রাধা স্নান করে, মানিক বংশী বাজায়। দুজনের কণ্ঠেই সুর আছে। রাধা আর মানিক ছোটবেলা থেকে পিঠেপিঠি বেড়ে ওঠে।
সুন্দর কাহিনি, চিত্রনাট্য, পরিচালনা ও নৃত্য–গীতিতে ভরপুর মনোরম একটি চলচ্চিত্র আবদুল জব্বার খাঁর ‘বাঁশরী’। এই চলচ্চিত্রের পরতে পরতে আবহমানকালের বঙ্গসংস্কৃতির স্নিগ্ধ–কোমল ছোঁয়া আছে। জাত–ধর্মের বেড়াজালের ঊর্ধ্বে উঠে এই চলচ্চিত্র রক্ত–মাংসের মানবধর্মের জয়গান করে।
এই চলচ্চিত্রে একজন রাধা আছে। সেই জনমদুঃখিনী, কপালপোড়া রাধার চরিত্রে বেশ সুন্দর অভিনয় করেছেন কবরী। তার প্রাণপ্রিয় সখা মুরলিমোহনের চরিত্রটির নাম মানিক। এই মানিকও জনমদুঃখী, জীবনপোড়া এক মানুষ। অভিনয়ে সেই চরিত্রের সুন্দর রূপ দিয়েছেন রাজ্জাক। রাধা স্নান করে, মানিক বংশী বাজায়। দুজনের কণ্ঠেই সুর আছে। রাধা আর মানিক ছোটবেলা থেকে পিঠেপিঠি বেড়ে ওঠে। দোলনায় দুলতে দুলতে পরিচালক তাদের ছোট ও বড়বেলা দুটোই তুলে ধরেন। দুজনের প্রেম রাধা আর কৃষ্ণের প্রেমের মতোই ঝুলনায় দোল খায়।
মানিক মুসলমান পাগল ফকিরের কাছে মানুষ। তাকে বাবা বলে জানে। পরবর্তী সময়ে অবশ্য ফকির নিজেই মানিকের জন্মবৃত্তান্ত খোলাসা করে। মানিকের মা মারা গেলে হিন্দু বাবা মানিককে নিয়ে ফকির চাচার আখড়ায় চলে আসে। এরপর ঢাকায় যাবে বলে চলে গেলে আর ফিরে আসেনি। সেই থেকে মানিক এই ফকিরের পুত্র। মানুষে মানুষে ধর্ম নিয়ে ভেদাভেদ থাকলেও গ্রামবাংলার বাউল–ফকিরেরা যে চিরকাল এই ভেদাভেদের ঊর্ধ্বে থেকে সবাইকে কাছে টেনে নিয়েছেন, তাদের আখড়াগুলো সুরসাধনার মাধ্যমে নিবিড় মানবতার ঈশ্বরের সাধনায় ব্রত, তা আবারও একবার উঠে আসে। মানিকের মধ্যে সেই ছায়া আছে বলেই সে হিন্দু ব্রাহ্মণ পরিবারের মেয়ে রাধার প্রেমে মরিয়া।
গ্রামের আরও এক যুবক বলাই, রাধাকে বারবার কাছে পেতে চায়। কিন্তু রাধা তাকে ফিরিয়ে দেয়। প্রতিহিংসার অনলে জ্বলেপুড়ে বলাই অনেক কিছু করে বসে। রাতের অন্ধকারে রাধাকে ছিনিয়ে নিতে যায়, আক্রোশে অন্ধ হয়ে মানিক ও ফকিরের ঘর পুড়িয়ে দেয়। আবার রাধা গ্রাম ছেড়ে চলে গেলে আনু নামের মেয়েটিকে আপন করে নিতে চায়। আনু বলে, ‘জোর করে ভালোবাসা পাওয়া যায় না বলাইদা।’ প্রণয়ের আবেগে মরিয়া বলাই বলে ওঠে, ‘তুই আমাকে ফিরিয়ে দিস না আনু। তোকে নিয়ে আমি ঘর বাঁধব। নতুন সমাজ গড়ে তুলব।’ বলাই চরিত্রে সুন্দর অভিনয় করেছেন আনোয়ার হোসেন। প্রথম দিকে বলাইকে চলচ্চিত্রের খলনায়ক মনে হলেও, জীবনের বাঁক, ক্ষত, বিবেকের দংশন মানুষের মধ্যে যে পরিবর্তন নিয়ে আসে, কাপুরুষ থেকে মানুষ মহাপুরুষ পর্যন্ত হয়ে উঠতে পারে, সেই চিত্র উঠে আসে। আনু বলাইকে বলে, ‘আমাকে কি তুমি বোনের মতো ভালোবাসতে পারো না বলাইদা?’
পশ্চিমবঙ্গেও রাখির সময় নাছোড়বান্দা বিচ্ছু প্রেমিকদের রাখি পরিয়ে দেওয়ার একটা গান্ধীগিরি প্রচলিত আছে। ভালোবাসার তো অনেক রূপ, অনেক রং। ভাই–বোনের ভালোবাসাও পৃথিবীতে সুন্দর একটি বিষয়। এখানেও আনুর অনুরোধে দামাল প্রেমিক বলাইয়ের মন পাল্টে যায়। প্রেমিক থেকে দাদা হয়ে বোনকে সে বুকে টেনে নেয়। আবার যে পাগল ফকিরের ঘর পুড়িয়ে দিয়েছিল, সেই ফকিরই হয়ে উঠেছিল বলাইয়ের শেষ আশ্রয়।
রাজ্জাক, কবরী, আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে অভিনয়ে আরও ছিলেন আনোয়ারা, সাইফুদ্দিন, জব্বার খাঁ, রহিমা মেহফুজ, জিয়া হাসান, আভা, শোভা, আলেয়া, ইলা ইসলাম, রফিক, মেহবাহ, জুলু খান, জীকু, লালু, সুজনী, বিনয় বিশ্বাস, তপন, রাজিয়া চৌধুরী, আবুল হোসেন, তৈয়ব আলী, দোহা, ইউয়ুস জামাল, জহির চৌধুরীসহ অনেকে। শিশু শিল্পী হয়ে অভিনয়ে ছিলেন কুইন, জোবের, করিম, বাপ্পি, চুমকি, সামসু ও বেবী। নৃত্য পরিচালনা করেছেন রুপা খান।
কণ্ঠসংগীতে ছিলেন আঞ্জুমান আরা, রীনা হামিদ, শাহনাজ বেগম, সাবিনা ইয়াসমিন, আরতী ধর, রূপা খান, মালা খান, সিমুল বিল্লাহ, আবদুল আলীম, আবদুল লতিফ, আলতাফ মাহমুদ, সৈয়দ আবদুল হাদী, আবদুল জব্বার, নজমুল হুদা, সত্য সাহা। সহকারী পরিচালক ছিলেন এম এ রহমান। শব্দ গ্রহণে মজিদ, হানিফ ও মান্নান; সম্পাদনায় মশাররফ ও শাহজাহান; চিত্রগ্রহণে আমিনুর রহমান ও আহম্মদ এবং মুদ্রণে নূরুল হকসহ অনেকে। চলচ্চিত্রের প্রযোজনায় পপুলার ফিল্মস অ্যান্ড থিয়েটার্স ও সেখ পীর মোহাম্মদ অ্যান্ড ব্রাদার্স। আদি কবির লেখা গানের সঙ্গে গীত রচনা করেছেন গাজী মাজহারুল আনোয়ার। যন্ত্রসংগীতে আলাউদ্দিন লিটল অর্কেস্ট্রা। শব্দ গ্রহণে মণী বোস, সম্পাদনায় নূরুন্নবী, চিত্রগ্রহণে আফজাল চৌধুরী এবং কাহিনি ও চিত্রনাট্য রচনা করেছেন সত্য সাহা ও পরিচালক আবদুল জব্বার খাঁ।
চলচ্চিত্রের ব্যবস্থাপনায় ছিলেন আবদুর রেজ্জাক খান, প্রচারে আফজালুর রহমান। তত্ত্বাবধানে মশাররফ চৌধুরী ও এম এ আউয়াল। প্রধান সহকারী পরিচালনায় ও সম্পাদনায় ছিলেন সিরাজ মোগল। রূপসজ্জায় এম এস কাদেরী, স্থিরচিত্রে সিরাজুল ইসলাম ভূঁইয়া এবং চিত্রাঙ্কনে মোস্তফা আজিজ। চলচ্চিত্রায়ণে ও শৈল্পিক গুণগত মানের দিক থেকেও এই চলচ্চিত্র কালজয়ী। সেই কোন যুগের এই ছবি, বঙ্গদেশের প্রণয়বাঁশরী বুকের মধ্যে বাজতে থাকে, ছায়াছবির রূপ চোখের ওপর ভাসতে থাকে।
হাওড়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত