সুস্থ হয়ে যাওয়ার পর আমি আর মা বিকেলে নদীর পাড়ে গিয়ে বেলা শেষের সৌন্দর্য উপভোগ করতাম। সন্ধ্যায় মসলা চায়ের কাপ হাতে অদ্ভুত সব কৌতুক বলে প্রাণ খুলে হাসতাম।
ছেলেবেলা থেকেই ছিলাম মা-নেওটা, যাকে বলে মা-অন্তঃপ্রাণ। অন্য ভাইদের তুলনায় মায়ের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিল দারুণ। মায়ের সান্নিধ্য পাগলের মতো উপভোগ করতাম, মা-ও আমার জন্য ব্যাকুল হয়ে থাকতেন। ওনার ব্রঙ্কিয়াল অ্যাজমার সমস্যা ছিল, অতিরিক্ত গরম-ঠান্ডায় অসুখের মাত্রা বেড়ে যেত। এ কারণে বছরের প্রায় অনেকটা সময় তিনি শয্যাশায়ী থাকতেন। যখন শয্যাশায়ী থাকতেন, তখন দিন-দুনিয়ার খবর থাকত না। অহর্নিশ বালিশে মাথা রেখে হামাগুড়ি দেওয়ার ভঙ্গিতে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতেন; ঘন ঘন শ্বাস নিতেন আর উচ্চৈঃস্বরে কাশি দিয়ে রাতদিন এক করে ফেলতেন। কখনো কখনো কাশির মাত্রা এত বেড়ে যেত—কাশির মাঝখানে শ্বাস নিতে পারতেন না। সে এক বীভৎস দৃশ্য! যা চোখে দেখার মতো ছিল না।
মায়ের পাশে বসে তাঁর হাতে-পায়ে, বুকে রসুন দিয়ে গরম করা শর্ষের তেল মালিশ করে দিতাম; কষ্ট দেখে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতাম। মাঝেমধ্যে মা-ও আমার গলা জড়িয়ে কাঁদতেন। হয়তো তিনি আমাদের ছেড়ে চলে যাওয়ার ভয় পেতেন, হয়তো ভাবতেন—তিনি চলে গেলে আমাদের কী হবে? কে দেখভাল করবে?
মা যখন বিছানায় পড়ে থাকতেন, তখন কোনো কিছুতেই মন বসাতে পারতাম না। মনের ভেতর শুধু দুশ্চিন্তা ঘুরপাক খেত। স্কুলে গেলে মন পড়ে থাকত মায়ের কাছে। স্কুল থেকে এসে বিকেলের খেলাধুলা রেখে মায়ের পাশে বসে থাকতাম, রাতেও হোমওয়ার্ক শেষ করে ওনার পাশে বসে ঝিমোতাম। মা-ও চাইতেন, আমি যেন তাঁর পাশেই বসে থাকি।
মা সুস্থ হয়ে গেলে, আমাদের মনের আকাশে কালো মেঘ কেটে গিয়ে ঝলমলে সূর্য হেসে উঠত। দীর্ঘ তিমির রাত শেষে পেতাম আলোরাঙা ভোর। মা সুস্থ হয়েই ঘরদোর পরিষ্কারের কাজে লেগে যেতেন। অপরিচ্ছন্নতা একদমই দেখতে পারতেন না। খুব বেশি অসুস্থ থাকতেন বলেই সে সময় মন চাইলেও দেহ সায় না দেওয়ায় সব চুপচাপ দেখে যেতেন। ঘরদোর পরিষ্কার হয়ে গেলে হৃদয়ের সবটুকু ভালোবাসা ঢেলে আমাদের জন্য নানা পদের খাবার রান্নায় ব্যস্ত হয়ে যেতেন। মাকে বারবার বারণ করতাম—এত সব ধকল না নিতে। কিন্তু কে শোনে কার কথা! নিজের মতো করেই কাজ করে যেতেন।
সুস্থ হয়ে যাওয়ার পর আমি আর মা বিকেলে নদীর পাড়ে গিয়ে বেলা শেষের সৌন্দর্য উপভোগ করতাম। সন্ধ্যায় মসলা চায়ের কাপ হাতে অদ্ভুত সব কৌতুক বলে প্রাণ খুলে হাসতাম। আর রাতে চাঁদের আলো গায়ে মেখে, যানবাহনবিহীন রাস্তায় হেঁটে খালামণির বাসায় চলে যেতাম। এসব ছিল আমাদের নিত্যদিনের রুটিন।
মা ছিলেন আমার পরম বন্ধু, ওনাকে ছাড়া কিছুই ভাবতে পারতাম না। বন্ধুরা যখন কেনাকাটা আর বাইরে খাবারের সময় বন্ধু কিংবা বান্ধবীদের প্রত্যাশা করত—তখন এসবেও আমি আমার মাকে ছাড়া অন্যকিছু ভাবতে পারতাম না। যদিও মায়ের অসুস্থতার কারণে আমার ভাবনারা সব সময় সফলতার মুখ দেখতে পেত না, তবু ভাবতে ভালো লাগত।
আমাদের মধ্যে যে শুধু বন্ধুত্বপূর্ণ আর ভালোবাসার সম্পর্ক ছিল তা কিন্তু নয়, মান-অভিমানও চলত। চাকরি ও চাকরিসংক্রান্ত পড়াশোনার জন্য আমাকে ঢাকা থাকতে হতো; মা থাকতেন মফস্সলের বাড়িতে। ঢাকা থাকার সময়ে যদি নিয়মিত ফোনকলে কথা না হতো, তাহলে তিনি বাচ্চাদের মতো অভিমান করে মুখ ফুলিয়ে রাখতেন—ফোন ধরতেন না, কথা বলতেন না। আবার যখন মান-অভিমানের পালা শেষে কথা হতো, তখন বলতে না পারা রাজ্যের সব খবর দিতেন। এসব খবর থেকে পোষা লাল ও কালো রঙের মুরগি কতগুলো ডিম দিয়েছে, সেগুলোও বাদ পড়ত না। বাদ পড়ত না সবজির মাচায় কতগুলো চালকুমড়া ধরেছে, টবের কোন গাছে কী রঙের ফুল ফুটেছে–সহ আরও কত কী!
আমাকে যখন খুব দেখতে ইচ্ছা করত, তখন বারবার কল করে কবে বাড়ি যাব জানতে চাইতেন। কখনো তারিখ দিয়ে সেই তারিখে যেতে না পারলে কল করে বলতেন, ‘তোকে আর আসতে হবে না। তুই ঢাকায় পড়ে থাক!’ যেদিন ঢাকা থেকে বাসায় যেতাম, সেদিন মা না খেয়ে আমার জন্য বসে থাকতেন। বাসায় যাওয়ার পর দুজনে একসঙ্গে বসে খাবার খেতাম—হোক সেটা দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা; আমরা সন্ধ্যায় দুপুরের খাবার খেতাম।
বাড়িতে থাকলেও রাতে সবার খাওয়া শেষে আমরা মধ্যরাতে রাতের খাবার খেতাম। মা আমার জন্যই মধ্যরাতে খাবার খেতেন। কারণ, আমার রাতে দেরি করে খাওয়ার অভ্যাস। মায়ের সঙ্গে এত এত স্মৃতি, লিখতে গেলে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা শেষ হয়ে যাবে; তবু স্মৃতির গল্প শেষ হবে না।
দৌড়ে মায়ের রুমে গিয়ে নাকের কাছে হাত নিয়ে শ্বাস-প্রশ্বাস চলছে কি না, তা আঁচ করার চেষ্টা করছিলাম। ওমনি মা উঠে আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলেন; কিন্তু মুখে কিছুই বললেন না।
