পাঠকের জন্য তাঁর ঋণ কেউ শোধ করতে পারবে না

হুমায়ূন আহমেদ, ছবি: নাসির আলী মামুন, ফটোজিয়াম

ঘড়ির কাঁটা ১১টার ঘরে মিলিত হতে চলেছে। ২০১২ সালের ১৯ জুলাই। টিভিতে ব্রেকিং নিউজ কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের জীবন সংকটাপন্ন। নিউজটা দেখে বুক কেঁপে উঠল। রমজান মাস, ভোররাতে সাহ্‌রি খেতে হবে ভেবে রাত ১১টায় বিছানায় চলে যাই। ঘুম আসছে না। বসে থাকলাম টিভির সামনে। রাত ১১টা ৪০ মিনিট, চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে আসছিল। যুক্তরাষ্ট্রের ম্যানহাটনের বেলভ্যু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন লেখক হুমায়ূন আহমেদ না ফেরার দেশে চলে গেলেন। বিশ্বাস হচ্ছিল না। চোখ দুটো ভিজে গেছে। যেন খুব কাছের কেউ চিরতরে চলে গেলেন। যুক্তরাষ্ট্র থেকে কেমোথেরাপি দেওয়ার পর মাস দুয়েক আগে দেশে এসেছিলেন লেখক হুমায়ূন। মা মাটির টানে। নুহাশ পল্লীতে সাংবাদিকদের দেওয়া কয়েকটা সাক্ষাৎকার দেখেছিলাম। দেখে মনে হচ্ছিল না যে প্রিয় লেখকের শরীরে কোলন ক্যানসার বাসা বেঁধেছে। কত প্রাণবন্ত হয়ে, হেসে আড্ডায় নানা বিষয় নিয়ে গল্প করছিলেন। মাঝেমধ্যে ছুটে যাচ্ছেন লীলাবতী দিঘির পাড়ে, কখনো নিজ হাতে লাগানো গাছের কাছে। বৃক্ষের গায়ে হাত দিয়ে বলছে—‘এই তোরা কেমন আছিস? তোদের নিজের হাতে লাগিয়েছি। আজ তোরা এত বড় হয়েছিস, তার মূলে কিন্তু আমি। আমাকে হ্যালো বল।’ ঝাউগাছগুলো নাকি তাদের ভাষায় হ্যালো বলে!

ছোট ভাই মামুনের সঙ্গে ঝগড়া করে খুব মন খারাপ হয়েছিল, কিছুতে রাগ কমছিল না। পুকুরে গিয়ে গলা সমান পানিতে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলাম। দরজা বন্ধ করে হামাগুড়ি দিতে লাগলাম। হামাগুড়ি দিতে গিয়ে আম্মার চোখে ধরা পড়লাম। জিন–ভূতের বাতাস লেগেছে ভেবে আম্মা আমাকে হুজুর এনে ঝাড়ফুঁক করালেন। হুজুর তো সেদিন আমাকে দিগম্বর করে আমগাছের ঢালপালা দিয়ে ইচ্ছামতো পেটালেন। গলায় বড় একটা তাবিজ ঝুলানো হলো।

সাক্ষাৎকার দেখে মনে করেছিলাম হুমায়ূন আহমেদ সুস্থ হয়ে উঠবেন। লিখবেন পাঠকদের জন্য। হিমুকে নিয়ে, নয়তো মিসির আলিকে নিয়ে। হাসপাতালে চিকিৎসার সময়ে প্রথম আলোতে বেশ কয়েকটা লেখা পড়েছিলাম, নিউইয়র্কের আকাশে ঝকঝকে রোদ। কত চমৎকার সহজ–সরল ভাষায় লিখতেন। সহজ কথা সহজ ভাষায় বলতে পারতেন। স্কুলবেলা থেকে হুমায়ুন আহমেদের ভক্ত ছিলাম, তাঁর ভূত নিয়ে লেখা এমন কোনো বই নেই যে পড়িনি। ‘মিসির আলি’, ‘হিমু’, ‘সমুদ্র বিলাস’, ‘জোছনা জননীর গল্প’, ‘জোছনা রাতে সবাই গেছে বনে’, ‘শুভ্র’, ‘অমানুষ’, ‘এপিটাফ’, ‘বলপয়েন্ট’—আরও কত মজার মজার উপন্যাস ও গল্প।

জোছনা জননীর গল্পের বই পড়ে কেঁদেছিলাম। এ যেন মুক্তিযুদ্ধের এক জীবন্ত দলিল। বইটিতে এমনভাবে মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাগুলো তুলে ধরেছেন, মনে হচ্ছে যেন চোখের সামনে ঘটছে সব ঘটনা। বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানিদের অত্যাচার, রাজাকাররা তাদের কীভাবে সহযোগিতা করেছে, গণহত্যার প্রতিটি ঘটনা এমনভাবে উপস্থাপন করেছেন; যেন এইমাত্র ঘটল। শরীরের পশম খাড়া হয়ে উঠত ঘৃণায়। তিনি লেখা ও নাটকের মধ্যে মধ্যবিত্ত মানুষের জীবন নিয়ে এমনভাবে লিখতেন, যেন চোখের সামনে খেলা করছে।

গাজীপুরের নুহাশ পল্লীতে স্ত্রী ও কন্যার সঙ্গে লেখক
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

এই তো সেদিন গ্রীষ্মের ছুটিতে ঢাকা থেকে বাড়ি এসে সংগ্রহের বইগুলো বুকশেলফ থেকে বের করে রোদের মধ্যে শুকিয়ে আবার সারি সারি করে সাজিয়ে রেখেছিলাম। সংগ্রহে সবচেয়ে বেশি আছে হুমায়ূন আহমেদের বই। ভ্রমণে বের হলে দু–একটা সঙ্গে নিয়ে যেতাম। খুব মনে পড়ে, সবচেয়ে বেশি মজা পেয়েছিলাম বৃষ্টি আর জোছনা নিয়ে লেখা উপন্যাসগুলো।

প্রকৃতিকে ভালোবাসতে শিখেছি হুমায়ূন আহমেদের বই পড়ে। গভীর রাতে ছাদে উঠে জোছনা উপভোগ করা কিংবা বৃষ্টিতে ভেজা প্রিয়জনকে কদম ফুল উপহার দেওয়া। গল্পের মাধ্যমে তরুণ প্রজন্মকে প্রকৃতি কীভাবে উপভোগ করতে হয় লেখক হুমায়ূন আহমেদ শিখিয়েছেন। স্কুলবেলায় হুমায়ূন আহমেদের মজার একটা উপন্যাস পড়েছিলাম। ওই গল্পের নায়ক মন খারাপ হলে পুকুরে গিয়ে গলা সমান পানিতে দাঁড়িয়ে থাকতেন কিংবা কক্ষের দরজা বন্ধ করে হামাগুড়ি দিতেন। উনার বই পড়ে নিজে নিজে হাসতাম। আম্মা জানালার ফটক দিয়ে দেখতেন। ছোট ভাই মামুনের সঙ্গে ঝগড়া করে খুব মন খারাপ হয়েছিল, কিছুতে রাগ কমছিল না। পুকুরে গিয়ে গলা সমান পানিতে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলাম। দরজা বন্ধ করে হামাগুড়ি দিতে লাগলাম। হামাগুড়ি দিতে গিয়ে আম্মার চোখে ধরা পড়লাম। জিন–ভূতের বাতাস লেগেছে ভেবে আম্মা আমাকে হুজুর এনে ঝাড়ফুঁক করালেন। হুজুর তো সেদিন আমাকে দিগম্বর করে আমগাছের ঢালপালা দিয়ে ইচ্ছামতো পেটালেন। গলায় বড় একটা তাবিজ ঝুলানো হলো। আম্মাকে বললাম, আমার জিন-ভূতের বাতাস লাগেনি। আমি হুমায়ূন আহমেদের বইয়ে পড়েছি, মন খারাপ হলে গলা সমান পানিতে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় কিংবা হামাগুড়ি দিলে মন ভালো যায়। এটা পরীক্ষা করে দেখছিলাম।

