ছোটবেলা থেকে একেক জনের একেক রকমের শখ থাকে। মফস্সলের দিকে যাঁদের বেড়ে ওঠা, তাঁদের শখ মূলত খাতায় লেখা ওই প্যারাগ্রাফের মতো বাগান করা ছাড়া অন্য কিছু খুব কমই থাকে। আর পরিবার যদি কনজারভেটিভ হয়, সে ক্ষেত্রে অন্য কিছু কল্পনা করাও মুশকিল। বিশেষ করে মেয়েদের জন্য, একটা ‘না, না’ পরিস্থিতির মধ্যেই তাঁদের বেড়ে ওঠা। কিন্তু এত কিছুর পরও অনেকে সব শিকল ছিঁড়ে কখনো ভেসেছে সাগরে, কখনো হারিয়েছে পাহাড়ের গহিনে আবার কখনো গিয়েছে দ্বীপবাসে; মেঘকন্যা হয়ে রাজত্ব করেছে মেঘেদের দেশে।
তেমনই একজন আশরাফী জাহান মিতু। ভৈরব বন্ধুসভার এই বন্ধু এমবিএ করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকিং অ্যান্ড ইনস্যুরেন্স বিভাগে। পাশাপাশি এক্সপ্লোরেশন নামের একটি ভ্রমণ গ্রুপ আছে তাঁর। নিজেই গ্রুপটির সিইও।
ভ্রমণের পোকা
নানু ছিলেন ভ্রমণপ্রেমী। একদিন সকালবেলা নানুর ডাকে ঘুম ভাঙে মিতুর, ‘এই ঘুরতে যাবি? গেলে এখনই ওঠ।’ একবাক্যে রাজি হয়ে সোজা ব্যাগ গুছিয়ে নানু-নানার সঙ্গে রাঙামাটি এবং সেখান থেকে কক্সবাজার। ছোটবেলায় পরিবারের সঙ্গে অনেক ঘুরলেও বড় হওয়ার পর সেটাই ছিল প্রথম ভ্রমণ। সেখানে প্রকৃতিকে ঠিকভাবে উপলব্ধি করতে শেখা। ঘোরাঘুরির নেশাটা মাথায় এঁটে যায় ভালো করে। উত্তরসূরি হিসেবে যে নানুর প্রতিনিধিত্ব করবেন, সেটা টের পান।
অন্ধকার দেখা
মাথার মধ্যে ঘুরতে যাওয়ার প্রবল ইচ্ছা; কিন্তু সুযোগ হচ্ছিল না কোনোভাবেই। এরই মধ্যে আবৃত্তি সংগঠন থেকে কয়েকজন মেয়ে মিলে খাগড়াছড়ি ঘুরতে যাওয়ার কথা। বাড়িতে যেহেতু রাজি করানো যাবে না, তাই মিতু তিন দিন পর্যন্ত নানুর পিছু পিছু ঘুরেছেন অনুমতির জন্য। কিন্তু বিধিবাম। তাঁর এককথা, ‘এখন যাওয়ার দরকার নেই। হয় আমাদের সঙ্গে যাবি, না হয় বিয়ের পর জামাইয়ের সঙ্গে।’
কোনোভাবেই কথার নড়চড় করানো গেল না। ফলস্বরূপ ভ্রমণে যাওয়ার সিদ্ধান্ত বাতিল।
অগত্যা মধুসূদন
আগেরবার ভ্রমণে যেতে না পারার দাগ মন থেকে মুছে যাওয়ার আগেই আবৃত্তি সংগঠন থেকে আবার নতুন জায়গায় ভ্রমণের প্রস্তুতি চলছিল। যেহেতু অনুমতি পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই, সেখানে ব্যর্থ প্রচেষ্টা আর করা হলো না। বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ আছে বলে বের হয়েই এক দৌড়ে নোয়াখালীর নিঝুম দ্বীপ। তারপর একই পদ্ধতিতে কয়েক মাস পর আবার সেই গ্রুপের সঙ্গে চম্পট দিয়েছেন নেত্রকোনার বিরিশিরিতে। সম্মুখীন হয়েছেন নতুন নতুন অভিজ্ঞতার।
