গল্পটা গত রমজান মাসের, তখন এসএসসি পরীক্ষা সমাপ্তির এক মাস অতিক্রান্ত হচ্ছিল। পরীক্ষার পর রোজা, আর প্রথম কিছু রোজা চলে যায় প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষা দিতে দিতেই। কোথাও আর ঘুরতে যাওয়া হয়নি। কিন্তু আমরা বন্ধুরা ছিলাম খুবই ভ্রমণপিপাসু। ঠিক করলাম, দরকার হলে রোজা রেখেই ঘুরতে যাব। প্রয়োজনে কাছাকাছি কোথাও যাব, তবু যাবই।
ইচ্ছা, আগ্রহ, সুযোগ সবকিছুই ছিল আমাদের কাছে; শুধু কোথায় যাব, তা ঠিক ছিল না। ভ্রমণের জায়গা নির্ধারণের জন্য একদিন ইফতারের পর আমিসহ বন্ধু আরাফাত, জিহাদ, রামিম, মাহিন, তাইয়েব মিলে সভা জমাই মেঘনা নদীর তীরে। স্থানটিকে বন্ধুরা মজা করে গরিবের মিঠামইন নাম দিয়েছিলাম! দুপাশে মেঘনার সুশীতল পানি আর মাঝখানে দশ ফুটের একটি রাস্তা, অবিকল হাওর অঞ্চলের রাস্তার মতো। আমরা যখন আলোচনা শুরু করি, তখন পশ্চিমের শীতল বাতাস আর আকাশের রুপালি চাঁদের আলোয় আশপাশের পরিবেশে স্বর্গীয় এক দৃশ্যের অবতারণা হয়।
বাড়ির ভেতরে ঢুকতে গিয়ে গা ছমছমে অনুভূতি হলো। জঙ্গলের মতো গাছপালার অন্ধকারাচ্ছন্ন ঘন সারি আর ফাটলধরা পুরোনো দিনের দেয়াল দেখে কিছুটা ভয় অনুভব করি।
আলোচনায় একেকজন একেক জায়গার নাম উপস্থাপন করে। আরাফাত সিলেটের কথা, রামিমের মুখে ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা, জিহাদ বলে পার্বত্য চট্টগ্রামের কথা ইত্যাদি। পরিশেষে তাইয়েবের বলা নরসিংদী জেলার পলাশ উপজেলার ডাঙ্গা গ্রামের লক্ষ্মণ সাহার জমিদারবাড়ির কথা ঠিক হয়। তৎক্ষণাৎ ইন্টারনেটে জায়গাটার পুরো বিষয়াদি এবং কেমন করে যেতে হ,য় তার সম্পূর্ণ তথ্য বের করি। সিদ্ধান্ত নিই, পরদিন সকাল ১০টায় রওনা দেব। সবচেয়ে মজার ব্যাপার ছিল, আমাদের জনপ্রতি খরচের পরিমাণ মাত্র ২০০-৩০০ টাকা। সত্যি বলতে, এটা আমাদের সবার জীবনে প্রথম ভ্রমণ, যা সম্পূর্ণ হয় মাত্র ২৫০ টাকার মধ্যে।
ঘড়ির কাঁটায় সকাল ৯টা ১৭ মিনিট। আমি আর আরাফাত দাঁড়িয়ে ভৈরব দুর্জয় মোড়ে, অপেক্ষা বাকিদের জন্য। আবহাওয়া খুবই চমৎকার, আকাশে পাখির মতো উড়ে যাচ্ছিল সাদা মেঘ, ফাঁকে ফাঁকে উঁকি দিচ্ছিল ঝলমলে রোদ। বাকিদের জন্য অপেক্ষা করতে করতে বেজে গেল প্রায় ১০টা। ততক্ষণে রামিম ও জিহাদ চলে আসে; তাইয়েব ও মাহিনের কোনো দেখা নেই। ওদের জন্য অপেক্ষা করতে করতে বিরক্ত হয়ে যাই। কয়েকবার ভেবেছিলাম দুজনকে রেখেই চলে যাব, কিন্তু পারলাম না; আটকে গেলাম বন্ধুত্বের মায়ায়।
যাহোক, সকাল ১০টা ১০মিনিটের দিকে তাইয়েব কল দিয়ে জানায়, ও আর মাহিন আসছে। আরও জানায়, মাহিনের জন্য অপেক্ষা করতে করতেই তার দেরি হয়েছে। আমরা চারজন এদিকে বুদ্ধি করে রেখেছিলাম যে মাহিন এলেই তাকে একটা মাইর দিতে হবে। কিছুক্ষণ পরই মাহিন ও তাইয়েব এল। আমরা তখনো তাদের কিছু বলিনি, অপেক্ষায় ছিলাম একটা বিশেষ সুযোগের। ৪০ টাকা মূল্যের টিকিট কেটে উঠে গেলাম নরসিংদীগামী বাসে। বাসের অধিকাংশ সিটই খালি। তবু আমরা ঠিক করলাম যে পেছনের সিটে বসে যাব। সিটে বসার সময় পেয়ে গেলাম বিশেষ মুহূর্ত, সঙ্গে সঙ্গেই অ্যাকশন; আমি, রামিম, আরাফাত আর জিহাদ মিলে ঝাঁপিয়ে পড়লাম মাহিনের ওপর। জিহাদ মাহিনের ঘাড় নুইয়ে পিঠটা আমাদের জন্য উন্মুক্ত করে দেয় আর বাকি তিনজন তিন জোড়া হাত দিয়ে তবলা বাজাই মাহিনের পিঠে। অপর দিকে, তাইয়েব অবোধ শিশুর মতো দর্শকের ভূমিকা পালন করে। অবশ্য এ ছাড়া তার আর কোনো উপায়ও ছিল না। বাস ছেড়ে দেয় ১০টা ২৭ মিনিটে। যাত্রাপথের পুরোটা সময় খুবই আনন্দ করি।
