিতে শরীর-মন দুইই হাঁপিয়ে উঠছে। দাওয়াই একটাই, কোথাও ঘুরে আসি। বললেই কি আর হয়? লম্বা ছুটি মেলা ভার। কী আর করা। হাতে ছুটি একদিন। বেরিয়ে পড়লাম আমরা ছয়জন। ছয়জন ছয় জায়গার মানুষ। কর্মই আমাদের এক করে দিয়েছে। বিভিন্ন বয়সী; সহকর্মী হলেও আমরা বন্ধুবৎসল। যে যাঁর মতো সদরঘাট চলে এসেছি সকাল সাড়ে সাতটায়। হালকা নাস্তা সেরে লঞ্চ ধরি আটটায়।
আমাদের গন্তব্য চাঁদপুর। চাঁদপুর মানে ইলিশের বাড়ি। যথারীতি হুইসেল দিয়ে যাত্রা শুরু করল লঞ্চ। ডেকের টিকেট নিয়েছি। উদ্দেশ্য একটাই, পুরো ভ্রমণটা উপভোগ করতে চাই। লঞ্চের ছাদের সামনের দিকটাতে চারটা ফিক্সড চেয়ার। পালা করে বসে যাচ্ছি। পেছনে ফেলে যাচ্ছি কংক্রিটের শহর। আজ আমাদের অফিসের তাড়া নেই, লোকাল বাসের ঝক্কি নেই, জ্যামে সেদ্ধ হওয়ার সুযোগ নেই।
জলরাশি ভেদ করে লঞ্চ চলছে। আমরা দেখছি নদী। নদীর অনেক রূপ। এই কালো, এই সবুজ, এই নীল। আমাদের ভ্রমচ্ছেদ ঘটে। আবিষ্কার করি নদীর এত রং আসলে রোদ আর মেঘের খেলা। বাতাসে গা এলিয়ে দিয়ে তাই আকাশ দেখি, মেঘেদের উড়াউড়ি দেখি। দেখি দূরের গ্রাম আর জেলেদের জীবন।
চাঁদপুর পৌঁছানোর আগে মোহনপুর পর্যটনকেন্দ্র দেখা যায় লঞ্চ থেকে। পরিকল্পনা ছিল চাঁদপুর নেমে মোহনপুরের উদ্দেশে যাত্রা করব। দিনভর ওখানে কাটিয়ে সন্ধ্যায় ঢাকার লঞ্চ ধরব। কে জানত আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে ভিন্ন কিছু। পৌনে ১২টা নাগাদ চাঁদপুর ঘাটে নামি। ইলিশের মৌসুম না হলেও ছোট ছোট নৌকায় ইলিশ বিক্রি করছেন অনেকেই।
আবহাওয়াটা চমৎকার। গরম তবু ক্লান্ত হচ্ছি না, আকাশে মেঘের উড়াউড়ি। প্রথমেই অটো নিয়ে চলে গেলাম বড় স্টেশনে। পদ্মা-মেঘনা-ডাকাতিয়া নদীর সংগমস্থলে বড় স্টেশন মোলহেড। এটি এখন বঙ্গবন্ধু পার্ক। বঙ্গবন্ধু পার্কে ঢুকতেই চোখে পড়বে ইলিশের প্রতিকৃতি আর ডানে শিশুদের বিনোদনের ব্যবস্থা। একটু এগিয়ে গেলে চোখে পড়বে মুক্তিযুদ্ধের দৃষ্টিনন্দন স্মৃতিস্তম্ভ ‘রক্তধারা’। ‘রক্তধারা’ মূলত বড় স্টেশন মোলহেড বধ্যভূমির প্রতীকী ভাস্কর্য। মুক্তিযুদ্ধের সময় এখানে কয়েক হাজার মানুষকে নির্যাতন ও হত্যা করে লাশ নদীতে ফেলে দেওয়া হয়েছিল।
পার্কের ভেতরের দিকটা সবুজে ঘেরা। বড় বড় গাছের ফাঁক গলে পড়ছে রোদের কণা। নদীতীর ঘেঁষে বসার জন্য বেঞ্চ আছে, চাইলে আপনি তীরের ঢালে বসেও কাটিয়ে দিতে পারেন সারা দিন। ক্লান্তি আপনাকে ছুঁবে বলে মনে হয় না। ছুঁলেই কী! হিমশীতল লেবুজল তো আছে। পার্কজুড়ে খাবার, খেলনা আর গয়নার দোকান। আমরা এখানে অনেকটা সময় ছিলাম। নদীর ঢেউ দেখেছি, নৌযান দেখেছি, বিচিত্র সব মানুষ দেখেছি। তুলেছি ছবি আর ভিডিও করেছি।
যেহেতু শহরে যাইনি, তাই দুপুরের খাবার খেতে আবার লঞ্চঘাটে যাই। আসল উদ্দেশ্য ইলিশ খাওয়া। ইলিশ ভাজা, ইলিশের লেজভর্তা, বেগুন ভাজা আর বরবটির ভর্তা ছিল ভাতের সঙ্গে। খাওয়া পর্ব সেরে আবার পার্কে। সেখান থেকে ট্রলার ভাড়া করি ৭০০ টাকায়, যাব ‘মোহনার চর’। যাওয়া-আসা আর একঘণ্টা চরে ঘুরব।
ট্রলার যাত্রা শুরু হলো। প্রথমে বুঝিনি কী অপেক্ষা করছে। একটু পরই দুলতে শুরু করল ট্রলার। পদ্মা-মেঘনা আর ডাকাতিয়ার মোহনায় যেন পানিযুদ্ধ। খুব উঁচু ঢেউ নেই কিন্তু নদী যেন উত্তাল; একবার ডানে ঢেউ তো পলকে বাঁয়ে, সামনে-পেছনে যেন দশদিক থেকে ধেয়ে আসছে ঢেউ। ঢেউয়ের মিছিল যেন থামছেই না। ক্ষণে মনে হয় ট্রলার উল্টে পড়ল, আবার মনে হয় ওপরে তুলে আছাড় মারবে! ভয় আর উৎকণ্ঠা নিয়ে অনেকটা পথ পাড়ি দেওয়ার পর শান্ত নদীর দেখা মিলল। ওপার থেকে ডাকছে কয়েক বছর আগে জেগে ওঠা চর। চরে এসে ট্রলার ভিড়ল।
কাপড় বদল করে নদীতে নেমে পড়ি গোসল করতে। আমাদের আগে-পরে আরও কয়েকটা দল এসেছে। ছোট ছোট ঢেউ আসে, সুন্দর। কেউ বলে চাঁদপুরের সৈকত, কেউ বলে মোহনার চর। মাঝি ভাই বলল, এর নাম নাকি রাজ-রানীর চর। ভাটার সময় চরটি দেখতে ভালো লাগে। দেখতে দেখতে জোয়ার চলে এল। আমরা ট্রলারে চেপে বসছি ফেরার জন্য। দ্রুত পথ ফুরিয়ে গেল। চর দেখার চেয়ে ঢের ভালো লেগেছে এই ট্রলার ভ্রমণ। যেন ভয়ংকর কোনো রাইড।
সাড়ে পাঁচটার লঞ্চে আমরা ঢাকার উদ্দেশে রওনা দিই। এবারও ডেকের টিকিট। যথারীতি লঞ্চের সামনের দিকে বসি। বিকেলের বিচিত্র রঙের আকাশ দেখতে দেখতে পথ এগোচ্ছে। দ্রুত ডুবে যাচ্ছে সূর্য। যেন খুব তাড়া। দূরের পশ্চিমের কোনো এক গ্রামে মনে হয় সূর্যের বাড়ি। বাড়িতে অপেক্ষায় বৃদ্ধ বাবা-মা আর মধ্যবয়সী প্রেয়সী। এমন অপরূপ সূর্যাস্ত শেষ কবে দেখেছি আমরা?
ঢাকায় নেমে রাতের খাবার সেরে যে যার বাসায় রওনা হলাম। সাত থেকে আট ঘণ্টার যাত্রা, উত্তাল নদীতে রোমাঞ্চকর ট্রলার ভ্রমণ, ডুবসাঁতার আর হাঁটার কথা নাই বা বলি। দীর্ঘ ভ্রমণ শেষে ফিরেও আমাদের কোনো ক্লান্তি নেই। লঞ্চ জার্নি বোধ হয় এমনই।