চট্টগ্রামের আঞ্চলিক বচন আছে, ‘একজন হতা হই দশজনে আসিলে ইতারে হই রইস্যা, নিজর হতাত নিজে আসিলে ইতারে হদে বেইশ্যা।’ আজকাল বেইশ্যা মানুষের অভাব না থাকলেও দেশে রসিক মানুষের বড় অভাব। একজন কথা বলে দশজনে হাসলে তাকে বলে রসিক। তেমনই একজন রসিক রাজা কবি ইউসুফ ভাই। ছোটবেলা থেকে দেখেছি, তিনি কোনো আড্ডায় বসলে হাসির গল্প শুনিয়ে সবার পেটে খিল ধরিয়ে দিতেন। অনেকে বলে কবি ইউসুফ ভাইয়ের পেটে লাফিং গ্যাসে ভরা! পাশ দিয়ে হেঁটে গেলেও আপনাআপনি হাসি চলে আসে।
আদিকাল থেকেই চট্টগ্রামের পটিয়া শিক্ষাদীক্ষা ও সংস্কৃতিতে বেশ উর্বর। উপজেলার গুণী ও ভালো মানুষদের মধ্যে তিনিও একজন। একদিন আড্ডায় বসেছিলাম কবি ইউসুফ ভাইয়ের সঙ্গে। জেনেছি তাঁর অনেক না–বলা কবিগানের গল্প। স্মৃতির ঝাঁপি থেকে লেখার চেষ্টা করেছি।
জন্মকথা ও পরিবার
আবু ইউসুফ ১৯৫৪ সালে ২৭ ডিসেম্বর পটিয়া পৌরসভার ৫ নম্বর ওয়ার্ডের হাজির পাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। পিতা মরহুম আহমেদুর রহমান, মাতা আমেনা বেগম। বাবা ছিলেন চাকরিজীবী। ১৯৮৪ সালে নূর বেগমের সঙ্গে পারিবারিকভাবে বিয়ে হয়। সাংসারিক জীবনে তিনি এক পুত্র ও এক কন্যাসন্তানের জনক। ছেলে রাকিব নিরীক্ষক ও মেয়ে পপি ব্যাংকার হিসেবে কর্মরত। বেশ হাসিখুশি এক পরিবার। শৈশবের পুরোটা কেটেছে পটিয়ায়।
শিক্ষাজীবন
পড়ালেখার হাতেখড়ি মায়ের কাছে। প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করেন মোহছেনা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে, এ এস রাহাত আলী হাইস্কুল থেকে এসএসসি এবং ১৯৭৩ সালে পটিয়া সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি এবং পরবর্তী সময়ে ডিগ্রি সম্পন্ন করেন। ১৯৭৮-৭৯ সালের দিকে ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। স্কুলবেলায় অধ্যয়নের সময় প্রয়াত প্রধান শিক্ষক মুসা স্যার কবি ইউসুফের কবিগানের প্রতিভা দেখে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছিলেন।
কর্মজীবন
কর্মজীবন শুরু করেন সাবানের ব্যবসা দিয়ে। ১৯৮০-৮১ সালের দিকে পটিয়া খাসমহল রোডে কাপড় কাচার সাবানের ব্যবসা শুরু করেন। ইউসুফ সোপ ফ্যাক্টরি নামে একটি সাবান তৈরির কারখানাও ছিল। বেশ কিছু বছর সাবানের ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন তিনি। সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ার পর ব্যবসায় আর মন বসাতে পারেননি। পরবর্তী সময়ে কবিগানের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন।
কবিগানের সঙ্গে পথচলা
একসময় গ্রামবাংলার ঐতিহ্য ছিল কবিগান, পালাগান। কবি ইউসুফ তখন নবম শ্রেণির ছাত্র। পটিয়া রাহাত আলী স্কুলের মাঠে কবিগানের আসর বসত। একদিন রাতে কবিয়াল এয়াকুব আলী সরকার ও কবিয়াল ফণীন্দ্র লাল বড়ুয়ার কবিগান মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে উপভোগ করেন। সেদিন থেকে কবিগানের প্রেমে পড়ে যান আবু ইউসুফ। আনোয়ারা থানার ইয়াকুব আলীর কাছে গিয়ে কবিগান শেখা শুরু করেন। ধীরে ধীরে উপস্থিত বুদ্ধি দিয়ে গানের সঙ্গে ছড়া, কবিতা, আবেগ, ছন্দ মিলিয়ে কবিগান তৈরি করার এক সুনিপুণ কারিগর হয়ে ওঠেন তিনি। প্রথম দিকে ছন্দের সমস্যা হলেও পরবর্তী সময়ে দেশবরেণ্য কবিয়াল এস এম নুরুল আলমের কাছ থেকে নতুন করে তালিম নেন। এস এম নুরুল আলম তাঁকে শিক্ষাগুরুর মতো অনুপ্রেরণা দিয়েছিলেন। স্কুলে অধ্যয়নের সময় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে কবিগান পরিবেশন করতেন।
