আকাশের সব মেঘ যেমন বৃষ্টি হয়ে ঝরে না, জীবনের সব স্বপ্নও তেমনিভাবে সত্যি হয় না। এবড়োখেবড়ো রাস্তায় ভ্রমণের মতো জীবনও একটা দীর্ঘ ভ্রমণ। যেখানে সুখ-দুঃখ, অভাব-অনটন, বিপর্যয় মিলেমিশে থাকে। চিরদিন যেমন সুখে কারও জীবন অতিবাহিত হয় না, তেমনি চিরদিন দুঃখেও কারও জীবন কাঁটে না। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় অর্থকে সুখের মূল বিবেচনা করা হলেও অর্থ সব সমস্যার সমাধান দিতে পারে না। প্রকৃতি জীবনের গীতিআলেখ্যে এত কৌশলে রচনা করে যে যার অর্থ আছে তার সব সমস্যা সে অর্থ দিয়ে মেটাতে পারে না। আবার যার অর্থ নেই, তার প্রায় সব সমস্যায় অর্থকেন্দ্রিক হয়ে ওঠে। কী করবে মানুষ? পরিস্থিতি যা–ই হোক না কেন, দৃঢ়তার সঙ্গে মোকাবিলা করবে। কোনোমতেই হতাশ হবে না। পাহাড় কেটে পথ নির্মাণের মতো অদম্য ইচ্ছাশক্তি নিয়ে লড়বে। শুরুর থেকেই লড়তে লড়তে জিততে জিততে মানুষ পৃথিবীর সৌকর্য নির্মাণ করেছে। অথচ আজ কোথায় সেই দৃঢ়তা, লড়াই করার মনোভাব। সামান্য কিছুতে আমরা কেন হতাশ হয়ে যাচ্ছি, হাল ছেড়ে দিচ্ছি। কথায় আছে, ‘যে সহে, সে রহে।’ এর চেয়ে নিটোল সত্যি কিছু হতে পারে না। যে লড়তে জানে, সে কখনো পরাজিত হয় না। যে লড়তে জানে, প্রকৃতি তার পক্ষের হয়ে যায়।
বাজপাখি শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত লড়ে যায়। কেবল লড়ে যায় বললে ভুল বলা হবে, পুনঃস্থাপিত করতে রীতিমতো নিজেকে ধ্বংস করার সিদ্ধান্ত নিতে হয়।
ইতিহাস পুনরাবৃত্তি বা দৃষ্টান্তের প্রয়োজন নেই, বাজপাখির জীবনের গল্প থেকেই এ কথার সত্যতা মেলে। কীভাবে? উত্তর খোঁজার আগে বাজপাখি সম্পর্কে কিছু কথা বলে নেওয়া দরকার। ফ্যালকনিফরমিস বর্গের সদস্য বাজপাখি তীক্ষ্ণ দৃষ্টির জন্য বিখ্যাত। মানুষের চেয়ে আট গুণ দৃষ্টিশক্তিসম্পন্ন বাজপাখি তিন হাজার ফুট দূর থেকেও সবকিছু স্পষ্ট দেখতে পায়। দ্রুত উড়তে সক্ষম এ পাখির গতিবেগ ঘণ্টায় ২০০ মাইল। একাগ্রতা, দ্রুতগামিতা ও ক্ষিপ্রতার জন্য সুপ্রাচীনকাল থেকে শিকারের কাজে মানুষের পছন্দের তালিকায় আছে বাজপাখির নাম। কোনো কোনো অঞ্চলে কৃষিকাজের সহায়ক হিসেবেও পাখিটি ব্যবহৃত হয়। ফসল বিনষ্টকারী প্রাণীদের শিকারের জন্য কৃষকেরা বাজপাখিকে ব্যবহার করে থাকেন। তা ছাড়া বাজপাখি পালন ও শিকার পৃথিবীর কিছু অঞ্চলে আজও সাহস ও পৌরুষের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়।
আর কথার বিস্তার না করি। বাজপাখির টিকে থাকার লড়াইয়ের গল্পটা বলি। একটি বাজপাখি স্বাভাবিকভাবে ৭০ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে। কিন্তু প্রকৃতিগতভাবে বয়স ৪০ হতে না হতেই এদের শরীরের কার্যক্ষমতা কমতে শুরু করে। যেমন পায়ের নখ লম্বা ও নরম হয়ে যায়। ঠোঁট সামনের দিকে মুড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ডানাও ভারী হয়ে যায়। ধীরে ধীরে বাজের ক্ষিপ্রতা ও দ্রুতগামিতা কমে আসে। যে কারণে শিকার ধরাসহ বেঁচে থাকার জন্য করণীয় প্রতিটি কাজে বাজপাখি অসমর্থ হয়ে পড়ে। এ পরিস্থিতিতে নিজেকে বাঁচাতে কী করে বাজপাখি? বলার আগে ব্যক্তিজীবনের কিছু পরিস্থিতি কল্পনা করি। রোগ, শোক, জরা, দুঃখ-দুর্দশা, ব্যর্থতাসহ নানা কারণে আমাদের কমবেশি প্রত্যেকের জীবনেও এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়। তখন আমরা কী করি? বেশির ভাগই লড়াই না করে হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দিই। ভাবি, জীবন এমনই। আমাকে দিয়ে আর কোনো কিছু সম্ভব নয়। কেউ কেউ জীবন থেকে পালিয়ে যাওয়ার মতো ভুল সিদ্ধান্তও নিয়ে থাকি।
কিন্তু বাজপাখি শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত লড়ে যায়। কেবল লড়ে যায় বললে ভুল বলা হবে, পুনঃস্থাপিত করতে রীতিমতো নিজেকে ধ্বংস করার সিদ্ধান্ত নিতে হয়। শুরুতেই বাজ তার ঠোঁট ঠুকরে ঠুকরে ভেঙে ফেলে। এরপর নখগুলোও একই প্রক্রিয়ায় ভেঙে ফেলে। শুরু হয় অপেক্ষা। নতুন ঠোঁট ও নখ গজানোর পর ডানার পালকগুলো ছিঁড়ে ফেলতে হয়। দীর্ঘ ১৫০ দিনের অসহনীয় যন্ত্রণা শেষে নতুন পালক ফিরে পায় বাজ। ফিরে পায় ওড়ার ক্ষমতা ও ক্ষিপ্রতাও, যা দিয়ে আরও ৩০ বছর জীবন অতিবাহিত করতে পারে।
বাজপাখির জীবনের এ লড়াই আমরা যারা সামান্য আঘাতে হতাশ হই, ভেঙে পড়ি, ভাবি আমাকে দিয়ে কিছু সম্ভব না, তাদের জন্য অনুপ্রেরণার। লড়তে লড়তে সবাই একদিন জিতে যায়। হতাশা, আশাহত হওয়া, দুঃখবোধ ভালোকিছু দিতে পারে না। দুঃখের মধ্যেও আনন্দের বিষয় খুঁজে নিতে পারাটাই গৌরবের। ছোট-বড় সাফল্যের নিরিখে নয়, নিজেকে এগিয়ে নেওয়াতেই জীবন মহিমান্বিত হয়। জীবন সুন্দর, অনাবিল আনন্দের; জীবন কখনো ব্যর্থ হয় না।
কেশবপুর, যশোর