এক.
শেফালি। বন্ধু রফিকের ছোট বোন। তাকে বোনের মতোই দেখতাম; কিন্তু সে আমাকে...।
বছর তিনেক পর। হঠাৎ আমাদের মুখোমুখি দেখা হলো। চাপাতলি মার্কেটের দক্ষিণ পাশে। দেখেও না দেখার ভান করে উল্টো পথে পা বাড়ালাম। ও পেছন থেকে চিৎকার করে এগিয়ে আসছে। লোকজন অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে দেখছে। নিজেকে আমার অপরাধী মনে হচ্ছে। ফিরে তাকালাম, ‘আরে তুই, এখানে? কোথা থেকে এলি?’
‘আমাকে এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেলেন হাসান ভাই?’
আমি হাসতে হাসতে বললাম, ‘কী যে বলিস না তুই, আমি ভুলব কেন? সেদিনও তো তোদের বাসায় গেলাম। আন্টিকে সালাম করলাম। আঙ্কেলের হালপুরছি জিজ্ঞেস করলাম। তুই আসছিস কি না, তা–ও জানতে চাইলাম। আন্টি অবশ্য কিছু বলল না। তবে আঙ্কেল বলল, “বসো। অনেক দিন পর এলে। দেশের খবরটবর কিছু রাখো? নাকি সারা দিন ঘোরাঘুরি করে কাটাও? তোমাদের সময় আমরা বিশাল বিশাল অপারেশন করেছি। যুদ্ধ করেছি। দেশ স্বাধীন করেছি। আর তোমরা বসে বসে খালি খাও আর খাবার নষ্ট করো। কাজের কাজ তো কিছুই করো না। নাকি কিছু করো?” আমি মাথা নিচু করে বললাম, “জি না।”
“এই যে বলছি না, তোমরা হলে দেশ ও দশের বোঝা। তোমাদের জুতা আর ঝাড়ু...।”
আমি উঠে পড়লাম। এভাবে বসে বসে অপমান সহ্য করা ঠিক না। অপমানেরও অপমান হবে। তোর বাবা বলল, “আরে ইয়াংম্যান, কোথায় যাচ্ছ? আরেকটু বসো। কথাবার্তা বলি। অনেক দিন পর দেখা হলো। চা-টা কিছু খাবে? বসো। এই কই গেলা? দুই কাপ চা দিয়ে যাও।
“হাসান, তুমি কিছু মনে করো না। আমরা হচ্ছি রিটায়ার্ড পারসন মানুষ। খেয়েদেয়ে কোনো কাজটাজ অবশ্য নেই। তাই কাজের কাজ একটা করি, তা হচ্ছে, বকাঝকা করা। তুমি কিছু মনে করোনি তো?”
জি না চাচা। আমি কিছু মনে করি না।
“কী মুশকিল! কী মুশকিল! তোমাকে এত কিছু বললাম, তুমি কিছুই মনে করলে না। এটা কোনো কথা? মন যেহেতু আছে, সেহেতু অবশ্যই মনে করতে হবে। এখন বলো কী যেন বলছিলাম?”
তোর মা চা নিয়ে আসতে আসতে বলল, “জুতা আর ঝাড়ু...।”
“হা হা হা।” গলা ফাটিয়ে হাসতে লাগল তোর বাবা। “দেখেছ হাসান, কী ভয়ংকর মেধাবী মহিলা। সব মনে থাকে। একদম এ টু জেড পর্যন্ত।”
করিডরে হাঁটছি। কোনোভাবেই ছেলেটার কান্না থামাতে পারছি না। হঠাৎ পেছন থেকে এক অপরিচিতার কণ্ঠ ভেসে এল। ফিরে তাকালাম।
‘কি, বাবা হয়েছেন? এতটুকুন বাচ্চাকে সামলাতে পারেন না?’
দুই.