পরিবারের সদস্যদের মধ্যে কবিগানের জন্য সবচেয়ে বেশি অনুপ্রেরণা দিয়েছিলেন তাঁর নানা ছালেহ আহমেদ সওদাগর। রাহাত আলী স্কুলের তৎকালীন প্রধান শিক্ষক মুহাম্মদ মুসা স্যার। এক রাতে কবিগান করে ৪০ টাকা সম্মানী পেয়েছিলেন। এটাই ছিল তাঁর জীবনে প্রথম কবিগানের জন্য সম্মানী। কবিগানের আসর বেশ মজার। কবিতার গানে ছন্দে পাল্টাপাল্টি লড়াই। এই লড়াইয়ে থাকতেন তালতলা চৌকির জহির আহমদ, সওকত, শহীদউল্লাহ, মাঝেমধ্যে তালেব সংকেতও যোগ দিতেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা চলত লড়াই। দর্শকদের মধ্যে হাসির রোল পড়ে যেত। কবি ইউসুফের সঙ্গে থাকতেন কবিয়াল কালাম মিয়া ফারুকী, কবিয়াল পুলিন দাশ, কবিয়াল শামসুল আলম, কবিয়াল মিলন সরকার, কবিয়াল রতন বড়ুয়া, নিরঞ্জন সরকার, কবিয়াল আবদুল মান্নান, কবিয়াল রাজীব সরকারসহ আরও অনেকে।
কিছু মজার ঘটনা
কবি ইউসুফ মানে পটিয়ার হাসির রাজা। অনেকে মজা করে বলেন, ‘আঁরার নাসির উদ্দিন হোজ্জা’; কেউ বলেন ‘গোবিন্দ’; সদা হাস্যোজ্জ্বল এই সহজসরল মিষ্টভাষী প্রাণবন্ত মানুষটি যেকোনো আড্ডায় গেলে কৌতুক করে কবিগান শুনিয়ে হাসিয়ে আর আনন্দে মাতিয়ে রাখেন। বিয়েবাড়ি, গায়েহলুদ অনুষ্ঠানে, উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে সরকারি-বেসরকারি নানা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে ইউসুফ ভাইয়ের ডাক পড়ে। ওনার মুনশিয়ানা হলো উপস্থিত যে উপলক্ষ নিয়ে অনুষ্ঠান কিংবা যাঁকে নিয়ে অনুষ্ঠান, মুহূর্তের মধ্যে অনুকাব্য বা ছন্দাকারে লিমেরিক রচনা করে তা সুরেলা কণ্ঠে কৌতুকের মাধ্যমে উপস্থাপন করা।
মজার অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে ইউসুফ ভাই জানান, বাঙালি জাতির কী বুদ্ধি! আইসের পেছনে বাঁশ দিয়ে নাম রেখেছে আইসক্রিম। আমাদের চাটগাঁইয়ারা আস্ত মুরগি-কুরা জবাই করে চামড়া ছিলে নাড়িভুঁড়ি বের করে। শৈল্পিকভাবে মুরগির গলা-পা মুচড়িয়ে পেটের ভেতর ঢুকিয়ে নাম দিয়েছে দুরুছ কুরা। একদা পলাশদের বাড়িতে খানাপিনার আয়োজন চলছিল। পাশে রাস্তা দিয়ে গল্প করতে করতে হেঁটে যাচ্ছিলেন তিনি ও তালেব চাচা। দুজনে আবার ভোজনরসিক। আবোলাইন্যা মেজ্জান পেলে কথা নেই; দুজনে লুঙ্গির গিট্টু-প্যান্টের হুক খুলে দিয়ে গরুর মাংস টানতে পারেন বেশ। ওই দিন রান্না করা মাংসের সুঘ্রাণ পেয়ে তালেব চাচা ইউসুফ ভাইকে জড়িয়ে ধরে লাফ দিয়ে কোলে উঠতে গিয়ে দুজনে লুটোপুটি খেয়ে রাস্তা থেকে ধানের জমিতে পড়ে গেলেন। তালেব চাচার পরিধানের তহবন খুলে গেল। চাচার দিগম্বর কায়া দেখে কবি ইউসুফ ভাই হেসে খুন। উঠে তাড়াতাড়ি লুঙ্গির গিট্টু দিয়ে বললেন, ‘বন্ধু পলাশের বাড়িতে আয়োজন হচ্ছে দুরুছ কুরার, সুঘ্রাণ আসছে।’ তালেব চাচা বললেন, ‘চল দুজনে আবোলাইন্যা গরবা সেজে খেতে যাই। তুই কনেপক্ষ, আমি বরপক্ষ।’
বাড়িতে গিয়ে দুজনে বসে পড়লেন বিশেষ মেহমানদের টেবিলে। খাবার টেবিলে কালাভুনা, নেহারি, চিংড়ি, দুমাছা, কলিজা ভুনা, ডিম, নানা পদের মাছ আরও কত কী। সঙ্গে আস্ত পাহাড়ি দুরুছ কুরা। আয়োজনটা ছিল জেয়াফত উপলক্ষে নতুন বেয়াই-বেয়াইন আসবে। দুরুছ কুরাও ছিল অতিরিক্ত। দুজনে ভেবেছেন বিয়েবাড়ির খানাপিনা। চুপিচুপি খেতে বসে গেলেন তাঁরা। দুরুছ কুরার সুগন্ধে দুজনে মাতাল। কে আগে নেবেন দুরুছের রান, শুরু হলো টানাটানি; কবি ইউসুফ বললেন, ‘বন্ধু দুরুছ কুরার মাথা হন্ডে?’ তালেব চাচা বললেন, ‘মাথা-পা সব তো কুরার পাছার ভেতর মুছড়িয়ে ঢুকিয়ে দিছে।’ দুরুছ কুরার মাথা খুঁজতে গিয়ে ডিম বেরিয়ে এল। তালেব চাচা বললেন, ‘দুরুছের ভেতর সিদ্ধ ডিম কীভাবে এল বন্ধু?’ কবি ইউসুফ বললেন, ‘নতুন জামাই বোকা না চালাক, পরীক্ষা করার জন্য দিয়েছে। খবরদার ডিমটা খাইছ না তুই। মুরগির পাছার ভেতর ঢুকিয়ে দে।’
পলাশ দূর থেকে তাঁদের কাণ্ড দেখে কাছে এসে বললেন, ‘এই তোমরা কারা?’ কবি ইউসুফ ভাই বললেন, ‘জি ভাইয়া, আমি বরপক্ষ’; তালেব চাচা চিৎকার দিয়ে বললেন, ‘ভাই, আমি কনেপক্ষ।’ পলাশ বললেন, ‘ভাই, এসব কী বলছেন। এটা আমার বাবার জেয়াফত অনুষ্ঠান। নতুন বেয়াই-বেয়াইনের জন্য টেবিল সাজানো হয়েছে।’ দুজনে লজ্জা পেয়ে কাঁচুমাচু করতে লাগলেন। টেবিলে বসা মেহমানরা হেসে খুন। আবোলাইয়্যা মেজবান খেয়ে আসার পথে কবি ইউসুফের মাথায় কাক প্রকৃতির ডাক সারল, ‘মরার কাউয়া, সর্বনাশ গইজ্জি—আজিয়া আঁর আবোলাইয়া মেজবান হ’অন-র শাস্তি। তোরা হাগিবার আর জাগা নফালিদি না।’
ছোটবেলায় মামাতো বোনের প্রেমে পড়েছিলেন। মা–বাবা রাজি না হওয়ায় সেই প্রেম বেশি দূর গড়ায়নি। মায়ের পছন্দে বিয়ে করেছিলেন। বিয়ের দিন যখন শালা-শ্যালিকারা গেটে আটকে দিয়ে মুখে পাউডার মেরে দেয়, কবি ইউসুফ পাউডার মুখে কবিগান গেয়ে উঠলেন, ‘আনন্দের নাই শেষ, শহর থেকে বিয়ে করে খুশি হলাম বেশ। শালা-শালি তোরা আঁর মুখ খানত পচা ময়দা মারি গড়লি আঁরে শেষ!’
অর্জন
কবি ইউসুফ হাজারেরও বেশি স্টেজে কবিগান গেয়েছেন। চট্টগ্রামে টিভি, বেতার ও বিভাগীয় পর্যায়ের সরকারি-বেসরকারি অনুষ্ঠানে কবিগানের জন্য সম্মাননা পেয়েছেন। চট্টগ্রাম বিভাগের প্রতিটি থানা ও উপজেলায় এমনকি প্রত্যন্ত অঞ্চলে কবিগান গেয়ে বেশ সুনাম অর্জন করেছেন। ২০১৭ সালে নড়াইলে চারণ কবি বিজয় মেলা অনুষ্ঠানে কবিগানের জন্য তাঁকে স্বর্ণপদক প্রদান করা হয়। ওই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড. পবিত্র সরকার। চট্টগ্রাম সমিতি ঢাকা, চট্টগ্রাম জেলা ও বিভাগের অনেক সংগঠন থেকেও সম্মাননা পেয়েছেন।
কবি ইউসুফের জীবনের কষ্টের স্মৃতি মাকে হারানো। তিনি আজও ভুলতে পারেননি। মায়ের প্রতি তাঁর বেশ ভক্তি ছিল। আনন্দের স্মৃতি যেদিন প্রথম কন্যাসন্তানের বাবা হলেন। আড্ডা শেষে বললেন, সম্মান করো গুরুজনে। উন্নত হওয়া যায় না গুরুর দোয়া বিনে। সম্মানের জায়গায় থাকুক আমাদের নারী, অর্ধেক জনসংখ্যা তারা। তাদের ছাড়া উন্নয়ন করতে কি আমরা পারি? নারীদের জিহ্বার ক্ষয় নাই। রশীদ এনাম ভাই আঁই উগগা মেজ্জাইন্যা নলা খাইতাম চাই।
উপদেষ্টা, পটিয়া বন্ধুসভা