গ্রামের এক অশিক্ষিত কিশোরী সারদাসুন্দরী কেমন করে রানি স্বর্ণময়ী থেকে ‘মহারানি স্বর্ণময়ী’ হয়ে গেলেন এবং গোটা ভারতবর্ষ ছাপিয়ে ইংল্যান্ডেও তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়ল—সে এক প্রবল বিস্ময়! ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপিত সে সময়কার বিভিন্ন চিঠি, দলিল-দস্তাবেজ, স্বাক্ষর, সিলমোহর কিংবা ছবি—একে একে সব সংগ্রহ করে বিচার-বিশ্লেষণ এবং বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তের সম্মিলনে সেই বিস্ময়কে এক মলাটে গ্রন্থিত করে পাঠকের সামনে উপস্থাপন করেছেন ইতিহাস গবেষক, শিক্ষক, লেখক এবং সম্পাদক আবু হেনা মুস্তাফা। এ কাজে যে তাঁকে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছে, তা পাঠকমাত্রই স্বীকার করবেন।
ভারতবর্ষের ইতিহাসে ব্রিটিশদের প্রায় ২০০ বছর সুদীর্ঘ শাসন-শোষণের ইতিহাস কারও অজানা নয়। বিষয়ভেদে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে বাংলার তৎকালীন জমিদার অর্থাৎ শাসকশ্রেণির আঁতাত কিংবা বিরোধিতা দুটি বিষয়ই লক্ষ করা যায়। মহারানি স্বর্ণময়ী প্রথম নারী, যিনি ব্রিটিশরাজ সরকারের যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে জনগণের জ্ঞাতব্যের জন্য তাদের প্রচারিত আদালতের ও অন্য নির্দেশনাবলি যাতে বাংলায় প্রকাশ করা হয়—এই দাবি উত্থাপন করে তা আদায় করে নেন। এই তথ্যটুকু জানতে পেরেই ইতিহাস গবেষক আবু হেনা মুস্তাফা স্বর্ণময়ী সম্পর্কে অনুসন্ধান শুরু করেন। ফলে বইটি আসে পাঠকের হাতে। একে একে উন্মোচিত হতে থাকে একজন লড়াকু নারীর বিস্ময়কর, চমকপ্রদ ও রোমাঞ্চকর জীবনযাত্রা। যিনি বাংলার নবজাগৃতির অন্যতম অংশীদার।
লেখক আবু হেনা মুস্তাফা একজন আঞ্চলিক গবেষক। ইতিহাসনির্ভর তাঁর বেশ কয়েকটি বই রয়েছে। তবে মহারানি স্বর্ণময়ীর প্রথম পূর্ণাঙ্গ জীবনীগ্রন্থ এই বইটি তাঁর অন্যতম একটি সৃষ্টিকর্ম হয়ে থাকবে বলে আমার বিশ্বাস।
১৮৪৪ সালের ৩১ অক্টোবর বৃহস্পতিবার বেলা আড়াইটা বা সাড়ে তিনটা—এ সময়ে ২২ বছর ৭ মাস বয়সের ক্লান্ত, বুদ্ধিদীপ্ত, সুঠাম দেহের এক তরুণ নিজের মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে ট্রিগার টিপে দিলে দুটি গুলি বের হয়ে যায়। মুহূর্তেই জীবনপ্রদীপ নিভে যায় বহুল আলোচিত ওয়ারেন হেস্টিংসের বিখ্যাত বেনিয়ান কান্ত নন্দীর শেষ বংশধারা, কাশিমবাজার রাজ এস্টেটের মহারাজা কৃষ্ণকান্ত রায় নন্দীর। এ ঘটনার মধ্য দিয়েই উত্থান হয় মহারানি স্বর্ণময়ীর। স্বর্ণময়ী ছিলেন কৃষ্ণকান্ত রায় নন্দীর স্ত্রী। বর্ধমানের ভাটাকুল গ্রামের অখ্যাত তিলি পরিবারে জন্মগ্রহণ করা স্বর্ণময়ীর ভেতরের সুপ্ত প্রতিভা, প্রশাসনিক দক্ষতা, নারীর স্বভাবসিদ্ধ অন্য দৃষ্টি—সবকিছুই একবারেই ঝলক দিয়ে ওঠে স্বামী কৃষ্ণনাথের আত্মহত্যার পর।
স্বর্ণময়ীর মহারানি হয়ে ওঠার আখ্যান জানতে বা জানাতে হলে প্রারম্ভিক ভাগে মহারাজ কৃষ্ণনাথ নন্দীর জীবনকাহিনিতে প্রবেশ অবধারিত। লেখকও সেটাই করেছেন। কৃষ্ণনাথ নন্দী এবং তৎকালীন রাজ্য সম্পর্কে একটা সম্যক ধারণা উপস্থাপন করেছেন। স্বাভাবিকভাবেই তাঁদের বিয়ে, বৈবাহিক সম্পর্ক এবং পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে সম্পর্কের কথা উঠে এসেছে। লেখক উল্লেখ করেছেন, ‘অতিসাধারণ পরিবার থেকে রাজপরিবারে আসা নিরক্ষর এক লাজুক তরুণী স্বর্ণময়ীর জীবনে এই সময়টাতে অনেক পরিবর্তন এসেছিল। শিশুকন্যা লক্ষ্মীমণিকে সময় দেওয়া, গৃহকাজে ব্যস্ততার বাইরে গৃহশিক্ষকদের কাছে নিয়মিত পাঠ গ্রহণ শুরু করায় তিনি বাইরের জগৎ বিষয়ে অনেক কিছু জানতে পারছিলেন।’
রাজার আকস্মিক মৃত্যুর পর উপযুক্ত পুত্রসন্তান না থাকায় ১৮ বছর পূর্ণ না হওয়া সত্ত্বেও তাঁকে প্রাথমিকভাবে এস্টেট পরিচালনার দায়িত্ব নিতে হয়। অবশ্য বেশ কয়েক বছর আগেই কাশিমবাজার রাজ এস্টেট ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রাজস্ব বিভাগের আইনের অধীনে কোর্ট অব ওয়ার্ডসের আওতায় চলে গিয়েছিল। স্বর্ণময়ীর সামনে সবচেয়ে বড় যে সমস্যাটা জটিল এবং আইনগতভাবে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করছিল, তা হলো তাঁর স্বামী রাজা কৃষ্ণনাথের রহস্যময় উইলটি। উইলের বিষয়বস্তু সম্পর্কে ধারণা না থাকলেও তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে তাঁকে সম্পত্তি থেকে একপ্রকার বঞ্চিত করে মাসিক ভাতাভোগীর পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। বিষয়টি সহজভাবে নিতে পারলেন না তিনি। স্বর্ণময়ী উইলের বিষয়বস্তু অনুসন্ধানে দৃঢ়প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন।
স্বামীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে আপাতদৃষ্টে সবার সঙ্গে সুসম্পর্ক তৈরি হলেও তা ছিল একেবারে সাময়িক। পারস্পরিক বিপরীতমুখী চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কারণে শাশুড়ি হরসুন্দরী, ননদ গোবিন্দসুন্দরীর সঙ্গে খুব বেশি দিন সুসম্পর্ক বজায় রাখা সম্ভব হয়নি। রাজার উইলকে কাজে লাগাতে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। কিন্তু স্বর্ণময়ী এই ব্যাপারগুলো বরাবর দৃঢ় পদক্ষেপে মোকাবিলা করেই গেছেন। একের পর এক জটিলতায় পর্যুদস্ত হয়েও কোর্ট অব ওয়ার্ডসকে আইনি মারপ্যাঁচে ফেলে যেভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন, তা অনন্য। সে সময় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে মামলায় জয়লাভ করা যেন এক যুগান্তকারী ঘটনা। লেখক উল্লেখ করেছেন, ‘একজন অল্প বয়সী মহিলা হিসেবে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে এই দীর্ঘ ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ আইনি লড়াই তাঁকে শ্রদ্ধার আসনে বসিয়েছিল।’
পরিস্থিতি পোড় খাইয়ে খাইয়ে মানুষকে কতটা বিজ্ঞ এবং সমৃদ্ধ করে তোলে, তা স্বর্ণময়ীর জীবনালেখ্য থেকে সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়। এটি মূলত একটি গবেষণামূলক গ্রন্থ।
কিন্তু এটাই শেষ লড়াই নয়। আবারও শুরু হয় পারিবারিক ভাঙন। স্বর্ণময়ীর এত দিনকার আইনজীবী যুক্ত হয় শাশুড়ি-ননদের চক্রান্তে। মামলা গড়ায় আদালতে। অন্যদিকে পরাজিত কেশব সরকার লন্ডনের প্রিভি কাউন্সিলে আপিল করার উদ্যোগ নেন। আবারও সেই আইনি লড়াই। একদিকে ক্রমাগত একের পর এক আইনি লড়াই, অন্যদিকে রানি সুসারময়ী (দাদিশাশুড়ি), বড় কন্যা লক্ষ্মীমণি পাড়ি জমান না-ফেরার দেশে। এরপর ছোট কন্যা সরস্বতীর বিবাহ দিলে দ্বিতীয় সন্তান প্রসবকালে সেও পাড়ি জমায় না-ফেরার দেশে। ঘটনার জেরে একমাত্র জামাতার সঙ্গে সম্পর্কে ফাটল ধরে। অতঃপর একমাত্র পৌত্রী করুণাময়ী (ছোট কন্যার প্রথম সন্তান) হয়ে ওঠেন স্বর্ণময়ীর সব বেদনা থেকে প্রশান্তির জায়গা। কিন্তু যার জীবনে দুঃখগাথা, সুখ তো তার সয় না। অল্প কয়েক দিনের মাথায় এই করুণাময়ীও মৃত্যুবরণ করেন। অধিক শোকে পাথর আর অল্প শোকে কাতর—প্রবাদবাক্যটি স্বর্ণময়ীর ক্ষেত্রে শতভাগ সত্যি হয়ে দেখা দেয়। লেখক বলেছেন, ‘১৮৮০ সাল থেকে তিনি একা, কেউ কোথাও নেই তাঁর জন্য। পরবর্তী জীবনে স্বর্ণময়ীর ‘মহারানি’ হয়ে ওঠা, অতুল খ্যাতি, বিপুল প্রভাব, অপ্রতিরোধ্য জনপ্রিয়তা হয়তো এত নিঃসঙ্গর জন্য সম্ভব হয়েছে। যদি সংসারের মোহনীয় মায়া তাঁকে জড়িয়ে ধরত, তবে হয়তো তিনি মহারানি স্বর্ণময়ী হয়ে উঠতে পারতেন না।’
