কবিগুরুর দুঃখ

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২৫ বৈশাখ ১২৬৮—২২ শ্রাবণ ১৩৪৮ বঙ্গাব্দ)ছবি: সংগৃহীত

দুঃখ কাকে বলে, এর প্রায় সবই কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পেয়েছিলেন এক জীবনে। স্ত্রী মারা গেলেন ঠিক ৪১ বছর বয়সে। কবির ছিল তিন মেয়ে, দুই ছেলে। রথীন্দ্রনাথ, শমীন্দ্রনাথ সেন, রানি ও দেবী। স্ত্রীর পর অসুস্থ হয়ে মারা গেলেন রানি। এরপর কলেরায় মারা গেল ছোট ছেলে শমী। পুত্রশোকে কবি লিখলেন—
‘আজ জ্যোৎস্নারাতে সবাই গেছে বনে।’
কবির মনে হলো এই জ্যোৎস্নায় তাঁকে বনে গেলে হবে না। বরং তাঁকে জেগে থাকতে হবে, যদি বাবার কথা মনে পড়ে শমীর! যদি এসে কবিকে না পায়? তিনি লিখলেন—
‘আমারে যে জাগতে হবে, কী জানি সে আসবে কবে
যদি আমায় পড়ে তাহার মনে।’

রানির জামাইকে কবিগুরু পাঠিয়েছিলেন বিলেতে ডাক্তারি পড়তে। না পড়েই ফেরত এল। বড় মেয়ের জামাইকে পাঠিয়েছিলেন বিলেতে, ব্যারিস্টারি পড়তে। না পড়েই ফেরত এল। ছোট মেয়ে অতশীর জামাইকেও আমেরিকায় কৃষিবিদ্যার ওপর পড়াশোনা করতে পাঠানো হলো। লোভী এই লোক কবিকে বারবার টাকা চেয়ে চিঠি দিত। কবি লিখলেন—
‘জমিদারি থেকে যে টাকা পাই, সবটাই তোমাকে পাঠাই।’
দেশে ফেরার কিছুদিন পর ছোট মেয়েটাও মারা গেল।

সবচাইতে কষ্টের মৃত্যু হয় বড় মেয়ের। বড় জামাই বিলেত থেকে ফেরার পর ছোট জামাইয়ের সঙ্গে ঝগড়া লেগে কবির বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। মেয়ে বেলা হয়ে পড়েন অসুস্থ। অসুস্থ এই মেয়েকে দেখতে কবিগুরু প্রতিদিন গাড়ি করে মেয়ের বাড়ি যেতেন। কবিকে যত রকম অপমান করার এই কাজটি করতেন। কবির সামনে টেবিলে পা তুলে সিগারেট খেতেন। তবু কবি প্রতিদিনই যেতেন মেয়েকে দেখতে। একদিন কবি যাচ্ছেন, মাঝপথেই শুনলেন বেলা মারা গেছে। কবি শেষ দেখা দেখতে আর গেলেন না। মাঝপথ থেকেই ফেরত চলে এলেন। হৈমন্তীর গল্প যেন কবির মেয়েরই গল্প! শোক কতটা গভীর হলে কবির কলম দিয়ে বের হলো—
‘আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে।
তবু শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে॥’

কবিগুরুর মৃত্যু হলো অতিমাত্রায় কষ্ট সহ্য করে, প্রস্রাবের প্রদাহে। কী কারণে যেন কবির বড় ছেলে রথীন্দ্রনাথের কাছ থেকে শেষ বিদায়টাও পাননি। দূর–সম্পর্কের এক নাতনি ছিল কবির শেষ বিদায়ের ক্ষণে। কবি জমিদার ছিলেন, এই সব গল্প সবাই জানে। কিন্তু ওনার দুঃখের এই জীবনের কথা কজন জানেন?

প্রথম যৌবনে যে গান লিখলেন, সেটাই যেন কবির শেষ জীবনে সত্যি হয়ে গেল—
‘আমিই শুধু রইনু বাকি।
যা ছিল তা মেনে চলে, রইল যা তা কেবল ফাঁকি॥’

সাংগঠনিক সম্পাদক, ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি বন্ধুসভা