ভ্রুণ

অলংকরণ: আরাফাত করিম
শফিক গদিতে বসে টাকার হিসাব করছিল। কাউসারের কথায় উঠে গিয়ে একটা ব্যাগ নিয়ে এল। ব্যাগটা কাউসারের দিকে এগিয়ে দিল। সে ব্যাগটা খুলে জিনিসপত্র দেখে নিল। ব্যাগের ভেতর থেকে টিপের একটা পাতা বের করে বলল, ‘শফিক ভাই, এইটা কী করছেন! কালো টিপের পাতা কেন দিছেন!  লাল টিপ দেন, বিবাহের দিনে সে কি কালো টিপ পরতে পারে!’

বৃষ্টি থেমেছে কিছুক্ষণ হলো। কাদায় রাস্তা মাখামাখি। রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের বেশির ভাগ লাইট জ্বলে না। অন্ধকারে কাদা ছিটিয়ে সবাই বাড়ির দিকে ছুটছে। আকাশে মেঘ আবার ডাকতে শুরু করেছে। শফিকের কসমেটিকসের দোকানের একটা শাটার বন্ধ। আরেকটার অর্ধেক নামানো। ভেতরে টিমটিমে বাল্বের আলো জ্বলতে দেখা যায়। কাউসার প্রায় দৌড়ে দোকানের ভেতরে ঢুকল। তাড়াহুড়ায় আরেকটু হলে শাটারের সঙ্গে গুঁতা খেত।
‘যাক! তাও দোকান বন্ধ করেন নাই! আমি তো ভাবছি দোকান বন্ধ, আপনার বাড়ির ওপর যাইতে হবে।’
‘তোমার স্বভাব তো আমি জানি, বাড়িঘর মান না, একবারে গিয়া নাকের ডগায় হাজির হও। সেই জন্যই এত রাইতেও বইসা আছি।’
‘খুব ভালা করছেন শফিক ভাই। আল্লাহ আপনার নেক হায়াত বাড়াইয়া দিক। অহন আমার জিনিসগুলান দেন, নিয়া বিদায় হই।’

শফিক গদিতে বসে টাকার হিসাব করছিল। কাউসারের কথায় উঠে গিয়ে একটা ব্যাগ নিয়ে এল। ব্যাগটা কাউসারের দিকে এগিয়ে দিল। সে ব্যাগটা খুলে জিনিসপত্র দেখে নিল। ব্যাগের ভেতর থেকে টিপের একটা পাতা বের করে বলল, ‘শফিক ভাই, এইটা কী করছেন! কালো টিপের পাতা কেন দিছেন!  লাল টিপ দেন, বিবাহের দিনে সে কি কালো টিপ পরতে পারে!’
শফিক এক পাতা টুকটুকে লাল টিপ বের করে কাউসারের হাতে দিয়ে বললেন, ‘বিবাহ? কার বিবাহ?’
‘জ্বে আমার! একটা মাইয়া পছন্দ হইছে। আগামী সপ্তাহের মধ্যেই ইনশা আল্লাহ বিবাহ কইরা ফেলব। অতি সুন্দরী মাইয়া, থুতনির নিচে তিল।’
‘বল কি! মাইয়ার বাসা কোথায়? বাবার নাম কি?’
‘শফিক ভাই, মাইয়ার পরিচয় দিতে পারব না। হিজলপুরের পীর সাহেবের নিষেধ আছে, আমি তার কথা ফেলতে পারব না। বিবাহের পরে দুইজন একসঙ্গে আপনার দোকানে আসব। কাজল তার খুবই পছন্দ, কাজল কিনতে আসব! আজ আমি আসি।’
‘আসি মানে? টাকা কই? এতগুলো জিনিস হিসাব কইরা বুইঝা নিলা, আর টাকার হিসাব থাকে না!’ ‘শফিক ভাই, বিবাহের প্রচুর খরচাপাতি। আপনি তো জানেন। এইবারের মতো খাতায় লিখা রাখেন। আমি বেতন পাওনের সঙ্গে সঙ্গে আপনার টাকা আগে দিয়ে যাব। বেতন পাওয়ার পরে, আপনারে টাকা না দিয়ে যদি আমি একটা চাউলের দানাও মুখে দিই, তাহলে আমি জারজ সন্তান।’ বলেই এক ছুটে দোকান থেকে বেরিয়ে গেল কাউসার। শফিক একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে গদির ওপর ছড়ানো কাগজপত্র গোছাতে লাগল।

