একটা সতেজ সকাল। ঘুম ভাঙতেই নিবেদিতা দেখল, প্রশান্তর খুদে বার্তা, ‘আপনার ঘুম কেমন হয়েছে? আমাকে আপনার মনে পড়ে?’ নিবেদিতার ঠোঁটের কোণে শীতল হাসি। মনে মনে হাসল সে। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস নিল। টেবিল থেকে জলের বোতল হাতে নিল। দুই চুমুক পান করে রেখে দিল বোতলটা। নিবেদিতারও ইচ্ছা করল লিখতে, ‘হ্যাঁ, প্রশান্ত। আমার ঘুম খুব ভালো হয়েছে। নিশ্চয়ই আপনাকে আমার মনে পড়ে।’
কিন্তু সে চেপে গেল। দুই লাইন লিখেও ব্যাকস্পেস চেপে সরে এল। তবে তার খুব ভালো লাগল। এমন একটা আলো ফোটা হলদে সকাল, চারদিকে রোদ, তার ওপর প্রশান্তর এমন টেক্সট!
নিবেদতা পরক্ষণেই ভাবল, হ্যাংলামো হচ্ছে কি না! সে কঠোর হলো। প্রশান্তকে জানিয়ে দেবে, এমন আহ্লাদে বার্তা যেন আর না পাঠায়। ফোন হাতে নিয়ে লিখলও, ‘শুনুন, প্রশান্ত, আমি চাই না আপনার সঙ্গে আমার কোনো ইনফরমাল সম্পর্ক হোক। ফরমাল কোনো প্রয়োজন থাকলে নক করবেন।’
এই সাহসও হলো না নিবেদিতার। নিজের ভেতর অস্থিরতা তৈরি হলো। পায়চারি করতে লাগল বারান্দাময়। মুহূর্তের সুপ্রসন্ন সকাল তার কাছে মলিন হয়ে গেল। সব বিমর্ষ লাগতে শুরু করল। মাথার ভেতর পোকা হয়ে ঘুরতে লাগল একটি নাম; প্রশান্ত!
কাউকে নিয়ে ভাবার, কোনো কিছু কল্পনা করার সময় নিবেদিতা অনেক আগেই পার করে এসেছে। এই মুহূর্তে তার মাথায় কোনো তরুণ কেন পোকা হয়ে ঘুরবে? নিজের প্রতি নিজেরই খারাপ লাগা শুরু হলো। প্রশান্তর প্রতি বিরক্তি চলে এল। স্বগতোক্তি করে বলল নিবেদিতা, ‘উফ, প্রশান্ত, আপনি আমাকে এভাবে পোড়াচ্ছেন কেন? এ কোন প্রবঞ্চনা!’
প্রশান্ত কি রহস্যময় পুরুষ? সে কি নিবেদিতার আবেগ নিয়ে খেলছে? সে কি তাকে ফাঁদে আটকে ফেলতে চাইছে? এ রকম অজস্র প্রশ্ন তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। তার তো কোনোমতেই প্রশান্তকে প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না! নিবেদিতা সিদ্ধান্ত নেয়।
শক্ত হয়ে রান্নাঘরে যায়। চুলা ধরায়। পানি গরম করে। চায়ের পাতি ঢালে। চা খায়। চেষ্টা করে মাথা থেকে প্রশান্তর ভূত নামাতে। মনে পড়ে, কিছু ফাইল সে বাসায় এনে রেখেছিল। হোমওয়ার্ক করতে বসে যায়। নিবিষ্ট মনে অনেকক্ষণ কাজ করার পর মনে পড়ে, এসব ফাইলের বেশির ভাগেই প্রি-ওয়ার্ক করে রেখেছে প্রশান্ত। অনেকগুলো পাতার নিচে স্বাক্ষরও আছে তার!
কম্পিউটারের যুগে কেউ হাতে লেখে না। তবু কিছু মন্তব্য, কাটাকুটিতে লেগে আছে প্রশান্তর হাতের লেখা। বড় মনোহর তার হাতের লেখা। তার চেয়ে মিষ্টি তার ব্যবহার। বিনয়ের সঙ্গে ঝাঁজও আছে। খারাপ লাগে না নিবেদিতার। বরং প্রশান্তর ভেতর একটা দীঘল দিঘি আছে। নিস্তরঙ্গ দিঘির জলে থই থই করা স্নিগ্ধতার একটা রেশ আছে তার চোখে। প্রশান্তকে এড়ানো যায়, অস্বীকার করা যায় না। ফিরিয়ে দেওয়া যায়, তাচ্ছিল্য করা যায় না। এত সব ভাবতে ভাবতে আয়নার সামনে দাঁড়ায় নিবেদিতা। নিজের চেহারার দিকে বহুদিন পর যত্নমাখা চাহনি নিয়ে দাঁড়ায়। অনেক দিন পর সে আবার পারলারে যাবে বলে ঠিক করে। ফেসওয়াশ দিয়ে যত্ন করে মুখ ঘষে। ওয়াশরুমে অনেকক্ষণ থাকার পর তার মনের ভেতর একটা প্রশ্ন তৈরি হয়, আমি কি তাহলে প্রশান্তর জন্যই নিজেকে পরিপাটি করছি?
নিবেদিতার ফরসা গালে লাল আভা খেলে যায়। সে বুঝতে পারে, কোথাও না কোথাও প্রশান্ত তাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। বাইরে বাইরে সে সবকিছু অস্বীকার করলেও ভেতরে ভেতরে তৈরি হচ্ছে ভয়। সে তার সবকিছু অস্বীকার করতে চায়।
হোয়াটসঅ্যাপের বিপটোনে ঘোর কেটে যায়। ‘শনিবারের এই সকালবেলায় আপনার সঙ্গে কি এককাপ চা খেতে পারি? আপনি চাইলে কফি...?’ প্রশান্তর খুদে চিঠি নিবেদিতাকে এলোমেলো করে দেয়।
নিবেদিতা বুঝতে পারছে না কী লিখবে, ইয়েস নাকি নো!
নগুয়া, কিশোরগঞ্জ