সেই চিঠি পড়ার আর সাহস পাইনি। ছিঁড়ে ছুড়ে ফেলে এসেছি লেকের পানিতে। আর পাঞ্জাবিটা সেদিনই দিয়ে এসেছিলাম উদ্যানের এক ভবঘুরে লোককে।
ঘর থেকে বের হয়েছি রোদঝলমলে আকাশ দেখে। বের না হতেই ঝুম বৃষ্টি! এমন বৃষ্টি যে থামার কোনো নাম নেই।
একটি রাইড শেয়ারিং অ্যাপে কল করে রেইন কোটসহ মোটরসাইকেল সুবিধা পেলাম। কোনোমতে মোটরসাইকেলে চড়ে কিছুদূর যেতেই টের পাই শার্ট, প্যান্ট ভিজে পানি সারা শরীর ভিজিয়ে দিয়েছে। বাইক থামিয়ে একটা ওভারব্রিজের নিচে আশ্রয় নিই। রেইন কোট খুলে দেখি সত্যিই ভিজে গেছি।
মোটরসাইকেলের বিল পরিশোধ করে ওভারব্রিজের নিচে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি কমার অপেক্ষায়। ফোন চেক করে দেখি ১৮টি মিসড কল! বৃষ্টির কারণে ফোন ধরতে পারিনি। ব্যাপারটা স্বাভাবিক। কিন্তু ফোনদাতা যখন প্রেমিকা, তখন আর ব্যাপারটা স্বাভাবিক থাকে না।
১৮টি মিসড কল! সবে সাবালক হলো কলের সংখ্যা, আর আমি নাবালকের মতো কাঁদছি!
কান্না করছি দেখে অনেকেই হয়তো হাসবেন, কিন্তু আমি জানি কেন কান্না করছি। এ নিয়ে পঞ্চমবার এবং শেষবার দীর্ঘক্ষণ তার ফোন রিসিভ করতে পারিনি। কথা দিয়েছিলাম, আর কোনো দিন তিনবারের বেশি কল ধরতে ব্যর্থ হলে বিচ্ছেদ। পৃথিবীর আর কারও জন্য সহজ না হলেও তার জন্য এই সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ। আমি জানি সে কতটা কঠিন কথা রাখার ব্যাপারে।
ভাবছি আর কান্না করছি। বৃষ্টি আরও বেশি গতি নিয়ে তীব্রভাবে ঝরছে। আমার চোখেও নোনাজলের ঘোলা পানি নির্গত হচ্ছে। সাহস পাচ্ছি না ফোন দিতে। দিলেও ধরবে না। তা–ও চেষ্টা করছি। একবার, দুইবার, তিনবার...অসংখ্যবার! কোনোভাবেই তাকে ফোনে পাচ্ছি না।
ফোন বন্ধ হলে কীভাবে জানতে পারব, সে কী করছে, কোথায় আছে, কী সিদ্ধান্ত নিয়েছে আমার ব্যাপারে!
দুশ্চিন্তায় কাকভেজা অসহায় প্রেমিক মন নিয়ে সংসদ ভবনের কাছে চন্দ্রিমা উদ্যান লেকে চলে গেলাম। যেখানে আমাদের দেখা করার কথা; সেখানে একটি নীল পাঞ্জাবি ও একটি চিঠি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একজন শিশু ফুল বিক্রেতা।
আমাকে দেখামাত্রই ফোকলা দাঁতে হাসি দিয়ে পাঞ্জাবি আর চিঠি দিয়ে বলল—‘স্যার, আফায় কইছে আফনেরে দিতে! আফনের ছবি দেখাইয়া আমারে দুইশ ট্যাহা বকশিশ দিয়া এহানেই বইয়া থাকতে কইছে।
কেরানীগঞ্জের এত বৃষ্টি আর বিজয় সরণিতে ঝলমলে রোদ দেখে, চন্দ্রিমা উদ্যানে প্রেমিকাহীন নীল পাঞ্জাবি আর চিঠি পেয়ে বোঝার বাকি রইল না আমার বিচ্ছেদ হলো! তিন বছরের চাওয়া-পাওয়ার অবসান হলো একপশলা বৃষ্টিতে।
তুমুল বৃষ্টিতে মানুষের মনে কত রোমান্স খেলা করে, কতশত আলপনা তারা কল্পনায় আঁকে। আমার বেলায় হলো উল্টো।
সেই চিঠি পড়ার আর সাহস পাইনি। ছিঁড়ে ছুড়ে ফেলে এসেছি লেকের পানিতে। আর পাঞ্জাবিটা সেদিনই দিয়ে এসেছিলাম উদ্যানের এক ভবঘুরে লোককে।
তারপর কোনো দিন তার সঙ্গে কোনোভাবেই যোগাযোগ করতে পারিনি। তিন বছরে কোনো দিনও তার বাসার ঠিকানা জানতে চাইনি। ফোনই ছিল যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম। সেদিনের পর কোনো দিন আর ফোনকল আসেনি আমার ফোনে। আমিও খুঁজে পাইনি তাকে কোথাও।
আজও বৃষ্টি হলে আকাশপানে চেয়ে থাকি। আজও কাঁদি, বৃষ্টি হলেই চোখের কার্নিশ বেয়ে ঝরে পড়া নোনাজলে ভাসাই চরাচর। খুঁজে ফিরি চেনা দুটি চোখ, চেনা প্রিয় মুখ, কী করে অচেনা হলো হঠাৎ বৃষ্টিতে।
এত দিন পর জানতে ইচ্ছে করে কী লেখা ছিল সেই চিঠিতে। না পড়া চিঠিতে কি সত্যিই বিচ্ছেদ ছিল, নাকি আরেকটা সুযোগ ছিল কাছে থাকার, ভালোবাসার।
সভাপতি, কেরানীগঞ্জ বন্ধুসভা