আগন্তুক

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
রাকিব মনে মনে দোয়া পড়ছে যেন কেউ না আসে। সে এই কাজ কোনোভাবেই করতে পারবে না। ভয়ে পুরো শরীর ঘেমে একাকার।

রাত দুইটা পঁয়তাল্লিশ মিনিট। হাসপাতাল থেকে বের হতে একটু দেরি হয়ে গেল। পকেটে একটা দশ টাকার নোট আর একটা পাঁচ টাকার কয়েন। আটটার দিকে বের হলে অবশ্য হাফ পাস হয়ে যেত। কিন্তু হাফ পাস তো পরের কথা, এত রাতে বাস কোথায় পাবে! রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে দুই চাকা আর তিন চাকার গাড়ি, ভাড়া এখন আকাশছোঁয়া। তাদের ধারেকাছেও ভেড়া যাবে না। বিকল্প একটাই পথ, নিজের পায়ের ওপর পূর্ণ ভরসা।

আকাশে আজ সুন্দর চাঁদ উঠেছে। রাস্তায় কোলাহল নেই। কয়েকটা কুকুর এদিক-সেদিক দৌড়াচ্ছে দল বেঁধে। মাঝেমধ্যে এক-দুইটা সিএনজি ভোঁ-গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। রাকিব মেইন রাস্তা ধরে হাঁটছে বাসার দিকে। গুনগুনিয়ে গাইছে ‘একলা প্রহরী হয়ে জেগে থাকব সারা রাত, চাঁদ যেন হয় না চুরি, হয় না যেন প্রভাত......।’ ভালোই লাগছে হাঁটতে। স্কুলজীবনে একটা মেয়েকে পছন্দ করত। তার কথা মনে পড়ছে এই মুহূর্তে। তখন সবে ক্লাস নাইনে পা দিয়েছে। মেয়েটার নাম তিশা। বিয়ে হয়ে গেছে আরও বছর পাঁচেক আগেই। সে নিজে তার বিয়ের নিমন্ত্রণ খেয়ে এসেছিল। উপহার হিসেবে নিজের টাকায় কেনা একটা শাড়িও দিয়েছিল। বিয়ের দিন কান্নাভেজা চোখ দেখে মনে হয়েছিল, সে তার জন্যই হয়তো কান্না করছিল। কিন্তু তারপর আর দেখা হয়নি কখনো। ভুলেই গিয়েছে এখন তার সেই মুখটা, না পাওয়ার দুঃখটা।

‘এই এদিকে আয়’।
‘কে ডাকে?’ রাকিব তার অতীত থেকে এক চমকায় ফিরে আসে বাস্তবে।
একটু অন্ধকার রাস্তার পাশটা। জায়গাটা একেবারে জনশূন্য।
ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে জনা চারেক লোক বসে আছে। হাতে সিগারেট। দেখে খুব একটা সুবিধার মনে হচ্ছে না। মধ্যবয়সী চার যুবক।
দূরত্ব এত কম যে পালানোরও উপায় নেই। অবশ্য তার খুব একটা চিন্তাও নেই। পকেটে পনেরো টাকা। আর একটা ভাঙা মুঠোফোন। এটুকুই সম্বল।
রাকিব তাদের সামনে এসে দাঁড়াল।
একজন ভারী গলায় বলল, ‘যা আছে বের কর।’
‘আপনারা আসলে ভুল মানুষকে ধরেছেন, আমার কাছে টাকা নেই দেখেই হেঁটে বাসায় ফিরছিলাম।’
একজন উঠে এসে বলল, ‘চুপ থাক। হাত ওপরে তোল’ বলেই পকেটে হাত ঢুকিয়ে দিল।

অনেক খোঁজাখুঁজির পর দশ টাকার নোট আর পাঁচ টাকার কয়েন এবং একটা ভাঙা মুঠোফোন ছাড়া সত্যিই কিছু খুঁজে পেল না। একজন ভারী গলায় বলল,
‘যাবি কই?’
‘মিরপুর ১০’
‘যেহেতু তোর কাছে টাকা নাই। তুই আমাদের সঙ্গে আজ ছিনতাই করবি। তোর ভাড়ার টাকা জোগাড় করতে পারলেই তোর ছুটি।’
‘কি-ন-তু।’তোতলাতে তোতলাতে রাকিব আরও কিছু বলতে যাবে, সেই মুহূর্তে লোকটা তাকে আটকে দিল হাতের ছোরাটা দেখিয়ে।
‘এ নিয়ে বাড়তি কোনো কথা শুনতে চাই না। কাজে লেগে যা।’

রাকিব মাথা নিচু করে চুপচাপ তাদের সঙ্গে বসে আছে। দৌড়ে পালানোর সাহসটাও পাচ্ছে না। দৌড়ে সে অল্পেই হাঁপিয়ে যায়। তারাও আবার কী করে বসে তারও ঠিক নেই। তার চেয়ে তাদের কথা শোনাই এখন নিরাপদ মনে হচ্ছে।
নেতাগোছের লোকটা একজনকে ছিনতাই করার প্রাথমিক কৌশল শিখিয়ে দিতে বলল রাকিবকে। রাকিব সেসবের কিছুই বুঝল না। সে পাথরের মূর্তির মতো বসে রইল। আর লোকটার কথা শুনে মাথা নাড়াল।

যে যার মতো বসে আছে। সবার অপেক্ষা একজন মানুষের জন্য। রাকিব মনে মনে দোয়া পড়ছে যেন কেউ না আসে। সে এই কাজ কোনোভাবেই করতে পারবে না। ভয়ে পুরো শরীর ঘেমে একাকার। দূর থেকে এক আগন্তুককে দেখা গেল এদিকেই আসছে। সবাইকে তৈরি হতে নির্দেশ দিল নেতাগোছের লোকটা। রাকিবের হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেছে পুরোপুরি। তার হাতেও একটা চাকু তুলে দিয়েছে একজন। যতই কাছাকাছি আসছে, রাকিবের ততই হার্টবিট বাড়ছে। গরমের মধ্যে লোকটা একটা চাদর মুড়ি দিয়ে আছে। তাদের দেখার পর লোকটা চিৎকার করে বলে ওঠে, ‘সব শালাকে গুলি কর। একটাকেও জীবিত ছাড়বি না। ফায়ার, ফায়ার।’ আচমকা এমন আচরণে পুলিশ ভেবে সবাই ছন্নছাড়া হয়ে যে যার মতো দৌড়ে পালায়।

রাকিবের হুঁশ ফিরে মিনিট বিশেক পর। চোখ খুলে সে বুঝতে পারে কেউ তাকে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে মেইন রাস্তা ধরে। যে লোকটা বয়ে নিয়ে যাচ্ছে সে বিড়বিড় করে গাইছে, ‘তীরহারা এই ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দিব রে...।’ রাকিব এবার নড়েচড়ে ওঠে। অস্পষ্ট স্বরে তাকে নামাতে বলে। লোকটা তাকে ঘাড় থেকে নামায় আস্তে করে। ‘কমান্ডার আপনি ঠিক আছেন? পাক শিবির থেকে আপনাকে উদ্ধার করে নিয়ে এসেছি।’ রাকিবের আস্তে আস্তে সব মনে পরে। লোকটার দিকে তাকিয়ে মনে মনে ভাবে, ছিনতাইকারীর থেকে অন্তত পাগল ভালো আছে। দুজনে মিলে তারপর হাঁটা দেয় মিরপুরের দিকে। লোকটা বিড়বিড় করে একা একা গাইতে থাকে, ‘তীরহারা এই ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দিব রে...।’

সদর, নেত্রকোনা