অমিত, বন্ধুমহলে সবচেয়ে দুষ্টু ছেলেটার নাম। ছেলেটা প্রায়ই ফেসবুকে বন্ধুদের দেওয়া সুন্দর সুন্দর প্রোফাইল পিকচারগুলো হাস্যকরভাবে এডিট করে বিমল আনন্দ পায়। যাদের ছবি সে এডিট করে, তারা প্রথমে বিরক্ত হলেও দিনশেষে তারাসহ সবাই এতে বেশ মজাই পায়। এ ছাড়া দেখা গেল, অমুক তারিখ তাদের কোনো এক বন্ধুর জন্মদিন, ঠিক তখনই সবার মাথায় একটাই চিন্তা আর যার জন্মদিন তার আতঙ্ক, অমিত হয়তো সেই বার্থডে বয় অথবা গার্লকে নিয়ে এবারও হাস্যকর কোনো কভার পিক ডিজাইন করে ফেলবে, যা ঠিক ১২টা ১মিনিটে সব বন্ধু একসঙ্গে তাদের ফেসবুকের কভারে টাঙিয়ে দেবে। তারপর সেই কভার ফটোর নিচে ছুটে চলতে থাকবে উইশ আর দুষ্টু কমেন্টের ট্রেন! অমিত কিন্তু শুধু ভালো লাগা থেকেই কাজগুলো করছে। কিন্তু এর মাঝেই যে সে একজন অঘোষিত গ্রাফিক ডিজাইনারের খাতায় তার নাম লিখিয়ে ফেলেছে, তা বোধ হয় অমিত নিজেও জানে না!
গ্রাফিক ডিজাইন কী
আপনার চারপাশে ভালো করে একটু তাকিয়ে দেখুন তো, এমন কোনো কিছু কি খুঁজে পাবেন, যার কোনো নিজস্ব ডিজাইন নেই? একদমই না। পৃথিবীতে প্রতিটি জিনিসই একটি সুনির্দিষ্ট ডিজাইনে তৈরি। আর এসব ডিজাইন প্রাকৃতিক অথবা মনুষ্য সৃষ্টি—দুই ধরনেরই হতে পারে। মানুষের হাতে ডিজাইন করা শুরু হয় আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ৫০০০ বছর আগে থেকে। তবে নিদর্শন হিসেবে বিভিন্ন গুহায় যে প্রমাণ পাওয়া যায়, তাতে বলতে হয়, এর শুরু অনেক আগে থেকেই। আর এটা শুরু হয়েছে মানুষের প্রয়োজনেই। সেখান থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত অনেক বছর চলে গেছে। এর মধ্যে অনেক কিছু ডিজাইন করা হয়েছে, সৃষ্টি হয়েছে অনেক নতুনত্বের! সবই মানুষের প্রয়োজনে। আগে করা হতো মাটিতে, পাতায়, খাতায় অথবা বিভিন্ন জিনিস কাটাকুটি করে, আর এখন করা হয় ডিজিটাল পদ্ধতিতে, আরও দ্রুত ও সুন্দর করে।
গ্রাফিক ডিজাইন মূলত একটি ক্রিয়েটিভ প্রসেস, যা আর্ট ও টেকনোলজির সমন্বয়ে আইডিয়াগুলো প্রকাশ করে। গ্রাফিক ডিজাইন এমন একটি বিষয়, যার মাধ্যমে আপনার মনের ভাব, কিছু প্রয়োজন, তথ্য, ফন্ট ও কালারের সমন্বয়ে আর্ট ও টেকনোলজির সাহায্যে উপস্থাপন করতে পারবেন। গ্রাফিক ডিজাইন সময়ের অন্যতম একটি সম্মানজনক পেশা এবং এ পেশায় এখনো চাহিদার তুলনায় দক্ষ গ্রাফিক ডিজাইনারের সংখ্যা খুবই কম।
গ্রাফিক ডিজাইনার কে
গ্রাফিক ডিজাইনার হলেন তিনি, যিনি গ্রাহকের চাহিদা অনুযায়ী বেশ কিছু কালার, টাইপফেস, ইমেজ ও অ্যানিমেশন ব্যবহারের মাধ্যমে তাঁর চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম হন। এটার আউটপুট ডিজিটাল বা প্রিন্ট—উভয়ই হতে পারে। আর বর্তমান সময়ে সচরাচর পাওয়া বিভিন্ন টুলস ও লেআউট ব্যবহারের মাধ্যমে গ্রাফিক ডিজাইনার তাঁর কাজকে আরও বেশি ক্রিয়েটিভ ও গ্রাহকের চাহিদা পূরণ করে বাড়তি তৃপ্তি দিতে পারছেন। বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে একজন গ্রাফিক ডিজাইনার যত আপডেট থাকবেন, তার জন্য নতুন নতুন ডিজাইন উদ্ভাবনে তা ততই মঙ্গলজনক হবে।
একজন গ্রাফিক ডিজাইনারের আঁকা বা ড্রয়িং জানা কি খুবই জরুরি
আমাকে প্রায়ই এই অদ্ভুত প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। আসলে ড্রয়িংয়ের ব্যাপারটা অনেকটা সৃষ্টিকর্তাপ্রদত্ত। তার মানে এই নয় যে গ্রাফিক ডিজাইনার হতে হলে আপনাকে খুব ভালো ড্রয়িং জানতেই হবে। কিন্তু ড্রয়িং জানাটা গ্রাফিক ডিজাইনিংয়ের বিশাল ভুবনে আপনাকে ইউনিক ডিজাইন তৈরিতে অনেকটুকুই সাহায্য করবে। আসলে একজন ভালো গ্রাফিক ডিজাইনারের দরকার এক জোড়া কৌতূহলী চোখ। আপনার দরকার চারপাশ ভালো করে পর্যবেক্ষণের সক্ষমতা। আপনি যদি ভালো আঁকিয়ে না-ও হন, তারপরও চারপাশের প্রকৃতির আলো-ছায়ার খেলা, রঙের মিশেল, পারিপার্শ্বিক ডিজাইন, মোটিফ ইত্যাদি খুব আগ্রহের সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করে তা আপনার করা ডিজাইনে ব্যবহার করেই দেখুন না! আপনার করা ডিজাইনটি অবশ্যই যে কারও চোখে লাগতে বাধ্য! ভালো করে রিসার্চ করুন। দেখুন, কেমন ডিজাইন হচ্ছে এখন! বিখ্যাত ডিজাইনাররা কী ধরনের ডিজাইন করছেন। পাশাপাশি এক-আধটু আঁকাআঁকির চেষ্টা চালিয়ে যাওয়াটাও আপনার ডিজাইনে এনে দেবে নতুনত্ব আর পরিপক্বতা।
গ্রাফিক ডিজাইনিংয়ের জন্য শিক্ষাগত যোগ্যতা
যেকোনো পেশায় সফলতা পেতে সে পেশা সম্পর্কে খুঁটিনাটি অনেক বিষয় জেনেই সামনে এগোতে হয়। গ্রাফিক ডিজাইন এমন একটি কাজ, যেখানে শিক্ষাগত যোগ্যতা কোনো বড় বিষয় নয়। তবে এ কাজে যাঁরা একটি সুনির্দিষ্ট কারিকুলাম পড়ে যথাযথ ডিগ্রি অর্জন বা কোর্স করে এ পেশায় আসেন, তাঁরা অবশ্যই অন্যদের চেয়ে অনেক ক্ষেত্রেই তুলনামূলক ভালো ডিজাইন ও কাজ করতে সক্ষম হন। তবু এ কাজের মূল যোগ্যতা হলো, আপনার দৃঢ় ইচ্ছাশক্তি আর নতুন নতুন ডিজাইন উদ্ভাবনের তৃষ্ণা। বর্তমানে কিছু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ এবং হাতে গোনা দু-তিনটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় গ্রাফিক ডিজাইনিংয়ের ওপর ডিগ্রি এবং ডিপ্লোমা কোর্স করিয়ে থাকে। এ ছাড়া বিভিন্ন এলাকার অলিগলিতে ব্যাঙের ছাতার মতো বহু গ্রাফিক ডিজাইন শেখানোর ট্রেনিং সেন্টার গড়ে উঠেছে, যারা আপনাকে শুধু গ্রাফিক ডিজাইনিংয়ে ব্যবহৃত সফটওয়্যারগুলোর বেসিক টুলগুলোর ব্যবহার শিখিয়ে দেবে। বাকিটা কাজের প্রয়োজনে আপনাকে নিজে থেকেই শিখে নিতে হবে! আর বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তির যুগে আপনি চাইলেই এগুলোর কোথাও কোনো ডিগ্রি অথবা ডিপ্লোমা কোর্স না করেও অনলাইনে গ্রাফিক ডিজাইনিংয়ের অনলাইন টিউটোরিয়ালগুলো আত্মস্থ করে এবং নিয়মিত প্র্যাকটিসের মাধ্যমে হয়ে উঠতে পারেন একজন সফল গ্রাফিক ডিজাইনার।
ফটোশপ বা ইলাস্ট্রেটরে দক্ষতা থাকলেই কি ভালো গ্রাফিক ডিজাইনার হওয়া যায়
অনেকেরই ধারণা, কেউ যদি ফটোশপ বা ইলাস্ট্রেটরে খুব ভালো পারদর্শী হন, তাহলেই তিনি ভালো গ্রাফিক ডিজাইনার হতে পারবেন। আসলে ধারণাটা শতভাগ ভুল। খেয়াল করলেই দেখবেন, নীলক্ষেতে যাঁরা গ্রাফিক ডিজাইনের কাজ করেন, তাঁরা আমাদের চেয়ে অনেক বেশি ফটোশপ আর ইলাস্ট্রেটরের অপশনগুলো সম্পর্কে জানেন এবং তাঁরা খুব দ্রুত ডিজাইন করতে পারেন। তারপরও তাঁরা মানসম্মত (দু-একজন ছাড়া) ডিজাইন করতে পারেন না! কখনো ভেবে দেখেছেন, কেন? কারণ, তাঁরা নিজের মেধা খুব কম খাটান, তাঁদের যেভাবে ডিজাইন করতে বলা হয়, তাঁরা ঠিক তা-ই করেন অথবা পুরোনো ডিজাইনগুলো দিয়ে কোনো রকমে একটা গোঁজামিল দিয়ে নতুন ডিজাইন দাঁড় করান। পৃথিবীতে এখন কোন ধরনের ডিজাইন বেশি চলে? নতুন কী ধরনের কাজ করা যায়? বিখ্যাত ডিজাইনাররা কীভাবে কাজ করেন? ডিজাইন কীভাবে উন্নত করা যায়? সুন্দর ডিজাইন বলতে কী বোঝায়? এই বিষয়গুলো সম্পর্কে তাঁরা ভাবেন না। এ জন্য গ্রাফিক ডিজাইনিংয়ের সফটওয়্যারগুলো ভালোভাবে জানার পাশাপাশি একজন ভালো গ্রাফিক ডিজাইনারের কাজ হলো বর্তমানে আশপাশের যেসব ডিজাইন চলছে, তা পর্যবেক্ষণ করে আরও ভালো নতুন ডিজাইন সৃষ্টি করা।
শেষ কথা
গ্রাফিক ডিজাইন মোটেও সহজ কোনো বিষয় নয়। এ পেশায় আপনার কাজ করতে যতক্ষণ সময় লাগবে, তার চেয়ে সেই বিষয় সম্পর্কে ভাবতে অনেক বেশি সময় লাগবে। ডিজাইনের পেছনে সময় দিন। গ্রাফিক ডিজাইন ব্যাপারটিই হলো ডিজাইন তৈরি করার আগেই এর কনসেপ্ট তৈরি করা। গ্রাফিক ডিজাইনে কনসেপচুয়ালাইজেশন ব্যাপারটিই হচ্ছে খুব গুরুত্বপূর্ণ। যাঁর কনসেপ্ট যত ইউনিক, তাঁর ডিজাইন ততই আকর্ষণীয়। সুতরাং কোন কাজে কীভাবে কনসেপ্ট তৈরি করা হয় বা কী ধরনের কনসেপ্ট তৈরি করতে হবে, এ বিষয়ে ভালোভাবে দক্ষতা অর্জন করুন। গ্রাফিক ডিজাইনে একটি কাজ কীভাবে শুরু করব বা কোন প্রোগ্রামে কাজটি করব, সেটাও গুরুত্বপূর্ণ। এ ছাড়া যখনই কোনো ভালো ডিজাইন দেখবেন, তা সংগ্রহ করুন। সফট কপি হলে তা সুন্দরভাবে আপনার পিসির আলাদা ফোল্ডারে গুছিয়ে রাখুন। নিয়মিত এগুলো নিজে নিজে তৈরি করার চেষ্টা করুন। গ্রাফিক ডিজাইনের ওপর প্রকাশিত বই বা ই-বুক সংগ্রহ করুন ও পড়ুন। কারণ, পড়ার কোনো বিকল্প নেই। এতে আপনার জানার পরিধিও বাড়বে। নিয়মিত বিভিন্ন ডিজাইন–সম্পর্কিত পোস্ট পড়ুন। মতামত দিন। নিজেও লেখার চেষ্টা করুন। এতে আপনি অন্যদের মতামত পাবেন। যাঁরা গ্রাফিক ডিজাইন পেশার সঙ্গে আছেন, তাঁদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করুন। এ ছাড়া নিয়মিত স্কেচ করার চেষ্টা করুন, ভালো হোক অথবা না-ই হোক। এতে আপনার সৃজনশীলতা আরও বাড়বে। দিন শেষে আপনিও হয়ে উঠবেন একজন সফল গ্রাফিক ডিজাইনার।
জুনায়েদ আজিম চৌধুরী: গ্রাফিক ডিজাইনার, কার্টুনিস্ট
লেখাটি ২০১৫ সালের অক্টোবরে প্রকাশিত বন্ধুসভা জাতীয় পরিচালনা পর্ষদের ‘তারুণ্য’ ম্যাগাজিনের পঞ্চম সংখ্যা থেকে নেওয়া।