‘আমরা গড়ি, আমরা ভাঙি না’

১৮ ডিসেম্বর প্রথম আলো কার্যালয়ে দুর্বৃত্তরা হামলা, লুটপাট করে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়ছবি : প্রথম আলো

দুর্বৃত্তদের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও সংগঠিত আক্রমণের পর অগ্নিসংযোগে কারওয়ান বাজারে অবস্থিত প্রথম আলো ভবন পুড়ে যায়। এই ভবনে ছিল প্রথম আলোর পাঠক সংগঠন বন্ধুসভার কার্যালয়। ১৮ ডিসেম্বর দিবাগত রাতে দেওয়া এই আগুনে প্রথম আলোর সংরক্ষিত সম্পদ এবং বন্ধুসভার মূল্যবান নথিপত্র ভস্মীভূত হয়।

ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় ১৯ ডিসেম্বর ভোররাতে ফেসবুকে এক দীর্ঘ পোস্টে বন্ধুসভা জাতীয় পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি জাফর সাদিক এই ঘৃণ্য হামলার নিন্দা জানিয়েছেন। পাশাপাশি তুলে ধরেছেন বৈষম্যহীন সুন্দর বাংলাদেশ গড়ে তোলার পথে সারা দেশের বন্ধুসভার বন্ধুদের বিভিন্ন অবদানের কথা। বলেছেন দেশ গড়ার পথে ভালো কাজের এই যাত্রা থামবে না, এগিয়ে যাবে নতুন উদ্যমে। জাফর সাদিকের পোস্টটি হুবহু তুলে ধরা হলো।

‘আমার বন্ধুসভা, আমাদের বন্ধুসভা পুড়িয়ে দিয়েছে। অথচ সারা দেশে ১৪৫টি বন্ধুসভা কত কিছু করে, কত কিছু গড়ে! কত তিল তিল করে সাজানো এই অফিসটা! প্রতিটা কোণে শুধুই স্মৃতি আর আমাদের হাতের ছোঁয়া!

বন্ধুরা নিজের টাকায় ত্রাণ দেয়, স্কুল বানায়, পাঠাগার গড়ে, সেতু বানায়। সারা দেশে তিন মাস খালি গাছই লাগায়! সেই গাছের যত্ন নিয়ে লাখ লাখ মানুষকে অক্সিজেন নেওয়ায় সহযোগিতা করে। এই শেষ বছরেই তো ১ লাখ ৩০ হাজার গাছ লাগালাম সারা দেশের বন্ধুরা!

বন্ধুসভার সদস্যরা প্রতি রোজার ঈদে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের কত মমতা আর যত্নে নতুন পোশাক ও তাদের পরিবারের জন্য ঈদের খাবারসামগ্রী উপহার দেয় নিজেদের ঈদ কেনাকাটার টাকা বাঁচিয়ে! গত বছরই ৮ হাজারের বেশি শিশু নতুন জামা পেয়েছে, আরও সাড়ে ৮ হাজার পরিবার পেয়েছে ঈদের খাদ্যসামগ্রী! নিজেদের দেওয়া টাকা মিলে অংকটা ছিল প্রায় ৩৫ লক্ষ টাকা!

আমরা ২৪-এর বন্যাতেই শুধু নিজেদের বিশ্বস্ততার প্রমাণ দিয়ে তোলা ৯ লাখেরও বেশি টাকার ১১ টন ত্রাণ নিয়ে, জীবনের ঝুঁকি তুচ্ছ করে, তুলে দিয়েছি ১১শরও বেশি পরিবারের হাতে! তিনতলা সমান পানিতে নৌকা নিয়ে গহিন গ্রামে ঢুকে পড়েছি, যেখানে টানা তিন দিন না খাওয়া বানভাসি মানুষ আটকে ছিল! নাক ছুঁই ছুই পানিতে হেঁটে মাথায় ত্রাণের বস্তা নিয়ে ছুটেছি গভীর গ্রামে। ফেনী, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালীতে আমরা মানুষ ও গবাদিপশুর জন্য একদম বানের পানি নেমে যাওয়ার ৩–৪ দিনের মাথায় মেডিকেল ক্যাম্প করেছি! হাজারো নারী-শিশু-যুবা আর ৫০০–এর বেশি অবলা গবাদিপশুকে বিনা মূল্যে চিকিৎসা ও ওষুধ দিয়েছি।

গত দুই বছরেই অন্তত ৫ হাজার তরুণকে কর্মমুখী, জীবনমুখী, সমাজমুখী নানা বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়েছি। কতজন আজ আত্মবিশ্বাসী হয়ে নিজেকে গড়ে তুলেছে!
সারা দেশে আমরা শুধু বই পড়ি আর বই পড়ি! এই বছরই হাজারেরও বেশি বই নিয়ে পাঠচক্র করেছে আমাদের বন্ধুরা, সারা দেশে।
আমরা দুর্নীতিবিরোধী শপথ নিয়ে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করি। আমরা সত্য-মিথ্যা আর গুজব চিহ্নিত করতে বন্ধুদের প্রশিক্ষণ দিই!

