বাংলাদেশের চলচ্চিত্রজগতে মননশীল বোদ্ধা, ভিন্নধারার চলচ্চিত্র পরিচালক সাইদুল আনাম টুটুল। চলচ্চিত্রের ইতিহাস হয়ে ওঠা ‘সূর্যদীঘল বাড়ী’তে চিত্রসম্পাদকের কাজ করে তাঁর সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। পরবর্তী সময়ে অনেক চলচ্চিত্রে এবং বাংলাদেশ টেলিভিশনের অনেক কাজের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। আশি-নব্বইয়ের দশকে আমার শৈশব এবং কৈশোরের বেশ কিছুটা সময় কেটেছে চট্টগ্রাম শহরে। তখন টেলিভিশনের সব সম্প্রচারের খুঁটিনাটি খোঁজখবর না রাখলেও বা সেই বয়সে অনেক কিছু আমার বোধবুদ্ধির বাইরে থাকলেও শহরের বাসায় বসে টেলিভিশনের একজন খুদে দর্শক হিসেবে হয়তো টুটুলের কিছু কাজ দেখেছি। সুবর্ণা মুস্তাফা, আসাদুজ্জামান নূর, হুমায়ুন ফরীদি, ফেরদৌসী মজুমদার বা ফেরদৌসী রহমান নানাভাবে চাক্ষুষ যাঁদের উপলব্ধি করা গিয়েছে, সবার নাম জানি। আড়ালে যাঁরা কাজ করে গিয়েছেন, তাঁদের চেনা হয়ে ওঠেনি।
২০১৮ সালে নিজের ‘কালবেলা’ চলচ্চিত্রের কিছুটা কাজ বাকি রেখে পরিচালক চিরতরে হারিয়ে গেছেন। আজ ২০২৫ সালে বসে আমি এক ছিন্নমূল উদ্বাস্তু কবি যখন ‘কালবেলা’ দেখলাম, নতুন করে আবিষ্কার করলাম আমার ফেলে আসা দেশের হারিয়ে যাওয়া এই পরিচালককে।
’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে নিজের কাহিনি, চিত্রনাট্য, পরিচালনায় সুন্দর একটি ঐতিহাসিক চলচ্চিত্র ‘কালবেলা’ নির্মাণ করেছেন সাইদুল আনাম টুটুল। গল্পটি ২০০১ সালে আইন ও সালিস কেন্দ্র দ্বারা প্রকাশিত ‘নারীর ৭১ ও যুদ্ধপরবর্তী কথ্য কাহিনি’ থেকে নেওয়া। প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত পুরোনো প্রতিবেদন থেকে তা জেনেছি। পরিচালকের সাজানো কাহিনির কেন্দ্রে আছে যুদ্ধ–পূর্ব রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়া একদল শিক্ষার্থীর বিদ্রোহ, বিপ্লব, মুক্তি আন্দোলন। দেশ স্বাধীন করার এই মুক্তি আন্দোলনের নেতা মতিনের সঙ্গে সহপাঠী, সহযোদ্ধা সানজিদা বা শানুর প্রেম হয়। পরবর্তী সময়ে গভীর প্রেম থেকে একে অপরের জীবনসঙ্গী হয়। খুলনার পায়নিয়ার জুট মিলে কাজ করে মতিন। মিলের মধ্যে বাসায় শানুর সঙ্গে আদরে–সোহাগে ভালোবাসার নিবিড় বন্ধনে তার নবপরিণয়ের সংসার। সময়টা একাত্তর। দেশে যুদ্ধ লেগে গেছে। বিদ্রোহের তেজ এই মিল কর্মীর মধ্যেও আছে। সেই আবেগ নববধূর মধ্যেও কম নেই। মিলিটারি মিলের মধ্যে ঢুকে পড়ে, মতিনকে মুক্তি দলের কর্মী শনাক্ত করে শানুর সামনেই বেধড়ক পেটায়। ধরে নিয়ে চলে যায়। আর মিলিটারির হাত ছাড়িয়ে পালিয়ে যায় শানু।
