মুভি আলোচনা
ক্ষমতার অলিন্দে ব্যক্তি–শিল্পীসত্তার লড়াই ‘সামথিং লাইক অ্যান অটোবায়োগ্রাফি’
সৃষ্টিশীল মানুষের কাছে তাঁর প্রকৃত সন্তান কে? একজন সৃষ্টিশীল মানুষ ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে একে একে দুই হন। সৃষ্টিশীল শিল্পী দম্পতির মধ্যেও নিশ্চয়ই অন্য দশজন সাধারণ মানুষের মতো ঘর আলো করা ফুটফুটে এক মানবশিশুর আশা–আকাঙ্ক্ষা থাকে। কিন্তু প্রকৃত শিল্পীসত্তা সারাটা জীবন অর্থ নয়, কীর্তি নয়, স্বচ্ছলতা নয়, কামনা করে মনের আকাশে উড়ে বেড়ানোর জন্য কেবল দুটি পাখা। মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর ‘সামথিং লাইক অ্যান অটোবায়োগ্রাফি’ চলচ্চিত্রটিও শিল্পী দম্পতির সন্তান; তাই রূপক অর্থে দুটি সন্তান। একটি তাঁদের জৈবিক প্রবৃত্তিজাত অঙ্কুর রক্ত-মাংসের মানবশিশু, অন্যটি শিল্পীসত্তার সৃষ্টিজাত একটি সুন্দর চলচ্চিত্র।
প্রথমজনকে পৃথিবীতে আনতেই হবে, তেমন কোনো দায়বদ্ধতা শিল্পীর থাকতে পারে না। শিল্পী একা একা বা দুয়ে মিলেও সৃষ্টিসাগরে ভেসে জীবন কাটিয়ে দিতে পারেন। কিন্তু আমাদের এই সমাজব্যবস্থার মন–মানসিকতা এমনই যে আহারে, বিহারে, নিদ্রায়, পরিণয়ে, মৈথুনে, প্রজননে সবাই যেমন চলেন, জীবন কাটান, শিল্পীকেও তেমন কাটাতে হবে। অন্যথায়, বিয়ের বহু বছর পরও সন্তান না এলে, ঘরের রক্তের সম্পর্কের মানুষেরা পদে পদে মনে করিয়ে দেবেন, জাহান্নামের বাড়িতে যেখানে ফেরেশতা আসবে না, সেখানে আমি থাকব না। বাইরের দুনিয়ার শিল্পীর পোশাকি অনুরাগী বলে বসবেন, ‘বিয়ের দশ বছর পরও ম্যাডাম আপনার সন্তান এল না কেন?’
তালপাতার সেপাইয়ের মতো চেহারা, মুখে খোঁচা খোঁচা পাতলা দাড়ি নিয়েও এই ছবির যোগ্য নায়ক ফারুকী। তিশার টুনটুনি পাখির মতো চেহারা এই চলচ্চিত্রে নিজেকে ভাঙতে ভাঙতে মন-মনন-মেধাশক্তিকে পরিপূর্ণ লাবণ্যে ভাস্বর করে তুলেছে।
পুরুষের চেয়ে নারীকে এসব সমস্যার মুখোমুখি হতে হয় বেশি। যেভাবে এই চলচ্চিত্রের তিথি, বাস্তবের অভিনেত্রী নুসরাত ইমরোজ তিশাকেও মুখোমুখি হতে হয়েছে। তিথির বর ফারহান, মানে বাস্তবের এই চলচ্চিত্রের পরিচালক মোস্তফা সরয়ার ফারুকী কিন্তু তিশার পাশে থেকেছেন বরাবর। এক শিল্পী আরেক শিল্পীর মর্ম বোঝেন। শিল্পীর ব্যক্তিজীবনের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করেন। ঘরের বউ বলে তাঁকে শোকেসের পুতুল ভাবেন না। সন্তান জন্মদানের যন্ত্র ভাবেন না। ফারহান তাই তিথিকে বলে, ‘আমাদের বারো বছরের বিবাহিত জীবনে আমি কোনো দিন তোমাকে প্রেসার করেছি বাচ্চা নেওয়ার জন্য?’