‘শেফালি, তোর চেহারায় কালো মেঘের ছায়া ভাসছে কেন? মেঘ জমতে থাকলে তো বিরাট বৃষ্টি নেমে আসবে। শহরের মানুষের চলাচল করতে কষ্ট হবে। এমনিতেই রাস্তাঘাটের অবস্থা খুবই খারাপ। খারাপ হলেও একদিক থেকে অবশ্য ভালো। শহরে মেয়র নতুন করে প্রতিবছরই কাজটাজ শুরু করে। কিন্তু কেউ শেষ করতে পারে না।’
শেফালির চোখে টলমল করতে লাগল পানি। এই পড়বে পড়বে বলে মনে হচ্ছে।
‘এ কি পাগলি, তুই তো সর্বনাশ করে ফেলবি।’
আমাকে অবাক করে দিয়ে সত্যি সত্যি কেঁদে ফেলল শেফালি। কেঁদে কেঁদে বলল, ‘আপনি কেন যে অপমানিত হতে আমার বাসায় যান! আপনাকে কেউ দেখতে পারে না। তবু যান। কেন যান বলেন তো!’
‘আরে কাজ থাকে, এ জন্য যাই। এমনি এমনি তো আর কেউ কারও বাসায় যায় না। তা ছাড়া আমি ওসব কথায় কিছু মনে করি না। ওনারা বড় মানুষ, বলছেন তো বলছেন। আর অপমানিত হব কেন? আমি আসলেই কিছু করি না। দেখিস না, পড়াশোনা শেষ করে চাকরিবাকরি খুঁজলাম। পেলাম না। জুতার ছাল উঠতে উঠতে এখন পায়ের চামড়ায় ঠেকে গেছে। কোনো একদিন দেখবি, খালি পায়ে হাঁটাহাঁটি করছি। এতে অবশ্য ভালো। জুতা কেনার টাকাটা বেঁচে যাবে। হা হা হা!’
‘দিন দিন আপনি এমন হয়ে যাচ্ছেন কেন?’
‘কেমন?’
‘বসন্তের দিনের গাছের মতো। যে নিজের সজীবতা বিলিয়ে উদাস হয়ে দূরের পথিকের দিকে তাকিয়ে থাকে।’
‘তোর কথা শুনে খুব হাসি পাচ্ছে। একটু হাসি?’
‘নাহ!’
‘বুঝলি শেফালি, বসন্তের দিন চলে গেলে সেই গাছও কিন্তু আবার নতুন একটা জীবন ফিরে পায়। ডালে ডালে নতুন পাতা আসে, দূর–বহু দূর থেকে পাখি আসে, ডালে বসে, গলা ছেড়ে গান গায় আর হেমন্তকে স্বাগত জানায়। আর আমি? ওই গাছের মতোও নই। আমার কিচ্ছু ভালো লাগে না। উদাস–উদাস লাগে। প্রাণ থেকেও নেই মনে হয়। সেদিন তোর কথা শুনে যদি তোকে নিয়ে স্বার্থপরের মতো পালিয়ে যেতাম, তাহলে তোরই কষ্ট হতো। তোকে নিয়ে যাওয়ার সাহস থাকলেও আমার তোকে সম্মানে রাখার মতো শক্তি ছিল না।
শেফালি!’
‘হুঁ।’
‘আজকাল তোকে একটা অভিশাপ দিতে ইচ্ছা করে।’
‘অভিশাপ?’
‘হুঁ অভিশাপ!’
‘দেন। আমাকে অভিশাপ দিয়ে শেষ করে দেন।’
‘তুই অনেক সুখী হ। অনেক।’
‘হাসান ভাই!’
‘বল।’
‘আপনি এত ভালো কেন?’
‘হা হা, আমি? প্রেমিকার চোখে প্রেমিক সব সময়ই ভালো, নিষ্পাপ। হাজারো পাপ করলেও তার চোখে ধরা পড়বে না। পুরো পৃথিবী যদি চোখে আঙুল ঢুকিয়ে দেখায়, তবু না।
জানিস শেফালি? আমি অনেক খারাপ। প্রমাণ চাস?’
‘নাহ!’
‘কী রে, তোর বর কেমন আছে? সে তো অনেক বড়লোক। তোকে একদিন বলেছিলাম না, তোর অনেক বড় বাড়িতে বিয়ে হবে। দেখলি? হয়ে গেল।’
‘হাসান ভাই, আমার জন্য আপনার মায়া হয় না একটুও?’
‘হয়, হয় তো। এ জন্যই তো তোদের বাড়িতে গিয়ে শিউলি ফুলের ঘ্রাণ নিই।’
‘আমার একটা কথা রাখবেন?’
‘বল।’
‘আর কখনো আমাদের বাড়িতে যাবেন না। আমার খুব কষ্ট হয়।’
‘আমি গেলে তুই কষ্ট পাস?’