যুদ্ধের পটভূমির ইতিহাসকে টুকরা টুকরা দৃশ্য বুননে সুন্দর তুলে আনেন পরিচালক। দিগন্তবিস্তৃত শস্য–শ্যামলা খেতের মধ্য দিয়ে অপরিচিত পথে আতঙ্কিত শানুর পালিয়ে বেড়ানোর দৃশ্য অসাধারণ। নিজের ভিটেমাটি ছেড়ে যারা হঠাৎ উদ্বাস্তু হবে, আবালবৃদ্ধবনিতা—সবার দেশ ছেড়ে যাওয়ার দীর্ঘ কণ্টাকাকীর্ণ পথচলা হৃদয়বিদারক। পথে পথে ধ্বংস্তূপের দৃশ্য সাজানো থাকে। পাকিস্তানি মিলিটারিদের দেশীয় দালাল রাজাকারদের প্রতিনিধিও হানা দেয়। তেমনি এক মাতব্বরের লালসার শিকার হতে হতে বেঁচে যায় শানু। সবাই প্রাণে বাঁচার জন্য দেশ ছেড়ে যাওয়ার পথে পা বাড়ালেও সে মোটেও জন্মভূমি ছেড়ে যেতে চায় না। মতিনের ভালোবাসা অস্তিত্বের পরতে পরতে দুঃসহ স্মৃতির ভেতর তাকে বেঁধে বেঁধে রাখে।
শুধু পাকিস্তানি হানাদার বা দেশীয় দালাল মাতব্বর নয়, তৎকালীন সময়ের বিহারিদের অবস্থান ও নিপুণ দলিল হয়ে উঠে আসে চলচ্চিত্রে। ভারত ছেড়ে যাওয়া এই উদ্বাস্তু মুসলিম বিহারিরা পাকিস্তানকে মনে করে মুসলিমদের দেশ, মানে পূর্ব পাকিস্তান তাদের নিজেদের দেশ। লুটতরাজ, হানাহানি, বাঙালিদের নানা রকম হেনস্তার কাজে তারাও ওঠেপড়ে লেগেছে। শানুর শরীরের সব অলংকার একদল বিহারি ছোকরা ছিনিয়ে নিয়েছে। শানুর বাবা যখন মতিনকে হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে মিলের দারোয়ান ধাপ্পা দিয়ে ২০০ টাকা ছিনিয়ে নিয়েছে। চলচ্চিত্রে এই বিহারিদের অভিনয়ে কোনো ত্রুটি ছিল না। মুক্তিযুদ্ধের সময় অনেক বিহারি মুক্তিযোদ্ধাদেরও পাশে ছিলেন।
হারিয়ে যাওয়া, গুম হয়ে যাওয়া বা বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া অসংখ্য বাঙালির লাশ বা লাশের চিহ্ন পরবর্তী সময়ে এখানে–ওখানে পাওয়া গেছে, হাজার হাজার মানুষের পাওয়া যায়নি, মিলের ভেতরে পরিত্যক্ত ডোবায় অনেক শ্রমিকের সঙ্গে মতিনের পোশাকের চিহ্নও উঠে আসে। শানু তা শনাক্ত করে। ’৭১-এর ইতিহাস একেবারে জলজ্যান্ত হয়ে ওঠে চলচ্চিত্রে।
কাহিনির মূল প্রাণকেন্দ্রে দাঁড়িয়ে থাকে সানজিদা। তার গর্ভে মতিনের সন্তান। স্বাধীন দেশে জন্মলাভ করে। কিন্তু শানু এবং সন্তান কাউকেই মেনে নেয় না মতিনের পরিবার। যে পাকিস্তানিরা কাউকে ছেড়ে দেয় না, মতিনকে ধরে নিয়ে গেছে আর শানু পালিয়ে বেঁচেছে—তা তাদের কাছে বিশ্বাসযোগ্য নয়। স্বাধীন দেশের একলা নারী, একলা মা-বাপের বাড়ির আশ্রয়েও বোঝা হয়ে থাকতে চায় না। চাকরি নিয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চায়। শিশুপুত্রকে কোলে নিয়ে নতুন জীবনযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
