ইতিহাসের স্মারক কালুরঘাট ব্রিজ

কালুরঘাট সেতুফাইল ছবি

শীতের সকাল। ঘড়ির কাঁটা ১০টা ছুঁইছুঁই। দৃঢ়পায়ে হেঁটে যাচ্ছি চান্দগাঁও পুরোনো সড়ক ধরে। আমাকে অতিক্রম করে পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে ছোট-বড় যাত্রীবাহী যান। কানে হর্নের আওয়াজ আসছে ঠিকই, কিন্তু আমার ঘোর কাটছে না। মিনিট দুই হাঁটলেই পৌঁছে যাবে কর্ণফুলী নদীর তীরে। যেখানে প্রৌঢ়ত্ব লুকিয়ে এখনো সমহিমায় দাঁড়িয়ে আছে শতবর্ষী ব্রিজ।

যদিও চারপাশে গড়ে উঠেছে এক অপরিকল্পিত জনপদ। ছোট-বড় দালানঘর। আমার সেদিকে খেয়াল নেই। বর্তমান দেখছি ঠিক; আর ভাবনাজুড়ে সাদাকালো অতীত। কিচুটা দুঃখের, কিছুটা সুখের। ধু ধু নদীর প্রান্তর। এই ব্রিজ লাগোয়া রাস্তায় চলাফেরা করছে ব্রিটিশ সেনারা। তৎকালীন উন্নত সব অস্ত্র আনা-নেওয়া হচ্ছে এ রাস্তা ধরেই। বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিক। বিশ্ব ইতিহাসে এক ভয়ানক যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে শক্তিধর দেশগুলো। একদিকে বিশাল উসমানীয় সাম্রাজ্য, অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি, জার্মানি ও বুলগেরিয়া। যাদের বলা হতো কেন্দ্রীয় শক্তি। অপর দিকে সার্বিয়া, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জাপান, ইতালি, রুমানিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র। সামরিক-বেসামরিক মিলিয়ে ৪ কোটি বা ৪০ মিলিয়ন মানুষ হতাহতের ঘটনা ঘটে এই যুদ্ধে। যুদ্ধে বার্মা ফ্রন্টে ব্রিটিশরা সৈন্য আনা-নেওয়ার কাজে ব্যবহারের জন্য ১৯১৪ সালে কর্ণফুলী নদীর ওপর এ রেলসেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়। ট্রেন চলাচলের জন্য ৭০০ গজ লম্বা সেতুটি উদ্বোধন করা হয় ওই বছরের ৪ জুন।

এ তো হলো প্রথম পর্ব। সময় কেটে যায়। বিশ্বরাজনীতিতে আসে নতুন চমক। নতুন উন্মাদনা। ১৯৩৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর জার্মানি কর্তৃক পোল্যান্ড আক্রমণের মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা ঘটে। একই বছর ৩ সেপ্টেম্বর ব্রিটেন ও ফ্রান্স জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা দেয়। যুদ্ধের দামামা বেজে ওঠে চারদিকে। সৈন্যভান্ডারে জমা হয় অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র। চারদিকে মরণঘাতী গোলাবারুদের ঝংকার। কালুরঘাট ও চান্দগাঁওয়ের এই রাস্তায় সৈনিকদের সরব উপস্থিতি। আবার সেই বার্মা ফ্রন্টের যুদ্ধে মোটরযান চলাচলের জন্য ডেক বসানো হয় ব্রিজের ওপর। দেশ বিভাগের পর ডেক তুলে ফেলা হয়। পরে ১৯৫৮ সালে সব রকম যানবাহন চলাচলযোগ্য করে ব্রিজটির বর্তমান রূপ দেওয়া হয়।

শুধু প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নয়। ১৯৭১ সালে সেতুটির উত্তর ও পশ্চিম পাশে ঘাঁটি করে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল মুক্তিবাহিনী। এতক্ষণে আমি ব্রিজে পৌঁছে গিয়েছি। কালের সাক্ষী হয়ে আমার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে কালুরঘাট ব্রিজ। বার্ধক্যের পুরো ছাপ ছড়িয়ে আছে সর্বত্র। অযত্ন–অবহেলায় পড়ে আছে নিঃসঙ্গ। যদিও সেই শুরু থেকে নদীর দুই ধারের মানুষের যাতায়াতে অকৃত্রিম বন্ধন সৃষ্টি করেছে সেতুটি। কিন্তু এখন সে অকেজো। ভার বহনে অক্ষম। বেশ কয়েকবার সংস্কার করা হয়েছে সেতুটি। নতুনভাবে সংস্কারের কাজও চলছে। নানা রাজনীতি, চক্রান্ত আর ইতিহাসের সাক্ষী এই লৌহনির্মিত ব্রিজ। কালুরঘাট ব্রিজ নিছক কোনো ব্রিজ নয়, বিভিন্ন ইতিহাসের স্মারক।

হাটহাজারী, চট্টগ্রাম