উপস্থাপনা বা প্রেজেন্টেশন একটি শিল্প ও দক্ষতার মিশ্রণ, যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিশ্রম ও অভিজ্ঞতার মাধ্যমে উন্নত হতে পারে। একজন ভালো উপস্থাপক কেবল তাঁর বক্তব্য পরিষ্কারভাবে উপস্থাপন করেন না, বরং তিনি দর্শকদের মনোযোগ আকর্ষণ, তাঁদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন এবং মঞ্চে নিজের উপস্থিতি দিয়ে অনুষ্ঠানের পরিবেশ তৈরি করেন। উপস্থাপনা প্রথমে সহজ মনে হলেও এটি অনেক দিক থেকে চ্যালেঞ্জিং। তবে কিছু নির্দিষ্ট দক্ষতা এবং টিপস অনুসরণ করলে আপনি একজন দক্ষ ও সফল উপস্থাপক হতে পারবেন। এখানে কিছু টিপস দেওয়া হলো, যেগুলো অনুসরণ করলে আপনি আপনার উপস্থাপনাকে আরও ভালো করতে পারবেন।
ভালো প্রস্তুতি
একজন ভালো উপস্থাপক হওয়ার প্রথম ধাপ হলো প্রস্তুতি। সঠিক প্রস্তুতি ছাড়া কোনো অনুষ্ঠান সফলভাবে উপস্থাপন করা সম্ভব নয়। আপনি যে বিষয়টি উপস্থাপন করতে যাচ্ছেন, সেটির প্রতি সম্পূর্ণ ধারণা ও প্রস্তুতি থাকতে হবে। এতে আপনি যেকোনো প্রশ্ন বা পরিস্থিতি সামলাতে পারবেন। প্রস্তুতি কেবল আপনার বক্তব্য পড়া বা মনে করা নয়, বরং অনুষ্ঠানটির প্রবাহ, সময়সীমা, দর্শক সেশন এবং অন্য গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলোরও প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে।
টিপস:
* যে বিষয়টি উপস্থাপন করতে যাচ্ছেন, সেটির ওপর গভীরভাবে গবেষণা করুন।
* মঞ্চের পরিবেশ, প্রযুক্তি, সময়সীমা ইত্যাদি নিয়ে চিন্তা করুন।
* আপনি যেসব তথ্য ব্যবহার করবেন, সেগুলো সঠিক এবং যথাযথভাবে উপস্থাপন করুন।
বিশ্বাস ও আত্মবিশ্বাস
একজন উপস্থাপক হিসেবে আত্মবিশ্বাস খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মঞ্চে উঠে বক্তব্য উপস্থাপন করার সময় যদি আপনি আত্মবিশ্বাসী না হন, তাহলে দর্শকদের মধ্যে অনিশ্চয়তা তৈরি হতে পারে। তাই নিজেকে বিশ্বাস করতে শিখুন এবং সঠিক প্রস্তুতির মাধ্যমে আত্মবিশ্বাস অর্জন করুন। যখন জানবেন যে আপনি প্রস্তুত, তখন দৃঢ়ভাবে বলতে পারবেন এবং তা দর্শকদের কাছে পরিষ্কারভাবে পৌঁছাবে।
টিপস:
* মঞ্চে দাঁড়ানোর আগে কয়েকবার অনুশীলন করুন।
* আয়নার সামনে বা বন্ধুদের সামনে নিজেকে উপস্থাপন করে আত্মবিশ্বাস অর্জন করুন।
* ভুল হলে ভয় পাবেন না, এটা স্বাভাবিক। ভুলগুলোকে গ্রহণ করুন এবং সামলে নিন।
ভাষা ও কথার শৈলী
একজন ভালো উপস্থাপক তাঁর ভাষা ও কথার শৈলী দিয়ে দর্শকদের মন্ত্রমুগ্ধ করে ফেলেন। উপস্থাপকের ভাষা সুষম ও পরিষ্কার হতে হবে, যাতে দর্শকেরা সহজেই বুঝতে পারেন। অত্যধিক জটিল শব্দ বা টেকনিক্যাল টার্ম ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকুন। কথার শৈলী সরল, সহজ ও সুন্দর হতে হবে।
টিপস:
* সাবলীল ও সরল ভাষায় কথা বলুন।
* কথা বলার সময় ধীরগতি বজায় রাখুন, যাতে সবাই বুঝতে পারে।
* সংলাপের মধ্যে হাস্যরসের জোগান দিন, যা পরিবেশকে আনন্দময় করে তোলে।
শারীরিক ভাষা
শরীরের ভাষা বা বডি ল্যাঙ্গুয়েজ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। শরীরের ভাষা আপনার বক্তৃতার সমর্থন বা বিরোধিতা করতে পারে। একদম স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে থাকা, কম চোখে চোখ রাখা, অথবা বিরক্তিকর ভঙ্গি দর্শকদের প্রতি নেতিবাচক বার্তা প্রেরণ করতে পারে। অন্যদিকে সঠিক শরীরের ভাষা যেমন চোখে চোখ রেখে কথা বলা, হাতের সঙ্গে এক্সপ্রেশন ব্যবহার করা, উপস্থাপনা জীবন্ত এবং আকর্ষণীয় করে তোলে।
টিপস:
* মঞ্চে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে স্বাভাবিক ও আত্মবিশ্বাসী হয়ে।
* হাতের ব্যবহার, মুখাবয়ব ও চোখের যোগাযোগের মাধ্যমে দর্শকদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করুন।
* মঞ্চে চলাফেরা করুন, কিন্তু অতিরিক্ত মুভমেন্ট থেকে বিরত থাকুন।
দর্শকদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন
একজন ভালো উপস্থাপক কেবল নিজের বক্তব্য উপস্থাপন করেন না, বরং দর্শকদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে অনুষ্ঠানকে প্রাণবন্ত করে তোলেন। দর্শকদের মনোযোগ আকর্ষণ করা এবং তাদের সঙ্গে একটি সম্পর্ক গড়ে তোলা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিটি উপস্থাপনা যেন একটি কথোপকথনের মতো মনে হয়, যেখানে উপস্থাপক ও দর্শকদের মধ্যে সেতু তৈরি হয়।
টিপস:
* প্রশ্নোত্তর সেশন রাখুন, যা দর্শকদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াবে।
* হাস্যরস বা উদাহরণের মাধ্যমে দর্শকদের মনোযোগ আকর্ষণ করুন।
* উপস্থিত দর্শকদের দিকে তাকিয়ে তাদের প্রতি আগ্রহ দেখান এবং অনুভূতির প্রতি সচেতন থাকুন।
সময়ের প্রতি সচেতনতা
একজন ভালো উপস্থাপক সময়ের প্রতি সচেতন থাকে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি করতে হবে। সময়ের অভাব হলে অনুষ্ঠানটি মুষ্টিমেয় হতে পারে, অথবা অতিরিক্ত সময় নিলে দর্শকেরা বিরক্ত হয়ে যেতে পারেন। তাই সময়ের ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
টিপস:
* উপস্থাপনার সময় নির্ধারণ করুন এবং সময়মতো সেটা শেষ করার চেষ্টা করুন।
* অনুষ্ঠানে সম্ভাব্য প্রশ্নের উত্তর দেওয়া কিংবা দর্শকদের সঙ্গে আলোচনা করার জন্যও সময় বরাদ্দ রাখুন।
* স্লাইড বা টেমপ্লেট ব্যবহার করলে, তাদের প্রদর্শন সঠিক সময় মেনে করুন।
প্রতিক্রিয়া গ্রহণ এবং ক্রমেই ভালো করা
প্রতিটি অনুষ্ঠানের পর, নিজের কাজের ওপর প্রতিক্রিয়া গ্রহণ করা গুরুত্বপূর্ণ। নিজের উপস্থাপনাকে মূল্যায়ন করা এবং যেখানে উন্নতির সুযোগ আছে, সেই জায়গাগুলোতে কাজ করা একজন সফল উপস্থাপকের মূল চাবিকাঠি। সবার কাছ থেকে প্রতিক্রিয়া গ্রহণ করতে শিখুন, তবে সমালোচনার মধ্যে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি রাখতে হবে।
টিপস:
* বন্ধুবান্ধব, সহকর্মী বা সহপাঠীদের কাছ থেকে প্রতিক্রিয়া নিন।
* আপনার উপস্থাপনা নিয়ে সংশয় থাকলে নিজেকে সময় দিন এবং তাতে আত্মবিশ্বাসী হয়ে কাজ করুন।
* প্রতিটি অনুষ্ঠানের পর নিজেকে মূল্যায়ন করুন এবং তা থেকে শিক্ষা নিয়ে পরবর্তী অনুষ্ঠানে আরও উন্নতি করুন।
একজন ভালো উপস্থাপক হতে হলে শুধু কৌশলই যথেষ্ট নয়, এর জন্য প্রয়োজন আত্মবিশ্বাস, দৃঢ় মনোভাব এবং প্রস্তুতির যথাযথ পরিকল্পনা। আমি ৭০টির বেশি অনুষ্ঠান উপস্থাপন করেছি, দক্ষতাগুলো অর্জনের চেষ্টা করেছি এবং এখনো করছি। সঠিক প্রস্তুতি, সঠিক মনোভাব এবং প্রতিনিয়ত নিজেকে শাণিত করে উপস্থাপনা দক্ষতা অর্জন করতে হবে।
আপনি যদি উপস্থাপনায় আগ্রহী হন, তবে শিখুন, অনুশীলন করুন এবং উপস্থাপনার প্রতি আপনার ভালোবাসা বজায় রাখুন। কারণ, এর মধ্যেই রয়েছে এক স্বপ্নময় সফলতার চাবিকাঠি।
প্রশিক্ষণ সম্পাদক, ঢাকা মহানগর বন্ধুসভা এবং শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়