প্রায়ই ঘুমের মধ্যে হঠাৎ দরিফ এসে বলে, মতিন, আমার মাকে একটু দেখে রাখিস।’ লাফ দিয়ে উঠে মতিন।
৫২ বছর পর গভীর রাতে ঘরের কোনায় রাখা সিন্দুকের বাঁ পাশের ড্রয়ার খুলে সাদা কাগজে ভাঙা ভাঙা কয়েকটা অক্ষর দেখে চোখ মুছল মতিন। তার জন্ম এক অজপাড়াগাঁয়ে। জেলা শহর থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে হাওরের ওপারে ছোট গ্রাম। বর্ষাকালে এই এলাকায় নৌকা হলো একমাত্র বাহন। বর্ষা শেষে হাওরের রাস্তাগুলো ক্রমশ দৃশ্যমান হলেও ধুলার কারণে চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়ে। গ্রামের উত্তর প্রান্তে একটি জীর্ণ-শীর্ণ টিনের স্কুল। বাচ্চারা কদাচিৎ এলেও নবারুণ মাস্টার স্কুল কামাই দেয় না। মতিন নবারুণ মাস্টারের স্কুলের ছাত্র। পড়াশোনায় খারাপ না। স্কুলের সহপাঠী দরিফ। সে মতিনের সঙ্গে স্কুলে গেলেও পড়াশোনার পাঠ সম্পন্ন করতে পারেনি। সম্পর্কে মতিনের পাড়ার ভাই। বাবার মৃত্যুর পর মায়ের চোখের মণি একমাত্র সন্তান দরিফ।
দুষ্টুমিতে সিদ্ধহস্ত হলেও গ্রামের মানুষ বিপদে যাঁকে খুঁজে পায়, সে সদা-চঞ্চল দরিফ। পাড়ার কারও জ্বর হয়েছে, কবিরাজ ডাকতে হবে, কারও বাচ্চা পানিতে পড়েছে, উদ্ধার করতে হবে। মুহূর্তেই দরিফ হাজির। স্কুলে যেতে ছোট একটি বাজার পাড়ি দিতে হয়। গুটিকয়েক টংদোকান আর ভাসমান কিছু দোকান নিয়ে গ্রামের মানুষের অভাব অনটনের নীরব সাক্ষী এই বাজার।
বাজারে রমজান মাঝির চায়ের দোকান। রমজান মাঝি একসময় নৌকা চালাত। কিন্তু বার্ধক্যের কারণে পেশা পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছেন। দোকানের চায়ের স্বাদ থেকে সবার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু তার পুরোনো রেডিও। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বর্বরতার খবর প্রচারিত হওয়ার পর থেকেই মাঝির দোকানে জনসমাগম বেশি। নবারুণ মাস্টার সবাইকে বুঝায়, নির্বাচনে আমরা জয়লাভ করার পরেও আমাদের প্রতিনিধির হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে তারা আমাদের মুখ বন্ধ করতে চাচ্ছে। পাকিস্তানি জান্তারা আমাদের অধিকার কেড়ে নিয়ে নিরীহ মানুষকে হত্যা করছে। তাদের এই অন্যায়কে রুখে দিতে আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। নিজেদের অধিকার নিজেদেরই প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
এক রাতে মতিন ঘুমাচ্ছিল। ঘরের বাইর থেকে শব্দ আসে—
‘মতিন, ওই মতিন।’ মতিন বুঝতে পারে এটা দরিফের কণ্ঠ।
‘কী হয়েছে রে, দরিফ।’
‘উঠ, কথা আছে।’
মতিন উঠে এল। ঘুটঘুটে অন্ধকারে দরিফ মতিনের হাতে একটা কাগজ ধরিয়ে দিয়ে দ্রুত প্রস্থান করে। মতিন ঘরে গিয়ে কেরোসিনের বাতিতে পড়ে দেখল—
‘মা, আমি নবারুণ মাস্টারের সঙ্গে যুদ্ধে যাচ্ছি। দেশকে মুক্ত করেই তবে ফিরব।’
—মতিন, আমার মাকে একটু দেখে রাখিস। চিঠিটা মায়ের কাছে দিস।
দুই লাইনের চিঠি। পরদিন সকালে মতিন দরিফের মাকে চিঠিটা দেওয়ার পর স্বামীহারা মায়ের সন্তান হারানো উৎকণ্ঠায় মাথায় আকাশ ভেঙে পরার উপক্রম। এক চিৎকার দিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। কান্নায় গ্রামের আকাশ–বাতাস ভারি হয়ে আসে। দুই মাস পর রাজাকার ফকির গনি ও তার দল জানতে পারে, নবারুণ মাস্টার ও দরিফের যুদ্ধে যাওয়ার কথা। ফকির গনি গ্রামে এসে মাস্টারের জীর্ণ স্কুলটি আগুনে পুড়িয়ে দেয়। ধরে নিয়ে যায় দরিফের মাকেও।
পরের দিন গ্রামে আসে দরিফ। মায়ের সঙ্গে দেখা করতে। জানতে পারে মাকে ধরে নিয়ে গেছে রাজাকার গনি। তার পৃথিবীটা সংকীর্ণ হয়ে আসে। চোখের কোনায় পানি, সঙ্গে ভেসে উঠে বাবা মারা যাওয়ার পর কত হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে মা তাকে এত বড় করেছে। পণ করে মাকে উদ্ধার করতেই হবে। মাকে উদ্ধার করতে গিয়ে শত্রুর বুলেটে না ফেরার দেশে চলে যায় দরিফ।
দরিফের মৃত্যু পর তার মাকে ছেড়ে দেয় হানাদার বাহিনী। রোগে শোকে আত্মগ্লানিতে জীবন্মৃত হাড্ডিসার মানুষটির লাশ পাওয়া যায় নবারুণ মাস্টারের স্কুলের পেছনের জঙ্গলের শিমুল গাছে। দেশের জন্য নিজের সম্ভ্রম হারানো ছেলে হারানো মায়ের দাফনে অস্বীকৃতি জানায় গ্রামবাসী। দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা হলেও কেউ এগিয়ে আসেনি। মতিন তার বাবাকে আর রমজান মাঝিকে নিয়ে রাতের বেলা দাফন করে তাকে। দুই লাইনের দরিফের চিঠিটা পাওয়া যায় তার মায়ের আঁচলের কোণে।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মতিন চলে যায় শহরে। পড়াশোনা করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হন। শিক্ষার্থীদের পড়ায় স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাস। প্রায়ই ঘুমের মধ্যে হঠাৎ দরিফ এসে বলে, ‘মতিন, আমার মাকে একটু দেখে রাখিস।’ লাফ দিয়ে উঠে মতিন। সযত্নে রাখা দুই লাইনের চিঠিটা হাতে নিয়ে মাকে দেখে রাখতে না পারার জন্য আজও প্রাণ ছটফট করে।
প্রাক্তন শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়