এই চলচ্চিত্রের শৈল্পিক বুনন অনেক উচ্চমানের। যদিও ’৭১ সময়কার বাড়িঘর ততটা ফুটিয়ে তোলা যায়নি। আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে এটা স্বল্প বাজেটের সিনেমা করা অনেকের ক্ষেত্রেই বড় সমস্যা। রবীন্দ্রসংগীত এবং রবীন্দ্রসংগীতের চিত্রায়ণ অনবদ্য। লাইসা আহমদ লিসা এবং ছায়ানটের শিক্ষার্থীরা চলচ্চিত্রের দৃশ্যের উপযুক্ত সুন্দর বাছাই করা গানগুলোতে কণ্ঠ দিয়েছেন। ১৯৬৮ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়াদের কণ্ঠে গণসংগীতের দৃশ্যের শুটিংয়ের কাজ পরিচালক শেষ করে যেতে পারেননি। পরিচালকের স্ত্রী মোবাশ্বেরা খানম এবং দুই মেয়ে ঐশী আনাম ও অমৃতা আনাম মিলে তা শেষ করেছেন। এককথায়, ইতিহাস থেকে ইতিহাসের পথে হেঁটেছে এই চলচ্চিত্রের নির্মাণ।
আবহ সংগীত ও সংগীত পরিচালনায় ছিলেন ফরিদ আহমেদ। শব্দ পরিকল্পনা ও মিশ্রণে অনুপ মুখোপাধ্যায়, বিশ্বদেব বন্দ্যোপাধ্যায়। রং পরিমার্জন করেছেন মোহাম্মদ আমির। সম্পাদনায় ছিলেন সামির আহমেদ। চিত্রগ্রাহক ছিলেন রিপন রহমান খান। স্থির চিত্রগ্রহণ হুমায়ুন কবীর শুভ। সহকারী পরিচালক শওকত আলী রানা ও সাঈদ আহমেদ। প্রধান ব্যবস্থাপক ছিলেন হুমায়ুন কবির টিটু। প্রধান সহকারী পরিচালক রতন কুমার বর্মন।
সানজিদা চরিত্রে তাহমিনা অথৈ এবং মতিন চরিত্রে মো. মনিরুজ্জামান শিশির একদিকে যেমন রবীন্দ্রযুগের প্রেমিক যুগল, প্রেমে আর দ্রোহে বলীয়ান আবার মুক্তিযুদ্ধের সময়ের বিধ্বস্ত লড়াকু মানুষ। সুন্দর সাবলীল অভিনয়ে মন ভরিয়ে দিয়েছেন। কারখানার সহকর্মী আলম চাচার চরিত্রে জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় এবং শানুর বাবার চরিত্রে মাসুম বাশারকে ভালো লাগে। এ ছাড়া সায়কা আহমেদ, কোহিনূর আলম, মিলি বাশার, লুৎফর রহমান জর্জ, শেখ মাহবুবুর রহমান, আসলাম হোসেন, খাদিজা আক্তার মুন, জুলফিকার চঞ্চল, তানভীর মাসুদ, আশফাক নওশের নিজের নিজের চরিত্রে যথাযথ।
দুটি আলাদা পট এবং পরিপ্রেক্ষিতে সাহিত্যে সমরেশ মজুমদারের ‘কালবেলা’ কালজয়ী হয়েছে, চলচ্চিত্রে টুটুলের ‘কালবেলা’ও।
হাওড়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত