সব বাধা পেছনে ফেলে নারীর এগিয়ে যাওয়ার গল্প ‘সাতকাহন’

সমরেশ মজুমদারের ‘সাতকাহন’ উপন্যাসের প্রধান চরিত্র দীপাবলি আচ্ছন্ন করেছিল অনেক পাঠককে
শুধু সততার সঙ্গে মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকার জন্য এই চিরাচরিত সমাজের নানা প্রতিকূলতায়ও দীপাবলীর মতো সংগ্রামী ও সাহসী মেয়েরা বলতে পারে বেঁচে আছি আপন পরিচয়ে।

জীবনটা বয়ে চলা নদীর মতো। কখনো বর্ষার জলে পরিপূর্ণ থাকে, আবার কখনো বন্যার জল এসে ভাসিয়ে দেয় মাইলের পর মাইল। সে নদীর জলে শীত এলে টান পড়ে, জল শুকিয়ে যায় আর বসন্তে নদীর বয়ে চলায় নতুন রূপ আসে। দৃশ্যমান রূপে হয়তো এটাই নদীর মতো জীবনের সাতকাহন।

সমরেশ মজুমদারের ‘সাতকাহন’ উপন্যাসটিও এমন একজন সংগ্রামী নারীর জীবন নিয়ে লেখা। লেখক উপন্যাসের প্রতিটি পাতায় পাতায় জীবনযুদ্ধের গল্প লিখেছেন সমাজের সমগ্র নারীজাতির কথা চিন্তা করে। সাজানো–গোছানো এই সাতকাহন একজন নারীর বাহ্যিক, অভ্যন্তরীণসহ নানা রূপে লিখিত হয়ে ধরা দিয়েছে প্রতিটি পৃষ্ঠায়।

দীপাবলি, জন্মসূত্রে মাকে হারিয়ে বাবার অস্বীকৃতি পেয়েছে। আপন মাসী, মেসোর কাছে থেকে বড় হয়েছে, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর দারিদ্র্যের আলপনায় ঘেরা চা–বাগানের কোয়াটার্সে। চিরন্তন সত্যিটা সে জেনেছে বাল্যকালে বিবাহবন্ধন নামক অনুষ্ঠানের কয়েক দিন আগে। যে বিবাহের দৃশ্যমান ঘটনা খুব সংক্ষিপ্ত হলেও এর ভার তাকে বহন করতে হয়েছে চিরকাল। নামের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া বিবাহ–পরবর্তী পদবী তাকে নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়েও নিজের সঙ্গে জড়িয়ে নিয়ে চলতে হয়েছে। অথচ তার প্রথম বিবাহের সময়কাল ছিল মাত্র ৭২ ঘণ্টা। তারপর সে বিধবা হয়ে যায়।

সমাজের আর দশজন মেয়ে যখন কৈশোর, তারুণ্যের রূপ মেনে নেয় আনন্দের সঙ্গে, তখন দীপাবলিকে সংগ্রাম করতে হয়েছে পড়াশোনা আর নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার লড়াইয়ে। তাও আবার বিধবার মন নিয়ে।
সম্পর্কের রদবদল দেখেছে দীপাবলি অর্থের আগমন ও নির্গমনের সঙ্গে। শুধু পদবীবলে স্বামী বলা সে মানুষটি মারা গেলেও শ্বশুর গোপনে সাহায্য করেছে আর্থিকভাবে পড়াশোনা করার জন্য। পালিত বাবা অমরনাথও তা ভাগ্যের দোহাই দিয়ে মেনে নিয়েছিল। দীপাবলি এই সত্য জানার পর প্রথম না মানলেও গুরুতুল্য সত্যসাধন মাস্টারমশাইয়ের যুক্তিতে মেনে নিয়েছিল শেষে এবং ফেরত দেওয়ার প্রতিজ্ঞা নেয় নিজে নিজে। শ্বশুর মারা যাওয়ার পর একমাত্র উত্তরাধিকারী হিসেবে সব সম্পত্তি দীপাবলি পাওয়ার সম্ভাবনা দেখে স্নেহের হাত বাড়িয়ে দিতে এসেছিল জন্মসূত্রে সম্পর্ক ত্যাগ করা বাবা ও আত্মীয়স্বজনেরা। জীবনের এসব রূপ যেন শিখিয়ে দিয়েছিল অর্থ কত দ্রুত মানুষের সম্পর্ক বদলে দেয়। উপরি পাওনার আশায় মানুষ রূপ বদলায়, ব্যবহার পাল্টায়।

