কয়েক দিনের একটানা ভারী বর্ষণের ফলে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়। রাস্তাঘাটে, অলিতে-গলিতে পানি আর পানি। গরিব লোকজন কাজের সন্ধানে ঘরের বাইরে পা বাড়াতে পারেনি। এই কদিনে অনেকের ঘরের খাবার শেষ হয়ে গেছে। হাতে টাকা না থাকায় পুরুষদের পাশাপাশি নারীরাও এখন ঘরের বাইরে বেরিয়ে পড়েছে। কেউ ছুটে যাচ্ছে জনপ্রতিনিধিদের কাছে। কেউ যাচ্ছে সমাজের সম্ভ্রান্তদের কাছে। আবার সরকারি সহায়তা পাওয়ার জন্য অনেকেই ভিড় করছে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে।
এই অঞ্চলের জেলা প্রশাসক হারুনর রশীদ। মানুষের সুখে-দুঃখে তিনি দিনরাত কাজ করে চলেছেন। অল্প সময়ের মধ্যে তিনি সাধারণের মনে জায়গা করে নিতে সক্ষম হন। নিজের কার্যালয়ের সামনে মানুষের ভিড় দেখে তিনি এক পা-দুই পা করে সামনে চলে আসেন। একে একে সবার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেন। সাক্ষাৎ শেষে তিনি উপলব্ধি করেন, সাহায্যের জন্য আসা জনতার মধ্যে অর্ধেকের বেশি আছে, যারা আর্থিকভাবে যথেষ্ট স্বাবলম্বী। ব্যক্তিগতভাবে তাদের চেনেনও। প্রকৃতপক্ষে যারা অসহায়, তাদের সংখ্যা হাতে গোনা ৩০-৪০ জন হবে।
সেখানে উপস্থিত সবার উদ্দেশে জেলা প্রশাসক ঘোষণা দিয়ে বলেন, ‘আগামীকাল ক্ষতিগ্রস্ত সবাইকে সরকারিভাবে ত্রাণের ব্যবস্থা করা হবে। এ বিষয়ে বিস্তারিত আজ সন্ধ্যায় মাইকিং করে জানিয়ে দেওয়া হবে।’ সবশেষে তিনি সবাইকে যে যার মতো করে ঘরে ফিরে যেতে অনুরোধ করেন।
সন্ধ্যা সাতটায় মাইকিং করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, ‘আগামীকাল আমাদের জেলা প্রশাসক বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত লোকদের জনপ্রতি এক কেজি করে আটা প্রদান করবেন। যারা ক্ষতিগ্রস্ত, তাদের আগামীকাল সকাল দশটায় জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে উপস্থিত থাকতে বলা হচ্ছে।’ এমন খবর প্রচারের পর অনেকেই বলাবলি করতে লাগল, মাত্র এক কেজি আটা দেবে! তার জন্য গিয়ে কী লাভ! উনি কি আমাদেরকে ফকির ভেবেছেন! শুধু শুধু এক কেজি আটার জন্য নিজেকে খাটো করার কী দরকার!
পরদিন সকাল দশটায় জেলা প্রশাসক তাঁর এডিসি ও সহকারী কমিশনারদের নিয়ে মিটিং করলেন। সবাইকে প্রয়োজনীয় কার্য সম্পাদনের নির্দেশনা দিয়ে পূর্বপরিকল্পনামতো বের হলেন।
আগে থেকেই সেখানে এক কেজি করে আটার প্যাকেট রাখা হয়েছে। এরপর উপস্থিত বন্যাদুর্গতদের সঙ্গে জেলা প্রশাসক মতবিনিময় করেন। তাদের আশ্বস্ত করেন, এভাবে আগামী এক সপ্তাহ ধরে ক্ষতিগ্রস্তদের এক কেজি করে আটা দেওয়া হবে। জেলা প্রশাসক লক্ষ করলেন, আজ অসহায় মানুষ ছাড়া অন্য কোনো মানুষ আসেনি। এরপর তিনি নিজ হাতে সবার মধ্যে আটার প্যাকেট তুলে দেন।
আটা পেয়ে খুশিমনে সবাই যে যার গন্তব্যে ফিরে যায়। বাসায় পৌঁছে আটার প্যাকেট খুলতেই তারা দেখে, আটার ভেতর নগদ পাঁচ হাজার টাকা করে দেওয়া আছে। এই কথা একজন থেকে দুজন, দুজন থেকে তিনজন—এভাবে পুরো এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। এ নিয়ে যারা আটার জন্য যায়নি, তারা খুব আফসোসে পুড়তে থাকে।
পরদিন জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সামনে মানুষের তিল ধারণের ঠাঁই নেই। গরিবদের পাশাপাশি লাইনে দাঁড়িয়েছে স্বাবলম্বী অনেকেই। যথারীতি সকাল দশটায় জেলা প্রশাসক তাঁর দল নিয়ে আগত জনতার সামনে এসে দাঁড়ালেন। সবার উদ্দেশে বললেন, ‘গতকাল এখানে যাঁদের পেয়েছি, তাঁরা প্রত্যেকেই ছিলেন সত্যিকারের অসহায়। তাঁদের প্রত্যেকের আটার প্যাকেটে নগদ পাঁচ হাজার টাকা করে দিয়েছিলাম। কিন্তু আজকে যে আটার প্যাকেট করেছি, তাতে শুধু আটাই আছে। কোনো টাকাপয়সা নেই। আমরা জানতাম আজ যাঁদের সহায়তার প্রয়োজন নেই, তাঁরাও আসবেন। তবে আপনারা কেউ খালি হাতে ফিরে যাবেন না। আটা নিয়েই যাবেন।’
এমন বক্তব্যের পর পেছনের দিক থেকে আস্তে আস্তে করে কেউ কেউ মুখ লুকিয়ে সরে যেতে লাগলেন।
হাতিয়া, নোয়াখালী