অস্পৃশ্য অনুভূতি

অস্পৃশ্য অনুভূতিছবি: সংগৃহীত

দুদিন পরই সম্মান ফাইনাল পরীক্ষা। সারা দিনের ব্যস্ততা শেষে বই নিয়ে বসলাম টেবিলে। পাতা উল্টেপাল্টে দেখছিলাম। হঠাৎ রুমমেটের ফোন বেজে উঠল। ‘হ্যালো বাবা, বলো....’

বোঝাই গেল, অপর প্রান্তে আঙ্কেল। অনুচিত জেনেও বইয়ের দিকে তাকিয়ে মন দিলাম রুমমেটের কথায়। কোনো বাবা–ছেলের মধ্যে ফোনে কথা হচ্ছে বুঝতে পারলেই আমার কৌতূহল কাজ করে। খুব জানতে ইচ্ছা করে, ছেলেদের ফোন করে বাবারা কী বলেন!

রুমমেট বাসা থেকে মেসে এসে পৌঁছেছে কি না, সেটা জানার জন্য তার বাবা ফোন করেছেন। বাবা তো, ছেলেকে নিয়ে চিন্তার শেষ নেই; তা ছেলে যত বড়ই হোক না কেন। দেয়ালের দিকে তাকিয়ে ভাবছি, বাবা কি এভাবে আমাকেও ফোন করতেন? কী বলতেন ফোন করে?

অনুভূতিটা আমাকে ভাবায়, ক্লান্ত করে। ভাবতে ভাবতে চোখ দুটো বন্ধ করে কল্পনার জগতে হারিয়ে যাই।
আমি মেসে পৌঁছালে ঠিকই সময়মতো বাবাকে ফোন করে জানাতাম। কিন্তু কীভাবে বলতাম? বাবা, আমি পৌঁছে গেছি, তোমরা চিন্তা করো না। নাকি আমিও ব্যস্ততায় ভুলে যেতাম যে বাবার অনেক চিন্তা হয়। হয়তো ভুলতাম না। রোজ ঠিকই সময় নিয়ে বাবার সঙ্গে গল্প করতাম, তাঁর যত্ন নিতাম, কখনো কখনো উচ্চস্বরে বকেও দিতাম। বাবার ধমক শুনতাম আর বিনা মূল্যের উপদেশও।

সংবিৎ ফিরল রুমমেটের ডাকে, ‘কী হলো তোমার? কী ভাবছ?’ একটু হকচকিয়ে গেলাম। কিছু না বলে আবার পড়ায় মনোযোগ দিলাম। বইয়ের অক্ষরগুলো কেমন অস্পষ্ট লাগছে।

এই যে এতক্ষণ ভাবছিলাম, এসব ব্যাপার কি সত্যিই আমাকে কষ্ট দেয়? চোখের কোণ ভিজে ঝাপসা হয়ে গেছে। রুমমেটের দিকে লজ্জায় তাকাতে পারলাম না। বইয়ের দিকে তাকিয়ে আবার বিড়বিড় করে পড়া শুরু করলাম। রুমমেট বুঝেছিল, কিছু একটা লুকাচ্ছি। এসব নিত্যবৃত্ত অস্পৃশ্য অনুভূতির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার অভিনয়টা আমি বেশ ভালোই রপ্ত করেছি! বুঝতে শিখেছি, সময় মানুষকে অনেক কিছু শেখায়। পরিস্থিতি মানুষকে অনেক জটিল করে তোলে। ছেলেবেলাটা হেসেখেলে পার করলেও কৈশোরে বুঝেছি, আমার জীবনে অনেক সীমাবদ্ধতা, জীবনজুড়ে অনেক অপ্রাপ্তি। হয়তো অনেক কিছু না পাওয়াই থেকে যাবে।

কৈশোর পেরিয়ে যৌবন এলেও আর দশজন ছেলে তাদের বাবাদের দাপটে যেমন জীবন অতিবাহিত করে, আমার তা কখনোই ছিল না। চব্বিশের কোঠার ছেলেদের শূন্য পকেটের করুণ গল্পটা বাবারা ভালো বোঝেন। আমি এই বোঝা বয়ে চলেছি অবলীলায়। আমাকে বোঝার কেউ নেই। বটবৃক্ষের যে শীতল ছায়ায় বসে হাজার হাজার স্বপ্ন বোনা যায়, আমার সেই শীতল ছায়া নেই। যে শক্ত বাহুডোর প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে আশার সঞ্চার ঘটায়, আমার সেই শক্ত বাহুডোর নেই।
সময় পেরিয়ে গেছে। চাওয়া, পাওয়া, অপ্রাপ্তির পেছনে ছুটতে ছুটতে কখন যেন মানিয়ে নিতে শিখে গেছি।

পৃথিবীতে সবারই সবচেয়ে প্রিয় মানুষ মা–বাবা। কিন্তু আমার কাছে ‘বাবা’ এক অস্পৃশ্য অনুভূতি, যাকে কখনোই ছুঁয়ে দেখা হয়নি। বুকে নিশ্চিন্তে মাথা রেখে জড়িয়ে ধরে স্বর্গের অনুভূতি পাওয়া হয়নি কখনো। বছরের পর বছর যার গায়ের গন্ধ শুঁকে দেখা হয়নি। বুঝতে শেখার পর থেকে জীবনের দুঃখ-সুখে, সহজ কিংবা কঠিন সময়গুলোয় যাকে পাশে পাওয়া হয়নি। যাকে কখনোই বলা হয়নি, ‘ভালোবাসি বাবা।’ বিভীষিকাময় সেই দিনের পর জীবনে কতশত শব্দ উচ্চারিত হয়েছে বারবার, কিন্তু ‘বাবা’ ডাকটা আসেনি একবারও, কখনো আসবে না আর। অস্পৃশ্য এই অনুভূতি আঁকড়ে ধরেই বয়ে চলেছে জীবন। অনুভূতিগুলো আমাকে বারবার কাঁদায়, হাসায়, ভয় দেখায়, শক্তি দেয়, ভাঙে, গড়ে।

বৃদ্ধ বয়সে বাবার অবলম্বন হওয়ার স্বাদ থেকে বঞ্চিত যে সন্তান, পিতার প্রতি দায়িত্ব-কর্তব্য পালনের পরীক্ষা থেকে বঞ্চিত যে সন্তান; সে নিতান্তই হতভাগা। সৌভাগ্যবানদের প্রতি অনুরোধ, এমন সুযোগ যাঁরা পেয়েছেন, সেটির সদ্ব্যবহারে ত্রুটি রাখবেন না।

সবার জীবনের বাবার গল্পগুলো এক নয়। আমার জীবনে তিনি থাকলে আজ হয়তো গল্পটা অন্য রকম হতো। তাঁর অস্তিত্ব আজও সারা বাড়িতে বিদ্যমান। ভিটেমাটির দলিলে, আলমারিতে তুলে রাখা লুঙ্গি আর শার্টে, শোবার ঘরের পূর্ব  দিকের দেয়ালে সাদা ফুলের মালা পরানো কপালে চন্দন আঁকা ছবিতে। নেই শুধু তিনিই। তিনি মিশে আছেন ওই দূর আকাশের তারাদের ভিড়ে। হয়তো জ্বলজ্বল করছেন। আমরাও জ্বলছি, তাঁর শূন্যতায়। যে শূন্যতায় কেটে যাবে বাকি দিনগুলো। ভালো থাকুক পৃথিবীর সব বাবা।

সাধারণ সম্পাদক, দিনাজপুর বন্ধুসভা