বাল্য বয়সের সে বিমর্ষ বিবাহের স্মৃতি নিয়ে জীবন কাটিয়ে দেওয়া দীপাবলি নিজের সামর্থ্যের পরীক্ষা দিয়ে নিজের সুন্দর ও শক্ত একটা সামাজিক ও আর্থিক পরিচয় তৈরি করেছিল। এই কঠিন পথে হাঁটতে গিয়ে বহুবার বহু মানুষের রোষানলের স্বীকার হয়েছে সে। তবু বার বার উঠে দাঁড়িয়েছে। মাথা নত করেনি পুরুষ শাসিত এই সমাজ ব্যবস্থার তৈরিকৃত নিয়মের বেড়াজালে। আত্মসম্মানে আঘাত লাগার আগেই সরকারি চাকরি ছেড়েছিল। তারপর পরিশ্রম করে নিজের মেধায় আবার দেশের সর্বোচ্চ সম্মানজনক সরকারি চাকরিতে যুক্ত হয়েছে।

পড়াশোনা, চাকরি, একা থাকা ইত্যাদি সময়গুলোতে তার জীবনে অনেক বন্ধু এসেছে, চলে গেছে, কিন্তু কেউ স্থায়ী হয়নি। ভালোবাসার রূপ নিয়ে পরিস্থিতি কিংবা ভাগ্যের লেখার বদৌলতে আলোক এসেছিল দীপাবলির জীবনে। স্বাবলম্বী দীপাবলী ভালোবেসে বিয়ে করে সংসারীও হয়েছিল। চাকরি আর সংসার উভয়ই ঠিকভাবে চললেও একটা সময়ের পর একটাকে বিসর্জন দিতে হলো। জীবনপথে সংগ্রাম করতে করতে ক্লান্ত না হওয়া দীপাবলীকে আবার একা হতে হয়েছে।

নারীসত্তার নানা রূপের সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্তিজীবন, সম্পর্কের সূক্ষ্ম টানাপোড়েন, পারিবারিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক নানা প্রেক্ষাপটও যে জীবনের অবস্থানকে কীভাবে পাল্টে দেয়, সেসবও উঠে এসেছে এই সাতকাহনে।

মেধা, পরিশ্রম, সাহস দিয়ে নিজের অবস্থান পরিবর্তন করা গেলেও কোথাও কোথাও আটকে যেতে হয় ভাগ্যের লেখা নামক অদৃশ্য বিশ্বাসে। তখন সকল যুক্তি খণ্ডন করেও যেন বিশ্বাস করার মতো পরিবেশ তৈরি করা যায় না। শুধু সততার সঙ্গে মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকার জন্য এই চিরাচরিত সমাজের নানা প্রতিকূলতায়ও দীপাবলীর মতো সংগ্রামী ও সাহসী মেয়েরা বলতে পারে বেঁচে আছি আপন পরিচয়ে।

একনজরে
বই: সাতকাহন
লেখক: সমরেশ মজুমদার
প্রথম প্রকাশ (অখণ্ড): ২২ অক্টোবর ২০০৫
প্রচ্ছদ: সুব্রত গঙ্গোপাধ্যায়
পাবলিশার্স: আনন্দ
প্রকাশক: দ্বিজেন্দ্রনাথ বসু
মূল্য: ৩০০

বন্ধু, নরসিংদী বন্ধুসভা