বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যাশা, প্রাপ্তি, স্বপ্ন, স্বপ্নভঙ্গের বেদনা, এত রক্তের বিনিময়ে পাওয়া স্বাধীন একটা দেশের সামাজিক অবক্ষয়ের যন্ত্রণা নিয়ে ১৯৭৪ সালে নারায়ণ ঘোষ মিতা বানিয়েছিলেন ‘আলোর মিছিল’ নামের চলচ্চিত্র। সেই চলচ্চিত্রে ‘আলো’ চরিত্রে অভিনয় করেন ববিতা।
পরের বছরই লড়াই করে অধিকার আদায়ের ভিন্ন এক গল্প দাঁড় করান পরিচালক মিতা। ১৯৭৫ সালে মুক্তি পাওয়া তাঁর যথেষ্ট সাড়া জাগানো একটি চলচ্চিত্র ‘লাঠিয়াল’। এই চলচ্চিত্রেও অন্য অনেকের সঙ্গে ভিন্ন রূপে আমরা পেলাম ববিতাকে।
নদীর এপাড় ভাঙে, ওপাড় গড়ে। সর্বনাশী পদ্মার করাল স্রোত কত মানুষকে সর্বহারা, সর্বস্বান্ত করেছে। প্রিয়জনকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। পদ্মার গর্ভে ঘরবাড়ি, জমিজমা হারিয়ে মানুষ উদ্বাস্তু হয়েছে। সময়ের ব্যবধানে আবার চর জেগে উঠেছে। কিন্তু এই চর দখলের লড়াইয়ে বরাবরই সামন্ততান্ত্রিক প্রভু, সমাজের জমিদার, জোতদার, মাতব্বররা মুখিয়ে থাকেন। নিজেদের ক্ষমতা প্রয়োগ করে তাঁরা দখল করে নিতে চান সবকিছু। যাঁদের জমি, তাঁদের ক্ষমতা থাকে না এসব হাঙরের মতো জমিদারের বিরুদ্ধে লড়াই করার। নদী–উপকূলবর্তী গ্রামবাংলার চিরায়ত এ সমস্যা উঠে আসে মিতার ‘লাঠিয়াল’ চলচ্চিত্রে। ‘লাঠিয়াল’ চলচ্চিত্রের গল্প বুনেছেন শেখ ফজলুর রহমান ও জহিরুল হক।
লাঠিখেলা গ্রামবাংলার চিরাচরিত সংস্কৃতির একটি অংশ। শুধু খেলা দেখানো নয়, লাঠি দিয়ে আত্মরক্ষা, সমাজ রক্ষা, অধিকার রক্ষার লড়াইও চালিয়ে এসেছেন বঙ্গের লাঠিয়ালেরা। ব্রিটিশ সরকারের শক্তিশালী অস্ত্রের সামনে দাঁড়িয়ে বাঁশের কেল্লা বেঁধে লড়াই করেছিলেন তিতুমীর। কবি দিনেশ দাস লিখেছেন, ‘বেয়নেট হোক যত ধারালো, কাস্তেটা ধার দিয়ো, বন্ধু’। প্রান্তিক মানুষের জীবনযাপন, লড়াইয়ের ময়দানে যুগবাহিত চাঁদ হলো কাস্তে। লাঠিয়ালদের লাঠিও সেই কাস্তের সমতুল্য। ‘লাঠিয়াল’ চলচ্চিত্রেও আমরা দেখলাম, চর দখল করতে আসা মাতব্বরের বন্দুকের নল হার মানল কাদের লাঠিয়ালের তীক্ষ্ণ-সুচালো সঠিক নিশানার লাঠি-মুখের কাছে। এই লাঠ্যৌষধি কেবল একজন অত্যাচারী মাতব্বরকেই শায়েস্থা করে না, মাৎস্যন্যায়ের বিরুদ্ধে সাহস জোগানোর বার্তাও দিয়ে যায়।
যদিও কাদের লাঠিয়াল চরিত্রে আনোয়ার হোসেন ছিল গ্রামের মাতব্বরের একান্ত ঘনিষ্ঠ অনুচর। সারা জীবন মাতব্বরের নুন খেয়ে গুন গেয়ে এসেছে। মাতব্বর কাদেরকে নিজের লাঠি হিসেবে ব্যবহার করে অন্যের জমি দখল করেছে। টাকা ধার দিয়ে ফেরত দিতে না পারলে চাষের বলদ, খেতের ফসল তুলে নিয়ে এসেছে। লাঠিয়াল কাদের; বংশানুক্রমিক লাঠি খেলা তার রক্তে। চর দখলের খবর এলে বুকের ভেতর মাতম লাগে, রক্তে আগুন ধরে যায়। অন্যায় ভাবে তাই মাতব্বরের কাজে দিনের পর দিন ব্যবহৃত হয়ে এসেছে।
লাঠিয়ালের ভাই আবার গায়েন। আপন মনে বাঁশি বাজায়। যাত্রাদলে অভিনয় করে বেড়ায়। একজন শিল্পীর চরিত্রে ফারুক প্রকৃতই একজন অভিনয়শিল্পী। যে বাঁশ দিয়ে বাঁশি হয়, সেই বাঁশ দিয়েই হয় লাঠি। দুই ভাই প্রকৃত অর্থে এক বাঁশেরই দুই রূপক চরিত্র।
ওপারে নদীর চর জেগে ওঠে। এপার থেকে ছিন্নমূল হয়ে যাওয়া ওপারের মানুষের মনে নতুন করে জমি পাওয়ার আশা জাগে। মাতব্বর জানতে পারামাত্র বরাবরের মতোই কাদেরকে হাতিয়ার করে। কাদের দলবল নিয়ে চর দখল করতে ছোটে।
কিন্তু গায়েন দুখু কখনোই গান, যাত্রাপালা ছেড়ে হাতে লাঠি ধরতে চায় না। লাঠিয়াল কাদের তাকে বারবার পরামর্শ দেয়, এসব নাটক, যাত্রাপালা না করে লাঠি ধরতে। কাদের লাঠিয়ালের বউ মানে দুখুর ভাবির চরিত্রে রোজী আফসারী আবার দুই ভাইয়ের কোনো কাজই পছন্দ করে না। সে চায়, নিজেদের জমি চাষ করে দুই ভাই সংসারী হোক।
মাতা যশোধা যেভাবে বালক কৃষ্ণকে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখত, ভাবিও বাউন্ডুলে গায়েন দেবরকে একদিন দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখে। কিন্তু দেশ, গ্রাম পাড়া চড়ানো ছেলেটি কি আর হৃদয়ের অর্গল, স্নেহের বন্ধনে আবদ্ধ থাকে? দড়ি খুলে ঠিক পালায়। দুই ভাইয়ের কাউকেই সংসারী করতে না পেরে গৃহিণীর মন খারাপ হয়।
গায়েন দুখু ভালোবাসে গ্রামের বানুকে। বানুও দুখুকে পছন্দ করে। বানু চরিত্রে ববিতা ফারুকের সঙ্গে সুন্দর অভিনয় করে যান। দুখু গাছতলায় মহড়া করতে করতে বানুকে দেখতে পেলে সংলাপ ভুলে যায়। যাত্রাপালা সাঙ্গ করে সখীর ডাকে পেছনপানে ছোটে। সখীকে শাপলা ফুল তুলে দেয়।
কড়া মেজাজের লাঠিয়াল কাদেরের বুকের ভেতরও সুপ্ত ভালোবাসা আছে। মাতব্বরের কাছে টাকা পেলে সে বউয়ের জন্য কোমরের বিছা কিনে আনে। বউকে বলে, ‘তোমাকে দেখতে দিঘির শাপলার মতো লাগে।’ মাতব্বরের ছেলে মকবুল শহর থেকে গ্রামে এসে বানুকে দেখে নানাভাবে উত্ত্যক্ত করতে শুরু করে। একদিন নির্জনে একা পেয়ে বানুর ওপর মকবুল পড়ে ঝাঁপিয়ে, দুখু তাকে শায়েস্থা করে।
মাতব্বরের ছেলের গায়ে হাত তোলার অপরাধে ভুল বুঝে কাদের দুখুকে মারতে শুরু করে। মনের দুঃখে দুখু বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। নদীর অন্য কূলে গিয়ে অন্য এক ছিন্নমূল পরিবারে আশ্রয় পায়। বানুর সঙ্গে অবশ্য মাঝেমধ্যে দেখা করতে আসে। ভাবির সঙ্গেও নদীর কূলে দেখা হয়।
মাতব্বর নিজের ছেলের সঙ্গে বানুর বিয়ের প্রস্তাব দেয়। দরিদ্র কন্যার বাবা তৎক্ষণাৎ রাজি হয়ে যায়। এই অসৎ লোকের হাত থেকে বাঁচতে, বানু দুখুর ভাবির সাহায্য চায়। লাঠিয়াল কাদের কিন্তু কিছুতেই নেমকহারামি করবে না। মকবুলের সঙ্গে বানুর বিয়ের সম্বন্ধ ভাঙতে সে রাজি নয়।
ওপারে নদীর চর জেগে ওঠে। এপার থেকে ছিন্নমূল হয়ে যাওয়া ওপারের মানুষের মনে নতুন করে জমি পাওয়ার আশা জাগে। মাতব্বর জানতে পারামাত্র বরাবরের মতোই কাদেরকে হাতিয়ার করে। কাদের দলবল নিয়ে চর দখল করতে ছোটে।
দুখুর হাতের বাঁশি আর বুকের গান তখন লাঠি আর আগুন হয়ে ওঠে। লাঠি ধরবে না ধরবে না করেও সময়ে তাকে লাঠি ধরতে হয়। ছিন্নমূল দরিদ্র মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে জমি উদ্ধারে সে ঝাঁপিয়ে পড়ে। চরের মানুষকে সংগঠিত করে। শুরু হয় কাদেরের সঙ্গে দুখুর, ভাইয়ের সঙ্গে ভাইয়ের লড়াই। কাদের দুখুকে প্রস্তাব দেয়, তার দলে ভিড়ে যেতে। দুখু প্রত্যাখ্যান করে। জীবন দেবে, তবু জমি দেবে না। যে মানুষ মাতব্বরের কথায় অন্যের জমি দখল করে, অন্যের হক ফসল ছিনিয়ে নেয়, অন্যায়ের সঙ্গে আপস করে, শিল্পী দুখু নিজের ভাই হলেও কিছুতেই তার পাশে থাকবে না। শুরু হয় দুই ভাইয়ের লাঠালাঠি, জেগে ওঠা চরে নতুন মুক্তিযুদ্ধ।
ভাবি বিয়ের আসর থেকে বানুকে তুলে নিয়ে পালিয়ে আসে যুদ্ধের ময়দানে। কাদেরের লাঠির ঘা তার মাথায় এসে পড়ে। রক্তাক্ত, তবু সে চায়, ভাইয়ে ভাইয়ে লড়াই বন্ধ হোক। সহযোদ্ধার মৃত্যু দুখুকে কাতর করে তোলে। মরতে মরতেও তারা বলে যায়, ভাইয়ে ভাইয়ে লড়াই কোরো না। দুখু ভাইয়ের কাছে আত্মসমর্পণ করে। ভাইয়ের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়ে বলে, ‘নাও, আমাকে মারো।’
এই চলচ্চিত্র শুধু অধিকার আদায়ের লড়াই দেখায় না। লড়াইয়ের ময়দানে জীবন বাজি রেখে শক্তিশালী অন্য একটি অস্ত্র অহিংসার কথাও বলে। কাদের লাঠিয়ালের বিবেক জেগে ওঠে। সে এত বছরের ক্রোধ, জেদ, অহং, আগুন ত্যাগ করে অস্ত্র ফেলে দেয়। চোখের জলে ভাইকে বুকে টেনে নেয়। মাতব্বর বন্দুক তাক করে মারতে এলে লাঠির নিশানায় যোগ্য জবাব দেয়। এভাবেই দুষ্টের দমন এবং অত্যাচারীর পরাজয় হয়। বরাবরের পরাজিত ছিন্নমূল মানুষের জয় হয়। লড়াইয়ের ময়দানে মিলনের ধ্বনি, বানুর সঙ্গে দুখুর বিয়ের বাদ্য বেজে ওঠে।
এই চলচ্চিত্রে গাজী মাজহারুল আনোয়ারের লেখা এবং সত্য সাহার সুর করা প্রতিটি গান মনে ধরে। ফারুকের অনবদ্য অভিনয়ে নৃত্যভঙ্গিমার চপল ছন্দে গানগুলো প্রাণ পায়। লাঠি আর বাঁশির জাদুতে অধিকার আদায় করে দেখায় লাঠিয়াল। লাঠিয়াল আনোয়ার হোসেনও বঙ্গদর্শনের লাঠিয়ালদের চিরকালের প্রতীকী চরিত্র হিসেবে বেঁচে থাকবেন।
হাওড়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত