আমাদের বন্ধুত্ব

উর্মি ত্রিপুরার সঙ্গে লেখকছবি: সংগৃহীত

বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের শুরুর দিকে সহপাঠীদের সঙ্গে তোলা অধিকাংশ ছবিতেই আমি ও উর্মি ত্রিপুরা একে অপরের ঘা ঘেঁষে দাঁড়াতাম। তখনো আমাদের বন্ধুত্ব গড়ে ওঠেনি। তাই কখনো খেয়াল করা হয়নি। কথাও খুব একটা হতো না, কেবল ক্লাসে দেখা হতো।
একটা সময় ওর মেসে উঠি। একই বিভাগের হওয়ায় নানা বিষয় নিয়ে কথা বলা শুরু হয়। এভাবেই ধীরে ধীরে আমাদের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে।

ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীদের খাবারদাবার ও সংস্কৃতি নিয়ে আমার আগে থেকেই অনেক আগ্রহ ছিল। উর্মির সঙ্গে বন্ধুত্ব হওয়ার পর এসব বিষয়ে জানার কৌতূহল আরও বেড়ে যায়। ওদের এলাকার বাঁশ কোঁড়লের কথা আমি বড় আপুর মুখে প্রথম শুনি। তখন আমি ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। উর্মির সঙ্গে পরিচয়ের পর ওকে বাঁশ কোঁড়লের কথা বলি। একদিন সে এটা রান্না করে আমায় খাওয়ায়। ওদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরিয়ে দেয়। দুজনে মিলে অনেক ছবি তুলি।
সেসব ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করার পর থেকে ক্যাম্পাসের অনেকেই আমাকে ত্রিপুরা বলে সম্বোধন করত। সবাই মনে করেছিল, ক্লাসে যে একজন ত্রিপুরা মেয়ে আছে, সেটা আমি! পরে অবশ্য জানতে পারে আমি তন্বী।

এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শুরুর সময়টা পারিবারিক বিভিন্ন সমস্যার কারণে খুব একটা উপভোগ করতে পারছিলাম না। খুব সহজে কারও সঙ্গে শেয়ারও করতে পারি না। কিছুটা চুপচাপ থাকতাম। উর্মি এসব কীভাবে যেন বুঝে যেত! অনেকটা জোর করে আমার কাছ থেকে সবকিছু শুনে নিত। আমার চেহারা দেখেই বলে দিতে পারে, মনে কী চলছে।

একদিন উর্মি বায়না ধরল, আমাকে ওর বাসায় নিয়ে যাবে, পরিবারের সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবে। আমারও যাওয়ার খুব ইচ্ছে। কিন্তু মাথায় আবার অন্য চিন্তা। আমার বাসা থেকে যাওয়ার অনুমতি দেবে তো! এমনিতেই প্রথমবারের মতো বাসা থেকে এতদূর এসে থাকছি, একা একা চলাফেরা করছি। এখন যদি এ কথা বলি, তখন ভাববে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে পা বড় হয়ে যাচ্ছে! এসব চিন্তায় সে যাত্রায় আর যাওয়া হয়ে ওঠেনি।

এবারের পূজার ছুটিতে বাড়ি গিয়ে কোনো এক কথার ফাঁকে সাহস করে বলে ফেলি, উর্মির বাসায় যেতে চাই। চোখেমুখে ইতস্তত ভাব দেখে বড় আপু বলে, ‘উর্মির বাসায় যাবি, এটা আবার এভাবে বলতে হবে কেন। ইচ্ছে হলে যাবি।’ গত চার বছরে যতবারই বাড়ি গেছি, প্রতিবার আমার গল্পের বিশাল একটা অংশ জুড়ে থাকত উর্মি। তাই আমার পরিবারের সবাই ওর কথা জানে। আপত্তি করেনি এ জন্যই।

অনুমতি পেয়েই বান্ধবীকে মেসেজ করে জানিয়ে দিই, তোর বাসায় যেতে আর কোনো বাধা নেই। ছুটি শেষে দুজনই ক্যাম্পাসে ফিরি। ক্লাসও শুরু হয়। এর মধ্যে একটা সমস্যার কারণে হঠাৎই একাডেমিক কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। এই ফাঁকে উর্মির বাসায় চলে গেলাম। ওর বাসার সবাই আমাকে এত সহজে আপন করে নিল যে একটিবারের জন্যও মনে হয়নি, তাঁদের সঙ্গে এটাই আমার প্রথম সাক্ষাৎ।

সেখানে দুই দিন ছিলাম। উর্মি ও তাঁর ভাইবোনেরা আমাকে ঠান্ডা ছড়া, আলুটিলা গুহা, রিসাং ঝরনাসহ বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে নিয়ে যায়। ত্রিপুরাদের একটি বিয়েতেও যাওয়ার সুযোগ হয়। একদিকে ঘোরাঘুরি, অন্যদিকে বাসায় মাসিদের আতিথেয়েতা—সবকিছু মিলিয়ে খাগড়াছড়িতে আমার স্বপ্নের মতো সময় কেটেছে।
ফেরার সময় একটা কথাই বারবার মনে হয়েছে। বন্ধুত্বের কোনো সংজ্ঞা নেই। এটা জাতি, ধর্ম-বর্ণ সবকিছুর ঊর্ধ্বে। আমাদের এই বন্ধন অটুট থাকুক সব সময়।

শিক্ষার্থী, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়