যখন সারা দেশে মাদক আর কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য, তখন সারা দেশে আমাদের হাজারো বন্ধু দেশপ্রেমের শপথে বলীয়ান হই। মানুষের সেবা, জীবের সেবা আর পরিবেশ-প্রকৃতি রক্ষায় আমরা প্রশিক্ষিত হই, উদ্যোগী হই।
আমরা অসহায়ের মুখে হাসি ফোটানোর কারণ হই, দরিদ্র অসহায়কে রিকশা, সেলাই মেশিন, মালামালসহ ভ্যান, ছাগল, দোকান কিনে দিই, গড়ে দিই, নিজেদের টাকায়, নিজেদের শ্রমে।

আমরা গড়ি, আমরা ভাঙি না। আমরা স্রষ্টার সৃষ্টির সেবা করি, সুখে-দুঃখে পাশে থাকি!
আমরা আজও আগুন লাগানোর অল্প কিছু সময় আগপর্যন্ত মানুষের জন্য, দেশের জন্য, তরুণদের জন্য আর কী কী করা যায়, কীভাবে তাদের সৃষ্টিশীল সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা যায়, কোন মোটিভেশনে তাদের মাদক, সন্ত্রাস, অসিষ্ণুতা থেকে বাঁচিয়ে রাখা যায়, সেটি নিয়েই কাজ করছিলাম।

অথচ ওরা প্রথম আলোতে হামলার নামে আমাদের এসব কাজগুলো বন্ধ করে দিতে চাইল! ওরা জানলও না, এই কক্ষে সব মত-পথ, মিবিষ্ট প্রাণে ধর্মীয় আচার মানা তরুণসহ কত মানুষের আনাগোনা! কতজন এখান থেকে জীবনে বাঁচার লক্ষ্য খুঁজে পায়! সঠিক জীবনের দিশা পায়!
আমরা আর ১০–১৫ মিনিট পরে বের হলেই ওরা হয়তো আমাদের মেরে ফেলত অথবা আগুনে পুড়ে মরে যেতাম! অথচ তারা জানতও না, কাকে মেরে ফেলছে! তারা জানতও না, তারা কত বিপ্লবী তারুণ্য, কতজন হাদিকে তাঁর শহীদি মৃত্যুর প্রতিশোধের দোহাই দিয়ে মেরে ফেলছে!

জেনে রাখো তোমরা! তোমরা প্রথম আলো পোড়াওনি, ও পর্যন্ত তোমরা আসলে যেতেই পারোনি! তোমরা পুড়িয়েছ সারা দেশের লাখো তরুণের স্বপ্নের আঁতুড়ঘর—বন্ধুসভা।
প্রথম আলো তোমাদের কী ক্ষতি করেছে, সেটা তোমরাই জানো। কিন্তু জেনে রেখো, সারা দেশের অন্তত অর্ধলক্ষ তরুণ বিপ্লবী, দেশপ্রেমিক, আস্থাবান মানুষের হৃদয় থেকে তোমরা মুছে গেছ৷

তোমরা আমাদের পুড়ে ফেলতে চাও? আমরা বিপরীতে দেশ গড়তে চাই, আমরা সমাজ আর মানুষের জন্যই কাজ করে যেতে চাই। আমাদের সংগ্রাম, আমাদের বিপ্লব দীর্ঘস্থায়ী। তোমরা কালের স্রোতে হারিয়ে যাবে। আমরা টিকে থাকব ওই বৃদ্ধার ফোকলা দাঁতের হাসিতে, যে অথই বানের পানিতে আটকে থেকে তিন দিন পর একটু বিশুদ্ধ পানি পেয়েছিল! ওই শিশুর নতুন জামায়, যার ঈদটা মলিন পোশাকে কাটাতে হয়নি! ওই দোকানির ঝাঁপে, যে তার সংসারটার হাল ধরেছিল, বন্ধুদের উপহারের দোকানে!

তোমরা ধ্বংসে উন্মাতাল হও, আমরা গড়ব সাম্য। আমরা ধীর, লক্ষ্যে অবিচল। আর আমাদের সেই লক্ষ্যের মনজিলে মাকসুদ মানুষ, দেশ আর প্রকৃতির সেবায় নিজেকে উজাড় করে দিয়ে, নিজেকে প্রস্তুত করে, দেশসেবা আর সততার মধ্য দিয়ে স্রষ্টার সান্নিধ্য লাভ করা।

ইউ লুজার, তোমরা হেরে যাবা। তোমরা সেদিন বুঝবা, কতটা গোমরাহি তোমাদের আচ্ছন্ন করেছিল। “ওয়া লা তাহসাবান্নাল্লাহু গাফিলুন আ'ম্মা তা'মালুন’—তোমরা যা করছ, সে সম্পর্কে আল্লাহকে উদাসীন মনে করো না। আল্লাহ, স্রষ্টা, মহান রব সব দেখছেন। কার ঈমান, কার প্রার্থনা, কার নিবেদন তিনি কবুল করবেন, সেটা শুধু তিনিই জানেন।

শেষ বিচারের দিন আমরা এর জবাব চাইব। পারবে তো আমাদের চোখে চোখ রেখে দাঁড়াতে? সেদিন কিন্তু তোমাদের হাতে কোনো লাঠি থাকবে না, আর আমাদের চোখেও কোনো ভয় থাকবে না, ইনশা আল্লাহ।

সবচেয়ে বেশি আগুনটা যেখানে জ্বলছে, ওখানে আছে বই, লেখার প্যাড আর প্যাকেট প্যাকেট বিস্কুট! ওটাই আমার বন্ধুসভার হেড অফিস, স্বপ্ন গড়ার ছোট্ট একচিলতে কাচের দেয়ালঘেরা বাংলাদেশ। ওখানে ভারত থাকত না, থাকত শুধুই স্বদেশ।’