‘হুঁ, অনেক।’
‘আমি না গেলে তুই খুশি?’
‘হ্যাঁ, অনেক।’
‘আচ্ছা, তোর খুশির জন্য আমি আর কখনো ও বাড়িতে যাব না।’
‘হাসান ভাই, আরেকটা কথা রাখবেন?’
‘এত অনুরোধ করার কী আছে? সোজা বলে ফেল।’
‘আমি হয়তো বাঁচব না। আর ওরাও চাচ্ছে না আমার গর্ভের বাচ্চাটা বেঁচে থাকুক, পৃথিবীটা দেখুক।’
‘আরে তুই কী যা তা বলছিস? তুই বাঁচবি। তোর টুকটুকে মেয়েটাও বাঁচবে।’
‘প্রথম মেয়ে ওদের পছন্দ না।’
‘কী বলিস! একেকটা মেয়ে একেকটা জান্নাত। কন্যাসন্তান হচ্ছে হৃদয়ের ফুল। সেই ফুলকে অবজ্ঞা করার শক্তি কারও নেই। তুই ভেঙে পড়িস না। আমি তোর কথা রাখব।’
‘হাসান ভাই, আমি সবকিছু ছেড়ে চলে এসেছি। কোথাও ঠাঁই পেলাম না। ছুটে এসেছি আপনার কাছে।’
শেফালি কাঁদতে কাঁদতে বসে পড়ল। আমি তাকে টেনে তুললাম। সে জ্ঞান হারিয়ে ফেলল।
তিন.
ভোর চারটায় শেফালির প্রসববেদনা উঠল। প্রসব করেছে ফুটফুটে একটা রাজপুত্র। কিন্তু সে নিজেই বেঁচে রইল না।
পাগলিটা পাগলামি করেই জিতে গেল। রাজপুত্র কাঁদছে, আমি এগিয়ে গেলাম। কোলে তুলে নিলাম। রাজপুত্র আমার দিকে একপলক তাকিয়ে হেসে উঠল। কী সুন্দর একটা মুখ। ফুটফুটে, ঝকঝকে কচি, সদ্য বোঁটাছেঁড়া তাজা একটা গোলাপ। রাজপুত্র হাসছে। ওর হাসিটা অবিকল শেফালির মতো। আমি ওর পেটে নাক ডুবিয়ে কাতুকুতু দিয়ে বললাম, পৃথিবীতে এসে কি কেউ এভাবে হাসে? দুষ্টু ছেলে! ও মা, ঠোঁট ভেঙে কাঁদতে শুরু করল।
করিডরে হাঁটছি। কোনোভাবেই ছেলেটার কান্না থামাতে পারছি না। হঠাৎ পেছন থেকে এক অপরিচিতার কণ্ঠ ভেসে এল। ফিরে তাকালাম।
‘কি, বাবা হয়েছেন? এতটুকুন বাচ্চাকে সামলাতে পারেন না?’
বলতে বলতে একদম কাছে চলে এল। আমি পেছনে সরে যেতে লাগলাম। অপরিচিতা বলল, ‘হয়েছে, হয়েছে। দেন, আমাকে দেন।’ আমার কোল থেকে ছেলেটাকে একপ্রকার ছিনিয়ে নিয়ে বলল, ‘আমি চুপ করিয়ে দিচ্ছি।
ওলে বাবা৷ সোনামনি, আমার দুষ্টু ছেলে। হাসো, হাসো বলছি। এই তো, কী সুন্দর হাসি!’
আমি চলে এলাম বাইরে। ঝকঝকে রোদ। সকালের মিষ্টি রোদে হাঁটছি। মেয়েটিও আমার সঙ্গে হাঁটছে। বললাম, ‘আপনার ঠিকানা বলুন, আপনাকে পৌঁছে দিই।’
‘আমার কোনো ঠিকানা নেই। প্রজাপতির মতো উড়ে এসে জুড়ে বসেছি আপনার ঘাড়ে। আমাকে গিলবেন না ফেলবেন?’
সূর্য গরম হতে শুরু করেছে। আমি সূর্যের দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘তুমি কাঁটার মতো বিঁধে আছ গলায়। আমি না পারছি গিলতে, না পারছি ফেলতে!’