মহারানি স্বর্ণময়ী আবর্তিত সময়কে ধরতে পেরেছিলেন। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিজেকে নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়। এ প্রসঙ্গে সবিনয়ে নিবেদন অংশে লেখক উল্লেখ করেছেন, ‘স্বর্ণময়ী সেই বিদুষী নারী, যিনি বাংলার নবজাগরণের সাক্ষী হতে পেরেছিলেন। শুধু অথর্ব সাক্ষী হয়েই নয়, এই নবজাগৃতির অন্যতম পৃষ্ঠপোষকও ছিলেন। প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের প্রতি তাঁর আস্থা এবং পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সঙ্গে সহজ সম্পর্ক স্বর্ণময়ীকে অনন্য উচ্চতা দান করেছিল। বিদ্যাসাগরের যুগটাকে তিনি সম্যক উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন বলেই স্বর্ণময়ী তাঁর সব কর্মকাণ্ডের ছায়াসঙ্গী হতে পেরেছিলেন। বিদ্যাসাগরের বিধবা বিবাহ প্রচলনে অর্থসহায়তা থেকে শুরু করে ছাপাখানা স্থাপনসহ সবকিছুতেই ছিল স্বর্ণময়ীর অকুণ্ঠ সমর্থন।’
এ ছাড়া শিক্ষাবিস্তারে, চিকিৎসাসেবা প্রসারে, নারীশিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনাসহ কঠোরভাবে প্রশাসনকে নিয়মের মধ্যে রেখে, শক্ত হাতে এস্টেটের সর্বত্র গতিশীল উন্নয়ন কর্মকাণ্ড চালনায় যে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন; একই সঙ্গে যেসব জনহিতৈষী কর্মযজ্ঞ চালিয়েছেন, তা অতুলনীয়। সে সময়কার প্রায় সব সংবাদপত্র স্বর্ণময়ীর পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছিল।
ভারতবর্ষ পেরিয়ে ইংল্যান্ডেও সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল এই মহামানবীর। কিন্তু তিনি দেখতে কেমন ছিলেন, এ প্রশ্নের যথাযথ কোনো উত্তর নেই। জীবদ্দশায় খুব কম মানুষই সরাসরি তাঁকে দেখতে পেয়েছিল। সর্বদাই পর্দার আড়ালে থাকতেন। আর ছবি বলতে তাঁর গঙ্গা নদীর তীরে দাহ করা জ্বলন্ত আগুনের একটি আলোকচিত্র রয়েছে। শেষে গবেষণাকর্মটি সম্পন্ন করতে গিয়ে পাওয়া চিত্র ও দলিলগুলো এবং তথ্যসূত্র সংযোজিত হয়েছে।
পরিস্থিতি পোড় খাইয়ে খাইয়ে মানুষকে কতটা বিজ্ঞ এবং সমৃদ্ধ করে তোলে, তা স্বর্ণময়ীর জীবনালেখ্য থেকে সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়। এটি মূলত একটি গবেষণামূলক গ্রন্থ। রানি স্বর্ণময়ীর জীবনযুদ্ধ সম্পর্কে কয়েক লাইনে ধারণা দেওয়া অসম্ভব কাজ। এ জন্য মহারানিকে জানতে অনুসন্ধিৎসু পাঠকের বইটির প্রতিটি লাইন অবশ্যই পাঠ্য।
লেখক আবু হেনা মুস্তাফা একজন আঞ্চলিক গবেষক। ইতিহাসনির্ভর তাঁর বেশ কয়েকটি বই রয়েছে। তবে মহারানি স্বর্ণময়ীর প্রথম পূর্ণাঙ্গ জীবনীগ্রন্থ এই বইটি তাঁর অন্যতম একটি সৃষ্টিকর্ম হয়ে থাকবে বলে আমার বিশ্বাস।
বই সমাচার
বই: মহারাণী স্বর্ণময়ী
লেখক: আবু হেনা মুস্তাফা
প্রকাশক: আবু হেনা মুস্তাফা
প্রথম প্রকাশ: ২৫ আগস্ট ২০২৩
মূল্য: শিক্ষার্থী: ৩০০ টাকা, শুভেচ্ছা: ৫০০ টাকা
পৃষ্ঠা: ১৪৪
বন্ধু, কুড়িগ্রাম বন্ধুসভা