লেখক যেদিন মারা গেলেন, যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী চট্টাগ্রাম বন্ধুসভার বন্ধু মিহির হুমায়ূন আহমেদের প্রথম জানাজার ছবি পাঠালেন। জানাজার সময় ঝুমবৃষ্টি নেমেছিল নিউইয়র্ক শহরে। ছাতা হাতে কেউবা রেইনকোট পরে জানাজায় অংশ নিয়েছিল। কফিনে শুয়ে আছে প্রিয় লেখক, যেন বৃষ্টিতে ভিজছে। হাজার হাজার প্রবাসী বাঙালি দাঁড়িয়ে আছে প্রিয় লেখককে শ্রদ্ধা জানাতে।

লেখকের মরদেহ মাতৃভূমিতে ফিরল দুই দিন পর। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে মানুষের ঢল, ফুলের বৃষ্টি বর্ষিত হলো কফিনের ওপর। প্রিয় লেখকের জন্য এত ভালোবাসা! এত শ্রদ্ধা! জানাজায় অংশগ্রহণ করার জন্য অফিস থেকে বের হলাম। প্রতিজ্ঞা করলাম, যে করে হোক প্রিয় লেখকের কফিনটা স্পর্শ করা চাই। জাতীয় ঈদগাহ ময়দানে মানুষের ঢল দেখে অবাক হলাম। জীবনে সবচেয়ে বড় এবং স্মরণীয় জানাজায় অংশ নিলাম। লেখকের ছেলে নুহাশ হুমায়ুন মাইক্রোফোনে ঘোষণা দিল, ‘প্লিজ, আমার বাবাকে সবাই মাফ করে দেবেন। কেউ কোনো পাওনা থাকলে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন।’ মনে মনে বললাম, হুমায়ূন আহমেদ যা দিয়ে গেছে, দেশের লাখো কোটি ভক্ত আর পাঠকের জন্য তাঁর ঋণ কেউ শোধ করতে পারবে না। তিনি হাজার বছর ধরে বেঁচে থাকবেন পাঠকের হৃদয়ের মণিকোঠায়। জানাজা শেষে কফিনের কাছে ছুটে গেলাম। এত ভিড়? অনেক ধাক্কাধাক্কি করে একসময় কফিন যেদিকে নিয়ে যাবে, সেদিকে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম। বহু প্রতীক্ষার পর কফিন স্পর্শ করলাম। প্রিয় লেখকের কফিনে আমার হাত। শরীরের লোম দাঁড়িয়ে গেল। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি শুরু হলো। কফিনে বৃষ্টিভেজা হাতের স্পর্শ লেগে রইল। শুভ্র বর্ণের বৃষ্টিভেজা কফিনটি গাড়িতে যখন উঠানো হলো, বৃষ্টির মধ্যে আমিও কাঁদতে লাগলাম। জানি আমার কান্না কেউ দেখছে না, কিন্তু প্রিয় লেখক ঠিকই দেখছিল। মনে হচ্ছিল, মিসির আলির কোনো এক অদৃশ্য হাতের স্পর্শ আমার মাথায় রেখে বলছেন, ‘কেঁদো না বাবা! মনে রেখো, পৃথিবীতে ফিনিক ফোটা জোছনা আসবে। শ্রাবণ মাসে টিনের চালে বৃষ্টির সেতার বাজবে। সেই অলৌকিক সংগীত শোনার জন্য আমি থাকব না। কোনো মানে হয়!’ ফুলসজ্জিত বৃষ্টিভেজা কফিনবাহী গাড়িটি ছুটে চলেছে গাজীপুরের নুহাশ পল্লীর উদ্দেশে।

বন্ধু, চট্টগ্রাম বন্ধুসভা