বাড়ির দরজার সামনে এসে কিছুক্ষণ থামল কাউসার। ভেতর থেকে বিকট সুরে হিন্দি সিনেমার গান ভেসে আসছে, সঙ্গে ঘুঙুরের শব্দ। মাঝেমধ্যে মাতাল পুরুষের কাতর উচ্ছ্বাস ভেসে আসছে গানের সুরের পাশাপাশি। আজ তবে আবার আসর বসেছে? শায়লা কি তবে আজকেও...? এই শরীর নিয়ে নাচবে? কিছুতেই না। আর সাত-পাঁচ না ভেবে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল কাউসার। সামনের বড় বারান্দাটা আজ ফাঁকা। অন্যদিন ওখানেই তিন-চারজন বসে থাকে। মাঝখানে বসে মাসি। পানের বাটা থাকে সামনে। তাদের অট্টহাসির শব্দে বারান্দা থেকে শুরু করে পুরো বাড়ি বোঁ বোঁ করে। আজ সেই হাসির কলরব নেই। বারান্দা বিরান মরুভূমি। তবে শব্দ আছে। সেই হাসির শব্দের সঙ্গে আছে গান, সুর, উচ্ছ্বাস, গোঙানি এবং আরও অনেক শব্দ। শব্দ আসছে আজ জলসা ঘর থেকে। কাউসার ভালো করে লক্ষ করে দেখল, বারান্দার কোনায় একটা মেয়ে বসে আছে, গোলাপি। পায়ে ঘুঙুর বাঁধা, সেটাতেই কি যেন সমস্যা হয়েছে। বসে বসে ঠিক করছে। কিন্তু শায়লা কোথায়? জলসা ঘরে? ওর দোতলার ঘরের দিকে একবার দেখে নিয়েছে কাউসার। অন্ধকার! দরজাটা বাইরে থেকে লাগানো। বাড়ির উঠোন থেকে দাঁড়িয়ে স্পষ্ট দেখা যায় ওর ঘর। কিন্তু তার বিশ্বাস হচ্ছে না। এই শরীর নিয়ে সে আসরে গেল? কী করে! গোলাপিকে জিজ্ঞেস করবে? কিন্তু গোলাপি...

কিছুক্ষণ স্থির দাঁড়িয়ে থাকে কাউসার। তারপর এক ঝটকায় সবটা সংকোচ ঝেড়ে ফেলে গোলাপির সামনে গিয়ে দাঁড়ায়, ‘গোলাপি! শায়লা কি আসরে গেছে?’
গোলাপি মাথা নিচু করে ঘুঙুর ঠিক করছিল। কাউসারের কথা শুনে একবার ঘাড় ঘুরিয়ে তার দিকে দেখল। তারপর আবার নিজের মতো করে ঘুঙুর নিয়ে পড়ল। কাউসারের কথার কোনো উত্তর দিল না। উত্তর না পেয়ে কথাটা আবার বলল সে। এবার গোলাপি একটা মুখ ঝামটা দিয়ে বলল, ‘তোমার নাং কোতায় গেচে, তা আমি কি করে কই! আমি তো তার দাসীবাঁদি না।’
‘তুমি জলসা ঘরে ছিলে না?’
‘ছিলেম। কিন্তু সেকেনে আর কে আচে, তা কইতে পারি নে।’
কাউসার মনে মনে বিশ্রি একটা গালি দিয়ে প্রায় দৌড়ে জলসা ঘরের দিকে যাচ্ছিল। গোলাপি কী মনে করে পেছন থেকে ডাকল। ডাক শুনে কাউসার থমকে দাঁড়ায়।
‘কোতায় যাচ্ছ দৌড়ে? ও ঘরে তোমায় আজ ঢুকতে দেবে? বড় শহর থেকে বাবু এসেছে। সব্বাইকে নিয়ে জলসা বসিয়েছে। আজ অন্য কোনো বাবুকে ওকেনে ঢুকতে দেবে না।’

ফ্যানের সুইচটা দিয়ে খাটের ওপর আরাম করে বসল। বেশিক্ষণ বসতে হলো না। মিনিট কয়েকের মধ্যেই শায়লা এসে হাজির। একটা সস্তা লেহেঙ্গা, পায়ে ঘুঙুর, মুখে একটু কি যেন রঙের মতো, গালে জরি চিকচিক করছে, ঠোঁটে গাঢ় লাল লিপস্টিক। কাউসারকে দেখে ফিক করে একবার হেসে উঠল।