যেবার শেষবারের মতো মা অসুস্থ হলেন, সেবার আর ওষুধ, ডাক্তার-কবিরাজ কিছুতেই সুস্থ হচ্ছিলেন না। সেই আগের মতোই দিনরাত মায়ের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে লেগে রইলাম। দিন দিন যখন অবস্থা অবনতির দিকে যাচ্ছিল, তখন স্থানীয় একটি ক্লিনিকে ভর্তি করাই। সেখানেও ওষুধ কিনে আনা, খাবার খাওয়ানো, ঘুম পাড়ানো, ওয়াশরুমে নিয়ে যাওয়াসহ সব কাজ আমিই করতাম; আর রাতে দুজনে হাসপাতালের বেডে শুয়ে নানা গল্প করতাম। আধো ঘুমে টের পেতাম, মা আমার শরীরে কাঁথা টেনে দিচ্ছেন, শরীরের এদিক–সেদিক হাত বুলিয়ে দেখছেন মশা কামড়াচ্ছে কি না।
দিন কয়েকের মধ্যে মায়ের স্বাস্থ্যের কিছুটা উন্নতি হলে, রোজার কয়েক দিন আগে বাড়িতে নিয়ে আসি। আমার রুমের বিছানা থেকে ওনার রুমের বিছানা দেখা যেত। রাতে ক্ষণে ক্ষণে উঠে মায়ের শ্বাস-প্রশ্বাস চলছে কি না, নিশ্চিত হয়ে আবার ঘুমানোর চেষ্টা করতাম; কিন্তু ঘুম আসত না। দুশ্চিন্তা আর বাজে স্বপ্নরা ঘুমাতে দিত না।
একদিন গভীর রাতে খুব বাজে স্বপ্ন দেখে ঘুম ভাঙে। দৌড়ে মায়ের রুমে গিয়ে নাকের কাছে হাত নিয়ে শ্বাস-প্রশ্বাস চলছে কি না, তা আঁচ করার চেষ্টা করছিলাম। ওমনি মা উঠে আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলেন; কিন্তু মুখে কিছুই বললেন না। তিনি জেগেই ছিলেন, হয়তো প্রতিনিয়ত আমার এসব কার্যকলাপ আঁচ করতেও পারছিলেন। তাই আবেগ ধরে রাখতে না পেরে এভাবে কাঁদছিলেন। মা-ছেলে গভীর রাতে একসঙ্গে কেঁদে বুকের ব্যথা হালকা করে যে যাঁর মতো ঘুমাতে গেলাম।
মা যে আমাকে অন্য ভাইদের তুলনায় খুব কাছের মনে করতেন, তার উদাহরণ এ ঘটনাটি:
রোজার মধ্যে একদিন জোহরের নামাজের সময় অজু-গোসল করে নামাজের জন্য তৈরি হয়েছি। এমন সময় মা বললেন, ওনাকে ওয়াশরুমে নিয়ে যেতে। অজু করে আসার কারণে আমার সে মুহূর্তে ওয়াশরুমে ঢুকতে ইচ্ছা করছিল না; তাই ছোট ভাইকে বললাম, মাকে ওয়াশরুমে দিয়ে আসতে। সে ওয়াশরুমে দিয়ে আসে। আমার ফিরতে দেরি হওয়ায় কিছুক্ষণ পর ও-ই গিয়ে ওয়াশরুম থেকে মাকে নিয়ে আসে। আমি নামাজ শেষ করে মায়ের কাছে যেতেই তিনি আমাকে বললেন, ‘তুই ওরে দিয়ে কেন আমাকে ওয়াশরুমে পাঠালি? ও আমাকে ওয়াশরুমে নিয়ে গেল আবার নিয়ে এল। ওর সামনে আমার খুব লজ্জা লাগছিল।’ অথচ সে–ও তাঁর ছেলে, আমিও তাঁর ছেলে। ওনার চোখে আমি অন্য রকম ছিলাম। কারণ, আমি মাকে যেভাবে জড়িয়ে থেকেছি, অন্যরা সেভাবে থাকেনি।
ঈদের দিন দুপুরবেলা আমি আমার রুমে শুয়ে আছি, এমন সময় খালাতো ভাই আমাদের বাড়িতে এলেন। ভাইয়া মায়ের কাছে গিয়ে কথা বলে আমার কাছে এলেন। এটা-সেটা নিয়ে কথা বলছিলেন। হঠাৎ ভাইয়াকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আচ্ছা ভাইয়া, আল্লাহ তাআলা তো সব পারেন। তিনি তো চাইলেই মাকে সুস্থ করেও দিতে পারেন।’ ভাইয়া কিছু সময় আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এবার আর মনে হয় খালা ভালো হবেন না!’ বলেই তিনি রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন।
শরীরের ভেতরে এক শীতল স্রোত বয়ে গেল। ধীরে ধীরে মায়ের রুমে গিয়ে দেখি, তিনি বিছানায় বসে আছেন। পাশে গিয়ে, পিঠে মাথা এলিয়ে দিয়ে বসলাম। আমার চোখ দিয়ে টপ টপ করে পানি গড়িয়ে পড়ছে। মা আমার গালে হাত দিয়ে হু হু করে কেঁদে উঠলেন; আর বলতে লাগলেন, ‘আমি তোদের রেখে কোথায় গিয়ে থাকব?’ এ একটি শব্দই বারবার তিনি বলে যাচ্ছিলেন। ঈদের দিন সবাই যখন আনন্দে ভেসে যাচ্ছিল, আমরা তখন ভিজে যাচ্ছিলাম অশ্রুতে।
ঈদের দিন রাত থেকে আবার মায়ের স্বাস্থ্যের অবনতি হওয়া শুরু করল। ঈদের ছুটি শেষে ওনাকে হাসপাতালে ভর্তি করালাম। প্রাথমিক ডায়াগনসিস করে ডাক্তার নিশ্চিত করলেন, প্রেশার কমে গেছে; দ্রুত স্যালাইন পুশ করতে হবে। মায়ের শরীরে ডোপামিন নামক এক স্যালাইন দেওয়া হয়েছে; কচ্ছপগতির চেয়েও ধীরগতিতে চলছে সেই স্যালাইন। নার্সকে জিজ্ঞাসা করে জানলাম, প্রায় ১৮-১৯ ঘণ্টা ধরে চলবে এই স্যালাইন। একেক সময় একেক ডাক্তার এসে মাকে দেখে যাচ্ছেন আর নিজেদের মধ্যে নিচু স্বরে কথা বলছেন। বিষয়টা ঠিক ভালো লাগছিল না। এমন সময় এক ডাক্তার ডেকে বললেন, ‘আপনি রোগীর কে হন?’ উত্তর দিলাম, ‘রোগী আমার মা।’ ডাক্তার আমাকে বললেন, ‘মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে রাখেন; আপনার মায়ের অবস্থা ভালো নয়। প্রেশার লেভেল ঠিক করার জন্য এই স্যালাইন দেওয়া হয়েছে। যদি প্রেশার উন্নতি করে, তবে আলহামদুলিল্লাহ; আর না হলে...’।
ডাক্তারের কথা শুনে আমার ভেতরে ঝড় বইতে শুরু করেছে; কিন্তু বাইরে নিজেকে ঠিক রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছি; সঙ্গে এটাও বিশ্বাস করতে চাচ্ছি—মায়ের কিছুই হবে না।
মায়ের মাথার কাছে বসে আছি। তিনি মিনিটে মিনিটে পানি খাচ্ছেন এবং সঙ্গে সঙ্গে বমি করে ফেলে দিচ্ছেন। এক হাতে মাকে পানি খাওয়াচ্ছি, অন্য হাতে বালতি ধরে বসে আছি, বমি করতে গেলেই সেটা ওনার মুখের কাছে ধরছি। এভাবেই দুপুর গড়িয়ে বিকেল আর বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা। এর ফাঁকে ফাঁকে নার্সদের দিয়ে প্রেশার মেপে দেখছিলাম উন্নতি হচ্ছে কি না।
ফুফু আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। এত বছরের পরিচিত রাস্তা আজ বড্ড অচেনা লাগছে! গাড়ি স্বাভাবিক গতিতেই চলছে, কিন্তু রাস্তা যেন শেষ হচ্ছে না।
সন্ধ্যার পর থেকে মা একটু একটু কথা বলছিলেন আমার সঙ্গে। রাত প্রায় ১২টা, প্রেশার কিছুটা উন্নতি করেছে। আমি আর খালামণি মায়ের পাশে বসে আছি, তিনি আমার হাত ধরে শুয়ে আছেন। হাসপাতালের পাশেই ফুফুর বাসা। ফুফাতো ভাই আমাকে নিতে এসেছে, যাতে রাতে ওদের বাসায় গিয়ে একটু বিশ্রাম নিতে পারি। ফুফু জানতেন, আমার বেশ ধকল যাচ্ছে। তাই ওকে পাঠিয়েছেন আমাকে নেওয়ার জন্য; কিন্তু মায়ের হাত ছাড়িয়ে আমার যেতে ইচ্ছা করছে না। খালামণি সাহস দিয়ে বললেন, ‘তুই যা, আমি আছি। সারা দিন অনেক ধকল গিয়েছে, গিয়ে একটু বিশ্রাম করে আয়।’ মা আমার হাত ছেড়ে দিয়ে বললেন, ‘যাও সকালে চলে এসো!’ কিন্তু আমার মন মানছে না। বেশ কয়েকবার সিঁড়ি পর্যন্ত গিয়ে আবার ফিরে আসি। শেষবার মায়ের কপালে চুমু খেয়ে বেরিয়ে আসছিলাম, আর মনে মনে আল্লাহকে বলছিলাম, আমি না থাকা অবস্থায় যেন কিছু না হয়; তাহলে সহ্য করতে পারব না।
সকালবেলা খালামণির কলে ঘুম ভাঙল, কল রিসিভ করতেই তিনি বললেন, ‘তাড়াতাড়ি হাসপাতালে আয়, তোর মা তোকে দেখতে চাচ্ছে।’ দ্রুত বিছানা থেকে উঠে রিকশা নিয়ে হাসপাতালে পৌঁছালাম। আমাকে দেখে মা বললেন, ‘আমি একটু কাত হয়ে শোব। সারা রাত একভাবে শুয়ে থেকে শরীর ব্যথা করছে।’ বললাম, ‘এখন তো স্যালাইন খুলে দেওয়া হয়েছে, তোমার যেভাবে ইচ্ছা শুতে পারো।’ তিনি কিছুটা সময় কাত হয়ে শুয়ে থেকে বললেন, ‘আমাকে তুলে বসাও!’ বিছানায় উঠে মাকে তুলে বসালাম। কিন্তু তিনি বসে থাকতে পারছেন না। তাই আবার শুইয়ে দিলাম।
এখন আর মা কথা বলছেন না, পুরো শরীর ঘামে ভিজে গেছে। আমি পাগলের মতো দৌড়ে ডাক্তার খুঁজছি; কিন্তু কারও নাগাল পাচ্ছি না! কিছুক্ষণের মধ্যে একজন ডাক্তার এসে ইসিজি করিয়ে মায়ের মৃত্যু নিশ্চিত করলেন। খালামণি গগনবিদারী চিৎকার করে কান্না করছেন, আশপাশের লোক এসে ভিড় করেছে। আমার খুব কাঁদতে ইচ্ছা করছে, কিন্তু কাঁদতে পারছি না। বিশ্বাস হচ্ছে না, মা মারা গেছেন। খুব শান্তভাবে মায়ের হাত থেকে ক্যানুলা খুলছি, আস্তে আস্তে টেনে স্কচটেপ খুলছি, যাতে মা ব্যথা না পান। উৎসুক জনতা আমাকে এটা-সেটা জিজ্ঞাসা করছে; খুব স্বাভাবিকভাবেই তাদের সেসব প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছি আর তাকিয়ে তাকিয়ে মাকে দেখছি।
অ্যাম্বুলেন্স চলছে, মায়ের খাটিয়ার পাশে মুখ গেড়ে বসে আছি; ফুফু আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। এত বছরের পরিচিত রাস্তা আজ বড্ড অচেনা লাগছে! গাড়ি স্বাভাবিক গতিতেই চলছে, কিন্তু রাস্তা যেন শেষ হচ্ছে না। অ্যাম্বুলেন্সের ভেতর যখন আমার দম বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম, এর কিছু সময়ের মধ্যেই গন্তব্যে পৌঁছালাম। মাকে অ্যাম্বুলেন্স থেকে নামিয়ে উঠানে গাছের ছায়ায় রাখা হয়েছে। আমি মায়ের পাশে বসে আছি; কিন্তু আমার বসে থাকতে ইচ্ছা করছে না, ইচ্ছা করছে পাশে শুয়ে থাকতে; কিন্তু কেন যেন পারছি না। হয়তো চারপাশে অনেক লোকের ভিড়, তাই।
মায়ের পাশ থেকে উঠে ধীরে ধীরে তাঁর রুমের দিকে যাচ্ছি। পেছনে পেছনে ফুফু আসছেন। রুমের ভেতর ঢুকে যখন দেখলাম, বিছানা পড়ে আছে; কিন্তু সেখানে মা নেই! নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলাম না। এবার আমি বিছানায় গড়াগড়ি দিয়ে চিৎকার করে কাঁদছি, সঙ্গে ফুফু-ও আমাকে ধরে কাঁদছেন। মাকে কবর দেওয়ার জন্য প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে। অপেক্ষা করছি বড় ভাইয়ার জন্য—তিনি এলেই জানাজার নামাজ হবে।
তখন অনেক রাত। স্থানীয় স্কুলের মাঠে মায়ের খাটিয়া রাখা। আকাশ ভেঙে জোছনা নামছে। এ রকম কত জোছনা রাতে আমি আর মা ঘুরে বেড়িয়েছি; কিন্তু আজ মায়ের ঘুরে বেড়ানোর শক্তি নেই। তাঁর নিথর দেহ জোছনায় ভেসে যাচ্ছে। ভাইয়া এলেন, জানাজা শেষে মাকে কবর দেওয়া হলো। আমি নিজে হাতে মাকে কবরে শুইয়ে, মাটি দিয়ে ঢেকে দিলাম চিরকালের জন্য।
মায়ের দেহ মাটির নিচে ঢাকা পড়ে গেলেও তাঁর স্মৃতি ঢাকা পড়ে যায়নি। এমন কোনো রাত বা দিন নেই, যে রাতে বা দিনে মাকে স্মরণ হয়ে চোখের পাতা ভিজে যায় না। ওদিকে মা–ও প্রতিনিয়ত আমার সঙ্গে স্বপ্নে দেখা করেন। আমরা স্বপ্নে গল্প করি, ঘুরে বেড়াই। এই তো কিছুদিন আগে মা এসে আমাকে বলছেন, ‘চল ঘুরে আসি।’ জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কোথায়?’ মা বললেন, ‘আগে আয়, তারপর দেখবি।’
আমরা দুজন হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে অন্ধকার এক গুহার ভেতরে ঢুকে গেলাম। চোখে কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। মাকে বললাম, ‘তুমি আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ? আমি তো কিছুই দেখতে পাচ্ছি না।’ মা আমার হাত ছেড়ে দিয়ে বললেন, ‘আমার পেছনে পেছনে আয়!’
মায়ের কণ্ঠ শুনে তাঁর পেছনে পেছনে এগিয়ে যেতে থাকলাম। হঠাৎ তীব্র এক সাদা আলো এসে চোখে লাগল, আলোর তীব্রতায় তাকাতে পারছি না। কিছুক্ষণ চোখ মিটমিট করে তাকিয়ে দেখি, আলোকিত বিস্তীর্ণ এক সবুজ প্রান্তর। যত দূর চোখ যায় সবুজ আর সবুজ। আমি আর মা সেই সবুজ প্রান্তরে দাঁড়িয়ে আছি, মৃদুমন্দ বাতাসে আমাদের চুল উড়ছে...!
ব্লক-জি, বনশ্রী, ঢাকা