১১টা ১০ মিনিটের দিকে বাস থামে নরসিংদীর পাঁচদোনা বাসস্ট্যান্ড মোড়ে। সেখানে সময় নষ্ট না করে সিএনজি স্টেশন থেকে একটি সিএনজি ভাড়া করে নিই। সামনে দুজন এবং পেছনে চারজন। পাঁচদোনার মোড় থেকে ডাঙ্গা গ্রামের রাস্তাটা খুবই সুন্দর। ১৫ মিনিটের যাত্রার পর আমরা পৌঁছাই কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে, ঐতিহ্যবাহী লক্ষ্মণ সাহার জমিদারবাড়িতে।
শহর থেকে অনেকটা ভেতরে গাছপালায় ঘেরা বাড়িটার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য চোখধাঁধানো। বাড়ির প্রধান ফটকের ডানদিকেই একটি জবা ফুলের গাছ। গাছে ৭-৮টা জবা ফুটে ছিল। বাঁ দিকে রয়েছে এক গম্বুজবিশিষ্ট একটি ছোট্ট ঘর। ঘরটি কী কাজে ব্যবহৃত হতো, তা জানা ছিল না। ছোট্ট ঘরটির ডান দিকে পুকুরঘাট। পুকুরটি কচুরিপানায় ভর্তি, তবু ঘাটের লালচে রঙের বসার স্থানগুলোয় পুরোনো দিনের কিছু ছাপ ছিল, যা পুকুরঘাটের সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে তোলে। বাড়িটির ডান দিকে পূজার ঘর, আকারে বেশ বড়। যদিও ঘরটি তালাবদ্ধ। লক্ষ্মণ সাহার এই জমিদারবাড়ি নরসিংদী এলাকায় উকিলবাড়ি নামে অধিক পরিচিত। অবশ্য মালিকানা হিসাব করলে তৎকালীন সময়ে এই এলাকার কোনো এক উকিলবাবু বাড়িটি ক্রয় করেন, যার কারণে বাড়ির নাম হয়ে যায় উকিলবাড়ি। নামটি বাড়ির প্রধান ফটকের ওপরেও খোদাই করে লেখা। অনেককেই বলতে শোনা যায়, বাড়িটি নাকি ‘পদ্মজা’ উপন্যাসের সেই হাওলাদার বাড়ি।
বাড়ির ভেতরে ঢুকতে গিয়ে গা ছমছমে অনুভূতি হলো। জঙ্গলের মতো গাছপালার অন্ধকারাচ্ছন্ন ঘন সারি আর ফাটলধরা পুরোনো দিনের দেয়াল দেখে কিছুটা ভয় অনুভব করি। যে সিঁড়ি দিয়ে ওপরতলায় উঠতে হয়, সেই সিঁড়ির নিচে এক পাগল শুয়ে ছিল। চুলগুলো লালচে রঙের, বড়, উসকোখুসকো, চেহারার মধ্যেও ভৌতিক ছাপ ছিল। লোকটি ঘুমিয়ে থাকায় আমরা আর সময় নষ্ট না করে উঠে পড়ি ওপরতলায়। বাইরের দৃশ্যের চেয়ে ওপরতলার দৃশ্য আরও বেশি সুশ্রী ও ভৌতিক। দেয়ালগুলোয় পুরোনো দিনের খোদাই করা চিত্র। একটি ঘরের মধ্যে ছিল পূজার কিছু জিনিসপত্র। সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর ছিল বাড়িটির ছাদ। ছাদ থেকে আশপাশের অনেকটা জায়গা দেখা যায়। পেছনের জঙ্গলের ভেতর একটি গুইসাপের দেখা মিলল, লেজ নাড়িয়ে জিহ্বা দিয়ে শব্দ শ্রবণ করতে করতে চলে গেল জঙ্গলের আরও ভেতরে। ঘুরে দেখার সময় যতটা আনন্দ লাগছিল, ঠিক ততটাই ভয় পাচ্ছিলাম।
সারা দিন ঘোরাঘুরি করে, দুপুরের পরপরই আমরা নিজেদের বাড়ির উদ্দেশে রওনা দিই। সিএনজিওয়ালার ফোন নম্বর আগে থেকেই সংগ্রহ করায় ফেরা নিয়ে তেমন ঝামেলা হয়নি। বাড়িতে ফিরতে প্রায় সন্ধ্যা। তখনো ইফতারের অনেকটা সময় বাকি।
বন্ধু, ভৈরব বন্ধুসভা