তিশার কষ্টগুলোর সঙ্গে আমিও আমার মায়ের কষ্ট খুঁজে পাই। এই চলচ্চিত্র একটি আত্মজীবনীর অংশ। অনেকেই তাই নিজেদের ব্যক্তিজীবনের লড়াইয়ের সঙ্গে এর মিল-অমিল খুঁজে পাবেন। মা–বাবার বিয়ের পাঁচ বছর পর আমার জন্ম হয়েছিল। পরিবারের অনেক সদস্য আমার মাকে এ কারণে নানাভাবে হেনস্তা করেছেন। মা পূজার ঘটের জন্য আমের পল্লব তুলে আনতে গেলে কেউ বলেছেন, ‘যে গাছে ফল হয় না, সে গাছের পল্লব কাজে লাগে না!’ চাষিরা মাঠে যাওয়ার সময় পরিবারের একজন বলে বসেছেন, ‘মায়ের মুখ দেখে যেন কেউ মাঠে না যান! ফসল ফলবে না!’ এসব শুনে মা শুধু বুক ঠুকরে মুখ লুকিয়ে কাঁদতেন। আমার মায়ের মৃত্যুর পর বন্ধুসভায় প্রকাশিত ‘মায়ের কথা’ স্মৃতিচারণায় আমি কথাগুলো লিখেছিলাম।
আবার ঠিক জানি না, সন্তানধারণের সঙ্গে দাঁত তুলে ফেলার কী সম্পর্ক? চট্টগ্রামের তৎকালীন কোনো এক চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী শুধু আমাকে জন্ম দেওয়ার জন্যই মা নিজের দুপাটি দাঁত তুলে ফেলে কৃত্রিম দাঁত লাগিয়েছিলেন। এভাবে অনেক ত্যাগের মধ্য দিয়ে মা–বাবারা আমাদের পৃথিবীতে আনেন। কিন্তু আমরা সেই আত্মত্যাগ মনে রাখি না। এই চলচ্চিত্র সেসব কথাও মনে করিয়ে দেয়।
শুধু শিল্পীর স্বাধীনতার কারণে নয়, আজকের দিনে অনেক ব্যস্ত দম্পতি ক্যারিয়ারের জন্য সন্তান নিতে দেরি করেন। সে ক্ষেত্রে আবার শারীরিক নানাবিধ কারণে প্রজননের সমস্যা হয়। আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের অগ্রগতি সমাধানের পথও খুলে দিয়েছে। আমার ভাই ও ভ্রাতৃবধূ বিয়ের বেশ কিছু বছর পর নলজাত শিশুর জন্মদানের প্রক্রিয়ায় ফুটফুটে দুটি যমজ সন্তান লাভ করেছেন। চলচ্চিত্রের তিথিকেও দেখলাম নানাভাবে সন্তান জন্মদানের খোঁজখবর নিতে। চিকিৎসক তিথিকে বুঝিয়ে দিচ্ছে, ‘বায়োলজিক্যাল মা না হলে সন্তানের সঙ্গে চেহারা মিলবে না। স্বামীর শুক্রাণু অন্যের গর্ভের ডিম্বাণুতে প্রতিস্থাপন করলে, নিষেকের ফলে স্বামীর চেহারার সঙ্গে মিল আসবে। যে নারীর ডিম্বাণু নেওয়া হচ্ছে, তার চেহারা মিলবে। আর শিশুর স্বভাব–চরিত্র, আপনার কোলের শিশু, আপনি যেভাবে মানুষ করবেন, সেভাবেই তৈরি হবে। বায়োলজিক্যাল মা না হলেও আপনিই তার প্রকৃত মা।’
ঘরে-বাইরে সামাজিক, পারিবারিক, শারীরিক সব সমস্যার সঙ্গে লড়াই করে শেষ পর্যন্ত তিথি গর্ভবতী হলো। বেশ নাটকীয় ও আনন্দঘন মুহূর্তের সৃষ্টি করে ফারহানকে কর্মস্থল থেকে ডেকে এনে সেই খবর দিল। এই চলচ্চিত্রের দুটি অংশের মধ্যে এত দূর পর্যন্ত একটা অংশ।
টুকরো টুকরো একজনের আত্মজীবনীর সঙ্গে অনেকের আত্মজীবনী মিলে গিয়ে, দেশ-কাল-স্থান-পাত্রবিশেষে এই চলচ্চিত্র অক্ষরে অক্ষরে সবার ভাষা হয়ে উঠেছে।
একটি শিশুকে পৃথিবীতে আনার কথা ছিল, সে আসতে চলেছে। কিন্তু কোন পৃথিবীতে সে আসবে? মাতৃগর্ভের নিশ্চিত নিরাপত্তার ঘুমন্ত অন্ধকার পৃথিবী থেকে সে এবার আলোর পৃথিবীতে চোখ মেলে তাকাবে। কিন্তু আলোর পৃথিবীটা আসলে কতটা আলোকিত? নাকি চারদিকে ছেয়ে আছে অনিশ্চিত, নিরাপত্তাহীন প্রগাঢ় অন্ধকারের ছায়া? ছোট্ট শিশুর কর্ণকুহরে শব্দ প্রবেশের একটা মাত্রা আছে। যেকোনো মানুষেরই শব্দ গ্রহণের নির্দিষ্ট ক্ষমতা আছে। এর বেশি হয়ে গেলে কীভাবে টিকে থাকা যায়? এসবের উত্তর পরতে পরতে রয়েছে পরবর্তী অংশে। মন্থরগতির ঢিমেতালে জীবনের চালচিত্র এবার টান টান উত্তেজনায় দ্রুতগতিতে পাক খায়।
শিল্পীসত্তাও ক্ষমতার দ্বারা আক্রান্ত হয়, ক্ষমতার অলিন্দে ব্যক্তিমানুষের সত্তা যখন চাক্কি পিসিং এবং চাক্কি পিসিংয়ের মতো লাঞ্চিত হয়। কবি-শিল্পী মানেই তো শুধু একটা ভালো কবিতা লেখা, ছবি আঁকা, গান করা বা চলচ্চিত্র নির্মাণ নয়। কবিতায় বিবেকের কথা লেখা মানেই দায়সারা কিছু সাজানো শব্দের স্রোত নয়। যে শিল্পীর কথার সঙ্গে কাজের মিল থাকে না, তিনি যত বড় মাপের শিল্পীই হোন না কেন, মানুষের কাছে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা নষ্ট হয়ে যায়। সৌন্দর্যের স্রষ্টা শিল্পী। তাই সুন্দর পৃথিবীর সন্ধানে অন্যায় দেখলেই তিনি প্রতিবাদ করেন। আর এখান থেকেই শুরু হয় পেশাদার সমাজসেবী একশ্রেণির রাজনীতিবিদের সঙ্গে সংঘাত। তাদের বক্তব্য, ‘তোমার কাজ সিনেমা বানানো, তুমি সিনেমা বানিয়ে যাও। আমরা কী করছি, কী করতে চলেছি, তা নিয়ে কেন মাথাব্যথা?’
মেরুদণ্ড সোজা করে চলা আপসহীন পরিচালক ফারহান করোনাচলাকালীন রাজনীতিবিদের দুর্নীতি নিয়ে ফেসবুকে পোস্ট করেছিল। বাগে পেয়ে রাজনীতিবিদের ছেলে প্রভাবশালী পিতার সাহায্য নিয়ে পুলিশ–প্রশাসন–আইন–আদালত সবকিছু কাজে লাগিয়ে ফারহানকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে দেয়। রাজনীতিবিদের ছেলের মুখের অশ্লীল ভাষা আসলে ক্ষমতারই ভাষা। এরা মাঠে–ময়দানে জনদরদি বীর সেজে মধুর কোমল বক্তৃতা দেয়। অথচ অন্দরে–অন্তরে আস্ত এক একটা বদমায়েশ। ফারহানকেও মাথা নত করে তাই ক্ষমতার সঙ্গে আপস করতে হয়। মুচলেকা দিয়ে ক্ষমতার পায়ে ধরে ক্ষমা চাইতে হয়।
কবি মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়ের বিখ্যাত ‘জননী যন্ত্রণা’ কবিতার পঙ্ক্তি ‘জন্মে মুখে কান্না দিলে, দিলে ভাসান ভেলা/একূল-ওকূল দুকূল-মজা কালনাগিনীর দয়/জলকে দিলাম সাঁতার দিলাম ঢেউকে হেলাফেলা/ভয়কে দিলাম ভরাডুবি...কান্না আমার নয়।’ তিথি আর ফারহানের সৃষ্টিশীল সত্তাকে ঘরে–বাইরে হাজারো প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করে এভাবেই টিকে থাকতে হবে। মুখে সোনার চামচে মধু নিয়ে শিল্পীসত্তার জন্ম হয় না। ব্যক্তি তিথি আর ফারহান একক মানুষ নয়, এভাবেই প্রত্যেক ব্যক্তি শিল্পীসত্তার প্রতিনিধি হয়ে ওঠেন। তাঁদের সন্তানকেও এই পরিবেশে, সবকিছুর সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকতে হবে। সৃষ্টির যন্ত্রণা ও প্রতিফলন এভাবে অনাগত সুন্দর দিনের সন্ধানে হাঁটি হাঁটি পা পা করে এগিয়ে যাবে।
আত্মজীবনীর অংশ, আত্মজীবনীর মতো। হুবহু যে একজনের আত্মজীবনীর প্রতিফলন, তা হতে পারে, না–ও হতে পারে। টুকরো টুকরো একজনের আত্মজীবনীর সঙ্গে অনেকের আত্মজীবনী মিলে গিয়ে, দেশ-কাল-স্থান-পাত্রবিশেষে এই চলচ্চিত্র অক্ষরে অক্ষরে সবার ভাষা হয়ে উঠেছে।
চলচ্চিত্রের নায়ক হতে গেলে নায়কের মতো টান টান ত্বক, ত্বকের জেল্লা, সিক্স প্যাক, এইট প্যাক, এসব না থাকলেও চলে। মগজের বল থাকলে বাহুবলী হতে হয় না। তালপাতার সেপাইয়ের মতো চেহারা, মুখে খোঁচা খোঁচা পাতলা দাড়ি নিয়েও এই ছবির যোগ্য নায়ক ফারুকী। তিশার টুনটুনি পাখির মতো চেহারা এই চলচ্চিত্রে নিজেকে ভাঙতে ভাঙতে মন-মনন-মেধাশক্তিকে পরিপূর্ণ লাবণ্যে ভাস্বর করে তুলেছে। দুজনের কথাবার্তা শুনে মনে হয়েছে, সিনেমার সংলাপ নয়, এগুলো নিত্যদিনের যাপনের মতোই সহজ–সরল। একেবারে প্রচলিত সব ছক ভেঙে আত্মজীবনীর অংশ, চলমান জীবনযাত্রার মতোই। আবার আত্মজীবনীর সত্যের সামনে দাঁড়াতে গেলে, লুকোছাপার কোনো বিষয় থাকতে পারে না। ফারহানের মেয়েবন্ধু জুঁই, সশরীর উপস্থিত না থেকেও তাই সত্যকে প্রাণবন্ত করে। তিথির একসময়ের প্রেমিক তানভীর এসে মস্ত বড় সমস্যা থেকে তিথিকে উদ্ধার করে। ডলি জহুর, ইরেশ যাকের, ডিপজল প্রত্যেকেই অনবদ্য। পাভেল অরিনের সুর মন ছুঁয়ে যায়। কোমল সুরের মাধুরী মেশানো কোনো গান অবশ্যই ব্যবহার করা যেতে পারত।
অনাকাঙ্ক্ষিত শব্দের সন্ধানে বেরিয়ে শব্দবাজদের ছোবলে বন্দী হতে হয়েছিল চিত্র পরিচালককে। আশা করি এ ধরনের চলচ্চিত্রের বার্তা নবজাতকের জন্য শব্দদূষণমুক্ত, বায়ুদূষণমুক্ত, ক্ষমতা দূষণমুক্ত একটা সুন্দর পৃথিবীর সন্ধান এনে দেবে একদিন।
হাওড়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত