চিরন্তন ঐতিহ্যের গল্প ত্রিপুরার কাথারক নৃত্য

কাথারক নৃত্য
ছবি: সংগৃহীত

ত্রিপুরার পাহাড়ি অঞ্চলের আদিবাসী সংস্কৃতির অন্যতম নিদর্শন কাথারক নৃত্য। এটি শুধু নৃত্য নয়, বরং এক বহমান সমৃদ্ধ ইতিহাস; যা আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জীবনধারা, বিশ্বাস ও সংস্কৃতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। এই নৃত্য তাদের অতীত ইতিহাসের গল্প বলে। যা বর্তমানের আনন্দে শামিল হয় এবং ভবিষ্যতের উত্তরাধিকার সংরক্ষণে বদ্ধপরিকর।

বিশ্বাস করা হয়, কাথারক নৃত্যের জন্ম হাজার বছরেরও বেশি সময় আগে। তখনকার আদিবাসী সমাজে প্রকৃতি-উপাসনাই ছিল প্রধান ধর্মীয় ও সামাজিক রীতি। মানুষ বিশ্বাস করত, প্রকৃতির প্রতিটি উপাদান—সূর্য, চাঁদ, বৃক্ষ, নদী ও পশুপাখির মধ্যে বিশেষ শক্তি রয়েছে। এই শক্তিকে সন্তুষ্ট করতে এবং শুভ ফলাফল লাভের আশায় বিভিন্ন ধর্মীয় নৃত্য প্রচলিত হয় তখন থেকে।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই ধর্মীয় রীতি বিনোদনের মাধ্যমেও রূপ নেয়। যোদ্ধারা যুদ্ধের আগে নিজেদের চাঙা করতে, শিকারিরা সফল শিকারের আনন্দে, কৃষকেরা ফসল কাটার শেষে এবং সমাজপতিরা উৎসবে এই নৃত্যের আয়োজন করতেন। ধীরে ধীরে এটি আদিবাসীয় জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠে। এই নৃত্য ত্রিপুরাদের বিয়ের অনুষ্ঠানেও পরিবেশন করা হয়। এ সময় কাথারক পূজা দিতে হয়। পূজা শেষ হলে বর ও কনেপক্ষের কেজু কেজা নিকট আত্মীয়, সহচর দুজন ঢোলের তালে তালে মাথায় দীপশিখাসহ বোতল, হাতে থালাসহ পানিভর্তি কলসির ওপরে উঠে নাচেন। তাঁরা বিশ্বাস করেন, দীপশিখা জ্ঞানের প্রতীক, পানিভর্তি কলসি কর্মের প্রতীক এবং ফুলের মালা ভক্তির প্রতীক।

কাথারক নৃত্যের পরিবেশনা অত্যন্ত পরিকল্পিত, মাধুর্যময় ও ছন্দময়। এতে নাচের প্রতিটি নিবেদনের সঙ্গে একটি বিশেষ অর্থ থাকে। নৃত্যশিল্পীরা নির্দিষ্ট ছন্দে পা ফেলেন, দেহ বাঁকিয়ে তালের সঙ্গে মিলিয়ে নাচেন। অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে শিল্পী বিশেষ এক কাচের বোতল মাথায় সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে ধরে রাখেন।

বাদ্যযন্ত্রের মধ্যে শিল্পীরা ঢোল, করতাল, বাঁশি ও তুড়ির মাধ্যমে নৃত্যের তালে সুর যুক্ত করে থাকেন। ঢোলের গম্ভীর শব্দ শক্তি ও উদ্দীপনা প্রকাশ করে, বাঁশির মিষ্টি সুর প্রকৃতির সৌন্দর্য ফুটিয়ে তোলে। কাথারক নৃত্যে বিভিন্ন হাত ও মুখের অভিব্যক্তির মাধ্যমে প্রেম, সংগ্রাম, খুশি ও শোকের গল্প প্রকাশিত হয়।

ত্রিপুরার আদিবাসী সমাজে অনেক ধর্মীয় অনুষ্ঠানে কাথারক নৃত্যের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। দেবতাদের সন্তুষ্ট করতে আদিবাসীরা মনে করেন, এই নাচের মাধ্যমে তাঁরা দেবতাদের আশীর্বাদ লাভ করবেন। ফসল তোলার শেষে ধন্যবাদ জ্ঞাপন ও আনন্দ প্রকাশের জন্য এই নৃত্য অনুষ্ঠিত হয়। এ ছাড়া তীব্র খরার সময় অনেক আদিবাসী গোষ্ঠী বিশ্বাস করে, কাথারক নৃত্য করলে বৃষ্টি হয়। কথিত আছে, অতীতে যোদ্ধা ও শিকারিরা বিজয়ের আনন্দে কাথারক নাচতেন। এই নৃত্যের পোশাক অত্যন্ত বর্ণাঢ্য ও নান্দনিক।

পুরুষেরা সাধারণত উজ্জ্বল রঙের ধুতি ও পাগড়ি পরে, তাদের শরীর অলংকৃত থাকে লতাপাতা, পুঁতি ও পশুর দাঁত দিয়ে তৈরি গয়নায়। নারীরা রঙিন শাড়ি পরে, গায়ে থাকে রুপার অলংকার, কপালে টিপ ও হাতে চুড়ি। কখনো কখনো মুখোশ পরিধান করে, যা পৌরাণিক চরিত্র বা দেবতাদের প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। কাথারক নৃত্য সহজ নয়, এটি শেখার জন্য দীর্ঘদিনের অনুশীলন প্রয়োজন।

প্রতিটি নাচের নিবেদনে একটি গল্প লুকিয়ে থাকে, যা ভাষাহীনভাবেই প্রকাশিত হয়। বর্তমানে ত্রিপুরার বাইরে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক মঞ্চে কাথারক নৃত্য পরিবেশিত হচ্ছে এবং বিশ্ববাসী একে সমাদৃত করছে।

কাথারক শুধু একটি নৃত্য নয়, এটি একটি সংস্কৃতি, ইতিহাস ও আত্মপরিচয়ের দৃঢ় প্রতিচ্ছবি। যা অতীতের গৌরব বহন করে, বর্তমানের আনন্দে মিশে যায় এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এক মহামূল্যবান উত্তরাধিকার হয়ে থাকে। বিশ্বায়নের এই যুগে কাথারক নৃত্য এখনো তার ঐতিহ্য ও জৌলুশকে অটুট রেখেছে, যা ত্রিপুরার গর্ব ও বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতির অন্যতম সমৃদ্ধ অংশ হিসেবে পরিগণিত হয়।

শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ, সাংবাদিকতা ও চলচ্চিত্র পরিচালনা বিভাগ, গুজরাট বিশ্ববিদ্যালয়, ভারত