হাটে হাঁড়ি ভাঙা
ঘুরে এসেছেন, ধরা পরবেন না, এমনটা কি আর হয়! মাসখানেক পর ভ্রমণে যাওয়ার খবর ফাঁস হলো। এ নিয়ে বাড়িতে এলাহি কাণ্ড! সেই সঙ্গে নানু বাসায় আসার নিষেধাজ্ঞা জারি। নানু রাগে মাস দুয়েক কথাও বন্ধ রেখেছেন। বুঝিয়েছেন, যাতে আর এমন না করে। তবে বালির বাঁধ ভেঙে গেলে কি আর তা জোড়া নেয়? সুনীলের সেই কবিতার মতো, কেউ কথা রাখেনি; তাই মিতুও রাখেননি।
দলবল
মাথার মধ্যে ঘুরতে যাওয়ার নেশাটা আবার তীব্র হয়েছে। মাথার মধ্যে সেঁটে গিয়েছে, ‘আমাকে ঘুরতেই হবে’। ক্যাম্পাসে সহপাঠীদের সঙ্গে পরিকল্পনাও করেছেন অনেকবার। কিন্তু পরিকল্পনার মধ্যেই সবকিছু সীমাবদ্ধ, যাওয়া আর হচ্ছিল না কোথাও। একদিন পরীক্ষা বাতিল হলো এবং সেদিনই কয়েকজন মিলে হুটহাট ব্যাগ গুছিয়ে বেরিয়ে গেলেন চাঁদের আলোয়। গন্তব্য রাতের শেষ ট্রেনে শেষ স্টেশন। স্টেশনটি ছিল চট্টগ্রাম। সবাই মিলে ঘুরে শেষ করল চট্টগ্রাম ও আশপাশের শহরগুলো।
রথ দেখা ও কলা বেচা
এসব লুকোচুরির মধ্যেই মিতুর নানু না-ফেরার দেশে পাড়ি জমান। তাঁর অপূরণীয় ইচ্ছা পুরোপুরি তাঁর মধ্যে ভর করে যে গোটা বিশ্ব ভ্রমণ করবে। স্থায়ী সমাধান হিসেবে একদিন বন্ধুদের সহায়তায় খুলে ফেলেন একটা ট্র্যাভেল গ্রুপ। বাসায় অনেক কষ্টে বোঝানো হলো, এটা এখন তাঁর দায়িত্ব। তাঁরা ভ্রমণপিপাসুদের ঘুরতে নিয়ে যাবেন। সেখান থেকে ভালো একটা আয়ও হবে। মিতুর জেদের কাছে হার মানতে বাধ্য হয়ে ছাড়পত্র দিল পরিবার। সেখান থেকে পুরোদমে ঘুরাঘুরির যাত্রা শুরু। কখনো পাহাড়, কখনো সমুদ্র, কখনো ঝরনা, কখনোবা হাওরে কিংবা বনে-জঙ্গলে। পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে চলছে ঘোরাঘুরি। ইতিমধ্যে ঘোরা হয়ে গেছে দেশের অর্ধেকের বেশি জেলা।
শাড়িতে নারী
ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে, আর বাঙালি নারী মনে হয় শাড়ি পরে। তাজিংডং, কেওক্রাডং, আমিয়াখুম, নাফাখুম, ধুপপানির মতো দুষ্কর জায়গাগুলোতেও শাড়ির ভাঁজে ভ্রমণের গল্প নিয়ে ফিরেছেন। নেশার কাছে হার মেনেছে দানবের মতো সুউচ্চ পাহাড়। স্মৃতির পাতায় জমে আছে জুমঘরে আড্ডা এবং আদিবাসীদের মাচাংঘরে রাত্রিযাপন!
সাবেক সহসভাপতি, ড্যাফোডিল বন্ধুসভা