কাউসার স্থির দাঁড়িয়ে রইল। গোলাপির দিকে পেছন ফিরে। তার হাত-পা কেমন যেন একটু অবশ হয়ে আসতে শুরু করল। পা মাটিতে আটকে ধরেছে। গোলাপি ততক্ষণে তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে, কাউসার খেয়াল করেনি। আসলে তার খেয়াল কোথায় যেন খুঁইয়ে গেছে। গোলাপি ডান হাত বাড়িয়ে তার চিবুকটা একটুখানি তুলে ধরল, ‘কী এমন পেয়েছ ওর মধ্যে? এই যে এত এত মুখঝামটা দেয়, তারপরেও কেন আসো? কিসের জন্য? একেনে পুরুষ হলো গিয়ে ঈশ্বর। তার ইশারার আগে সবটা হয়ে যায় একেনে। পুরুষরা মেজাজ দেকাবে, আমরা সেই মেজাজ সেকেনে তুমি কেন রোজ রোজ এসে মেজাজ দেকো?’
কাউসার উত্তর দেয় না। সে যেন কিছু শুনতেই পায়নি। এত তীব্র শব্দ, এত তীক্ষ্ণ আর ঝাঁজালো কথা, গোলাপি বলতে গিয়ে নিজেই চোখে জল এনে ফেলেছে। তবু যেন কাউসার শুনতেই পায়নি। গোলাপি আবার বলে, ‘তোমায় দেখে আমার বড় মায়া হয় গো, বড় মায়া হয়.. ’
কথা শেষ করতে পারে না গোলাপি, তার আগেই কাউসার সেখান থেকে চলে যায়। দোতালার বাঁ দিকের একেবারে শেষের ঘরটাতে। শায়লার ঘর। কাউসার শব্দ করে দরজার খিল খুলে অনায়াসে ভেতরে ঢুকে যায়। যেন সে ঘরের কর্তা। সারাদিন উপার্জনের ঘানি টেনে মাত্র ঘরে ঢুকল। বউ যেন পাশের বাড়ির মেয়েটার সঙ্গে গল্প করতে গেছে, সে ঘরে ফিরে বউকে দেখতে না পেয়ে চটে গেছে।

ফ্যানের সুইচটা দিয়ে খাটের ওপর আরাম করে বসল। বেশিক্ষণ বসতে হলো না। মিনিট কয়েকের মধ্যেই শায়লা এসে হাজির। একটা সস্তা লেহেঙ্গা, পায়ে ঘুঙুর, মুখে একটু কি যেন রঙের মতো, গালে জরি চিকচিক করছে, ঠোঁটে গাঢ় লাল লিপস্টিক। কাউসারকে দেখে ফিক করে একবার হেসে উঠল। তারপর বলল, ‘আপনি এইখানে কী করেন?’
‘তুমি নাচতে গেছিলা কেন?’
‘ওমা! নাচুম না কেন! নাচনেওয়ালী নাচব না তো কী করব!’
কাউসারের কান রাগে ক্রমশ লাল হয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে ঠাশ করে যদি সামনে দাঁড়ানো মেয়েটার গালে টেনে একটা চড় বসিয়ে দিতে পারত, তবে রাগ হয়তো কিছুটা কমে যেত। কিন্তু সেই সাধ্য তার নেই। পরম করুণাময় সেই শক্তি তাকে দেয়নি। কোনোমতে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে বলল, ‘তোমার শরীরের এই অবস্থা, তোমার না হোক বাচ্চাটার কথা তো অন্তত...’
এবার যেন শায়লারও পারদ চড়ল। বলল, ‘এই শুয়োরের বাচ্চা! কিসের বাচ্চা! আমার পেটে কোনো বাচ্চা নাই। তোরে কই নাই সে কথা? বাচ্চা আমি ফালায়া দিছি।’
‘কেন শুধু শুধু মিথ্যা কথা বল?’
‘কিসের মিছা রে! আমি তোর মতো বিনা পয়সায় রঙ্গ করি না। আমি যা কইতাছি তাই। বাচ্চা আমি ফালায়া দিছি।’

কাউসার যেন এবার ভাঙল। এতক্ষণ যে শক্ত, কঠিন এক মানুষ শায়লার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল সে যেন বাতাসের এক দমকায় পুরো অন্য মানুষ হয়ে গেল। নরম এক মানুষ। হাঁটু গেঁড়ে শায়লার সামনে বসল, তারপর হাতটা আলতো করে তার পেটে রাখল। শায়লা সরে গেল না, চেঁচামেচি করল না, কোনো বাঁধা দিল না। যেমন দাঁড়িয়ে ছিল ঠিক তেমনিই স্থির দাঁড়িয়ে রইল। কাউসার পেটে হাত বুলাল কিছুক্ষণ। আলতো করে একটা চুমু খেল। শায়লা বলল, ‘আইজ কিন্তু ঐগুলান হইব না।’
‘ছি! আমি কি সেই জন্য... ’
‘জানি না, মাসি ডাকতাছে, আমি শুইনা আসি। দরজার পেছনের তাকে বয়ামের মধ্যে আমচুর আছে, খবরদার হাত দিবে না।’ বলেই একছুটে বেরিয়ে গেল শায়লা। কাউসার মুচকি হাসছে। এই কথার মানে সে খুব ভালোই জানে। গত বছরের কথা। তখন বাজার থেকে আম উঠে গেছে। রাত কেটে ভোর হতে যাচ্ছে, কিন্তু কাউসার কিংবা শায়লা কেউই ঘুমায়নি। কাউসার অনবরত কথা বলে যাচ্ছে, শায়লা তখন তার পাশে শুয়ে, চুপচাপ তার মুখের দিকে তাকিয়ে। মানুষটা যখন কথা বলে তখন এত সুন্দর লাগে দেখতে! শায়লা চুপ করে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। কথায় কথায় কাউসার মায়ের কথা বলতে শুরু করেছে। ‘আমার আম্মায় যা আমচুর বানাইতো না! একেবারে বেহেশতি জিনিস। ওই জিনিস এই দুনিয়ায় আর কেউ বানাইতে পারব না। আমি খুব পছন্দ করতাম। আম্মা আমার জন্য এক বয়াম আলাদা কইরা রাখত। আম্মা মারা যাওয়ার পর আর খাওয়া হয় না। একদিন শখ কইরা দোকান থেইক্যা কিনা খাইতে গেছিলাম। ছ্যা! ওইডা কোনো আমচুর হইল!’
‘আপনার আম্মা ছাড়া মনে হয় আর কেউ বানাইতে পারে না!’ শায়লা মুখ বেঁকিয়ে ভেংচি কাটল।
‘না, আম্মার মতোন কেউ পারব না। খাতা কলম দাও, আমি লিইখ্যা দিচ্ছি।’

শায়লা আর কোনো কথা বলে নাই। কিন্তু ঠিক মনে করে রাখছে। এবার আম উঠছে, তখন থেকে আমচুর দেয়া শুরু করছে। এখন আষাঢ়ের শেষ। এই দেড় মাস ধরে টানা আম চিপে দিয়ে দিয়ে আমচুর বানিয়েছে। এতসব কিছু কাউসার জানে না। শায়লা বলেনি। আজ আমচুরের কথা বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। এই মেয়েটা এমন কেন? শখ করে বানানো জিনিস নিজের চোখের সামনে বসিয়ে খাওয়াতে ইচ্ছা করে না কখনো?
এক টুকরো বয়াম থেকে বের করে মুখে পুড়তেই আরামে চোখ বন্ধ হয়ে এল কাউসারের। সেই স্বাদ, সেই গন্ধ! একেবারে মায়ের মতোন। মা মারা যাওয়ার এতগুলা দিন পরে আবার সেই স্বাদ! কেন জানি হঠাৎ করেই চোখের কোনায় জল চলে এল তার।
শায়লা প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঘরে ঢুকল। বলল, ‘আপনারে না মানা করলাম! আপনি তাও বয়াম বের করছেন। আর মাগি মানুষের মতো কাঁদতে লাগছেন কেন?’
কাউসার উত্তর দিল না। হাতের পিঠে চোখ মুছে বলল, ‘শায়লা, এই ব্যাগে তোমার জন্য শাড়ি আছে। গয়না আছে। টিপ, কাজল, আলতা সব আছে। এইগুলান পইরা তুমি তৈয়ার হয়ে থাকবা। আমরা শুক্রুরবার বিয়া করব। তারপর তোমারে এইখান থেইক্যা নিয়া যাব।’

কাউসারের কথা শুনে শায়লা অট্টহাসিতে ভেঙে পড়ল। হঠাৎ এত জোরে হাসতে দেখে কাউসার চমকে ওঠে। চমকাল মাসিও। বাইরে থেকে হেরে গলায় বলল, ‘কিরে মাগি! নাগর দেইখ্যা যে ফূর্তিতে মইরা যাইতাছোস!’
শায়লা একটু পরে হাসি থামিয়ে বলল, ‘কেন বিয়া করবেন? পেটে বাইচ্চা আইনা ফেলছেন তাই?’
‘না, তা হইব কেন..,’
‘চুপ! একবারে চুপ।’ ধমকায়ে উঠে শায়লা। ‘পেটে বাচ্চা আইছে না জানলে তুমি কত বিয়া করতে আইতা জানা আছে। তয় চিন্তা করনের কোনো কারণ নাই। বাচ্চা আর নাই, ফালায় দিছি। এর আগেও দুইবার ফালাইছি, এবারও তাই। এরপর জরায়ুই ফালায় দিমু। তোগো শুয়ারের বাচ্চার পোলাপান পেটে ধরতে আমার ঘেন্না লাগে।’

শায়লা আবার দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। কাউসার আটকাল না। কোথায় যাবে শায়লা, তা সে ভালো করেই জানে। তাই আর আটকাল না। কিছুক্ষণ ঝিম ধরে বসে রইল খাটের ওপর। রাত ভালোই হয়েছে। এর মধ্যে গোলাপি একবার দরজায় এসে নক করল, শায়লার খাবার দিয়ে গেল। সেই খাবার টেবিলে তেমনি ঢাকা দেয়া রইলো আর কাউসার বসে রইলো তার পাশে, স্তব্ধ হয়ে। কিছু সময় পার হয়ে গেলে জড়তা ভাঙল কাউসার। খাট থেকে উঠে দরজা ডিঙিয়ে বারান্দায় এল। কেউ নেই! সবাই যে যার ঘরে। অন্যদিন ঘরের ভেতর থেকে কোলাহলের শব্দ ভেসে আসে। আজ সেসব নেই। আসর ভেঙেছে অনেকক্ষণ, সবাই ক্লান্ত। আজ কারও ঘরে মানুষ নেই।

সিঁড়ি ভেঙে ছাদের দিকে উঠে কাউসার। শায়লা ছাদেই আছে, জানে সে। উঠে এসে দেখল দূরে ছাদের একটা কোনায় ছোট একটা বেঞ্চের মতো করা, সেখানে বসে আছে। সেখানেই বসে ও, মন খারাপ হলে। ঘেন্না ধরে এলে! কাউসার শব্দ করল না। চুপচাপ গিয়ে শায়লার পাশে বসে। শায়লাও কথা বলল না। কাউসারের কাঁধে মাথাটা এলিয়ে দিল। সে হাত বাড়িয়ে মাথায় বিলি কাটতে শুরু করে। কিছুক্ষণ পরে শায়লা বলে, ‘আমাগো কি পোলা হইব না মাইয়া?’
‘মাইয়া! তোমার মতন টানা চোখ আর বড় বড় চুল...’
‘না, আমার মতন হইতে হইব না।’

শায়লা চোখ বুজে ফেলে। আরেকটু কাউসারের গা ঘেঁষে বসে। কাউসার চুলে বিলি কাটতে থাকে। সে জানে পরদিন এলে শায়লা আবার এমনই চেঁচামেচি করবে। তারপর হয়তো এমন ক্লান্ত হলে ওকে খুঁজবে আশ্রয়ের জন্য। হঠাৎ কেমন দম বন্ধ হয়ে আসে কাউসারের। চোখ মেলে দেখে আকাশের বিশাল এক থালার মতো চাঁদ। মাঝখানে কালো কালো একগুচ্ছ কলঙ্ক দাগ। দূরে কোথায় একটানা ঝিঁঝি ডেকে যায়। হঠাৎ একটা বাতাসের হলকা এসে কাঁপিয়ে দিয়ে যায়। কাউসার শক্ত করে জড়িয়ে ধরে শায়লাকে, বুকের মধ্যে, পাঁজরের ভেতর। কে জানে বাকি জীবন এতটা শক্ত করে ধরে রাখার শক্তি ওর আছে কি না!

শালগাড়িয়া, পাবনা