একদল শহুরে কলেজপড়ুয়া ছেলেমেয়ে। গান যাদের প্রাণ—রক্তে নেশার মতো মিশে আছে। কলেজে তারা বাংলা গানের ব্যান্ড তৈরি করে। উদ্দাম বাংলা গানের স্রোতে নিজেরা মেতে ওঠে, আসর জমিয়ে দিয়ে সবাইকে মাতিয়ে রাখে। তেমনই একদল বন্ধুর আশা-হতাশা, স্বপ্ন, স্বপ্নভঙ্গ, বিষাদ-বেদনা, প্রেম-প্রেমহীনতা, অভাব এবং প্রতি পদে পদে লড়ে যাওয়ার গল্প নিয়ে যৌবনের উদ্দাম শিখা ‘স্ফুলিঙ্গ’ সাজিয়েছেন পরিচালক তৌকীর আহমেদ। কাহিনি, চিত্রনাট্য, পরিচালনা—সবকিছুতেই পরিচালকের নিজের সৃষ্টিশীল স্ফুলিঙ্গ ফুটে ওঠে।
একালের ছেলেমেয়েদের জীবন–যৌবন, জীবনদর্শন, ফ্ল্যাশব্যাকে মুক্তিযুদ্ধের সময়কালের তেজীপ্রাণ যুবকদের লড়াইয়ের সঙ্গে ছাঁচে ঢেলে তিনি মেলানোর চেষ্টা করেন। দেখানোর চেষ্টা করেন মুক্তিযুদ্ধে যাঁরা লড়েছিলেন, দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করেছিলেন, প্রাণ দিয়েছিলেন, আজকের চূড়ান্ত অস্থির সময়ের তরুণদের মধ্যেও তাঁরা বেঁচে আছেন।
আজকের মুক্ত–স্বাধীন দেশের প্রশাসনিক পরিকাঠামোয় যেভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি সক্রিয় রয়েছে, সমাজের প্রতিটি স্তরে দুর্নীতি বাসা বেঁধে আছে, একালের তরুণেরাও অন্যায়–অসত্যের বিরুদ্ধে লড়াই করে ন্যায়ের শাসন, সত্যের মুক্ত দিগন্ত উন্মোচিত করার ক্ষমতা রাখে। শহুরে মদ–সিগারেটে আসক্ত রকমারি চুল–দাড়ির স্টাইলের ব্যান্ডের ছেলেমেয়ে মানেই তারা একেবারে বখে যাওয়া নিকৃষ্ট প্রাণ নয়। যৌবন যেমন মানসিক প্রেম, নেশা এসবে আসক্ত করে, মানবিক প্রেম, দেশপ্রেমেও উদ্বেলিত করে। রক্তে তাদের মুক্তির নেশা, শৃঙ্খল ভেঙে চতুর্দিক আন্দোলিত করে। সুরের নেশায় আসক্ত তারা প্রেম আর প্রতিবাদের গান হয়ে সমাজে নবজাগরণ বিপ্লব আনতে পারে। আজও তাদের পথ দেখায় হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি শেখ মুজিবুর রহমান।
শুধু গান বেঁধে গান করা নয় বা পুরোনো গানে কোরাস হয়ে ওঠা নয়; নতুন গানের প্রস্তুতি নেওয়ার আগে, গানের ভেতরে প্রাণ জাগানোর জন্য তারা বঙ্গবন্ধুর বই পড়ে। পার্থ নামের মেধাবী ছেলেটি, যার বাবা দরিদ্র অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষক। ঘরে বিয়ের উপযুক্ত বোন আছে। ঘুষ না দিতে পারার কারণে দিনের পর দিন বাবার পেনশন চালু হয় না। শহরে কলেজে পড়াশোনার পাশে সেই ছেলেটির রক্তে গান, রক্তে সমাজবদলের স্বপ্ন সমাজতন্ত্র, রক্তে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সে তার মতো করে সমাজকে বুঝে নেয়, কলেজের প্রতিক্রিয়াশীল অধ্যাপককেও সমাজতন্ত্রের মুক্ত পথের যুক্তি বুঝিয়ে দেয়। বঙ্গবন্ধুর মুক্তিচেতনা, বঙ্গবন্ধুর ভাষণ, মুক্তিযুদ্ধের লড়াই নিজের সর্বক্ষণের ভাবনায় তার শিরায় শিরায় প্রবাহিত হয় এবং নিজের চিন্তাচেতনা সে বন্ধুদের মধ্যেও ছড়িয়ে দিতে পারে।
তার নিজস্ব যুদ্ধক্ষেত্র কলেজ প্রাঙ্গণে ছাত্র-শিক্ষকদের একটা বড় অংশ প্রতিক্রিয়াশীল। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী। কমিউনিস্ট পার্থ যাতে রাষ্ট্রের গঠনগত বিষয় নিয়ে নিজের মত ব্যক্ত করতে না পারে, শেখ মুজিবের গান করতে না পারে, ভালো পরীক্ষা দেওয়া সত্ত্বেও অধ্যাপক তাকে ফেল করিয়ে দেয়। পরীক্ষার আগে তাকে প্রশ্নপত্র দেওয়ার লোভ দেখিয়েছিল জাফর। জাফরও গানের দলের সদস্য, কিন্তু দেশের গান, শেখ মুজিবের গান, মুক্তিযুদ্ধের গান করা পছন্দ করে না। স্বাধীনতার চেতনাবিরোধী জাফরদের সঙ্গে ভোগবাদী সমাজব্যবস্থার প্রতিনিধি রাজাকার অধ্যাপকদের গোপন আঁতাত রয়েছে।
জাফর ভালোবাসে আইরিনকে। আইরিনের মা বড় ব্যবসায়ী। উচ্চবিত্ত ভোগে-বিলাসে জীবন কাটায়। অল্প বয়সী একজনকে আবার বিয়ে করতে চলেছে। বিষাদগ্রস্ত আইরিনও মাদকাসক্ত। কিন্তু কলেজে পড়াশোনার পাশাপাশি গান তার রক্তে। সেই আইরিন জাফরকে প্রত্যাখ্যান করে। আইরিন প্রেমে পড়েছে পার্থের। পার্থ তাকে ফিরিয়ে দিয়েছে। পার্থ ভালোবাসে দিবাকে, দিবা সংস্কৃতিমনস্ক। দিবার কবি বাবা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। বাবার পছন্দমতো দিবার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে এক আইনজীবীর সঙ্গে। এই বিয়েতে দিবার মত নেই। পার্থ যে জোর করে দিবাকে বিয়ে করবে, সেই পরিস্থিতি, সেই সামর্থ্য আজ তার নেই। পার্থর বাবা ত্রিশ বছর মাস্টারি করে পেনশন পাচ্ছে না। মা অসুস্থ। পার্থ পরীক্ষায় ফেল করেছে। গান করতে পারছে না। সবকিছু মিলিয়ে পার্থ ভেতরে–বাইরে সমস্যায় জর্জরিত।
ফ্ল্যাশব্যাকে ক্ষণে ক্ষণে এসেছে মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট। আজকের কুশীলবেরাই সেদিনকার যোদ্ধা। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে জর্জ হ্যারিসনের গাওয়া ‘বাংলাদেশ’ গানটি এই চলচ্চিত্রে সুন্দর করে ব্যবহার করা হয়েছে।
নাছোড়বান্দা দিবা কিন্তু পার্থকে যেকোনো অবস্থায় বিয়ে করতে প্রস্তুত। নিরুপায় পার্থ দিবাকে বিয়ে করার জন্য আইরিনের কাছে কিছু টাকা ধার চাইতে যায়। আইরিন ঘরের মধ্যে তখন নেশায় মাতাল ছিল। কাউকে চিনতে পারার মতো অবস্থায় ছিল না। পার্থ আইরিনের প্রেমের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিল। আইরিন অর্থ সাহায্য করার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করল। পার্থ নীরবে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। জাফর পরক্ষণেই আইরিনের ঘরে এসে একলা আইরিনকে বলপূর্বক ধর্ষণ করে। নেশার ঘোরে আইরিন জাফরকে পার্থ ভেবে বসে। পরদিন পার্থর নামে পুলিশের কাছে ধর্ষণের অভিযোগ দায়ের করে।
দিবা পার্থকে বিয়ে করতে চলে এসেছে। ঠিক সে সময় পুলিশ এসে পার্থকে ধরে নিয়ে যায়। পার্থ চরিত্রে শ্যামল মাওলা, দিবা চরিত্রে পরীমনি, আইরিন জাকিয়া বারি মম, জাফর হাসনাত রিপন এবং একালের ব্যান্ড গানের দলের বন্ধুবান্ধব চরিত্রের অন্য ছেলেমেয়েরা সবাই সুন্দর অভিনয় করেছেন। বয়সে একটু বড় সংগীতশিল্পী রাজু চরিত্রে পিন্টু ঘোষ, বাস্তবেই একজন গুণী সংগীতশিল্পী। রোকন ইমনের সঙ্গে এই চলচ্চিত্রের সুর ও সংগীত পরিচালনা করেছেন, নিজেও গান করেছেন।
পার্থর বাবা তিরিশ বছর স্কুলে পড়িয়ে পেনশন না পাওয়া শিক্ষক, সারা জীবন ছাত্র এবং সন্তানদের নীতি–নৈতিকতার পাঠ শিখিয়ে এসেছেন, এমন একজন সৎ মানুষের চরিত্রে মামুনুর রশীদ অনবদ্য। পার্থ যখন মিথ্যা অভিযোগে জেলবন্দী, একদিন তিনি পুত্রের সঙ্গে কারাগারে দেখা করতে আসেন। ছেলেকে এ অবস্থায় দেখে যেভাবে তিনি অনুতাপ–পরিতাপে দগ্ধ, কেদেকেটে অভিনয় করে গেলেন, মর্মে দাগ কেটে যায়। মামুনুর রশীদকে দেখে আমাদের চিরকালের বাঙালি ঘরের সৎ অসহায় পিতাদের কথা মনে পড়ে যায়। দিবার বাবার চরিত্রে ফখরুল বাশার মাসুমও সুন্দর অভিনয় করেছেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী দুই অধ্যাপকের চরিত্রে আবুল হায়াত এবং শহীদুল আলম সাচ্চুর অভিনয় যথাযথ।
পরীমনি মানে দিবার সঙ্গে বিদেশফেরত প্রতিষ্ঠিত যে আইনজীবীর বিয়ে হতে যাচ্ছিল, সেই আইনজীবী আসিফের চরিত্রে রওনক হাসানও অনবদ্য। দিবার মুখের দিকে চেয়ে আসিফ পার্থর মামলাটা হাতে নেয়। সব সাক্ষ্যপ্রমাণ জোগাড় করে প্রমাণ করে দেয় পার্থ নির্দোষ। জাফর আইরিনকে ধর্ষণ করেছিল। পার্থ মুক্তি পাওয়ার পরে আসিফ জোর করে বিয়ে না করে, দিবাকেও পার্থর কাছে ফিরিয়ে দেয়। ভালোবাসা তো এমনও হয়! পাখিকে নিজের ঘরবন্দী না করে প্রকৃত প্রেমিকের সঙ্গে আকাশে উড়ে যেতে দিতে হয়। তোমার ক্ষণিকের মুহূর্তের সঙ্গকে সঙ্গী করে স্মৃতিকাতর আমি নাহয় কাটিয়ে দেব বাকি পেশাদারি জীবন বা অন্য কোথাও খুঁজে নেব ঘর।
কলেজের ছাত্ররা জোরদার আন্দোলন করে পার্থর খাতা রিভিউ করিয়ে প্রকৃত রেজাল্ট বের করে আনে। দুই অধ্যাপকের মুখোশ উন্মোচিত হয়ে পড়ে। ফ্ল্যাশব্যাকে ক্ষণে ক্ষণে এসেছে মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট। আজকের কুশীলবেরাই সেদিনকার যোদ্ধা। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে জর্জ হ্যারিসনের গাওয়া ‘বাংলাদেশ’ গানটি এই চলচ্চিত্রে সুন্দর করে ব্যবহার করা হয়েছে। লালন ফকির, বাউল শাহ আবদুল করিম, হাসন রাজা, আপেল মাহমুদের গানে আসর জমিয়ে দিয়েছে ব্যান্ডের গায়কেরা। সোমেশ্বর অলির লেখা ‘হাজার বছরে একবারই আসে এক মুজিব’ গানটিও এই চলচ্চিত্রের সম্পদ। গানগুলোতে কণ্ঠ দিয়েছেন পিন্টু ঘোষ, মুত্তাকী হাসিব, সুকন্যা মজুমদার, বাসমা কাজী, রোকন ইমন। তরুণ প্রজন্মের মধ্যে তরুণ প্রজন্মের ভাষায় তরুণ প্রজন্মের জীবনযাপনের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধকে বাঁচিয়ে রাখতে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে জাগিয়ে রাখতে এ ধরনের চলচ্চিত্রের ভূমিকা অপরিসীম। তৌকীর আহমেদ ‘স্ফুলিঙ্গ’–এর মধ্য দিয়ে তারুণ্যের নবজোয়ার আনলেন।
হাওড়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত