বাঙালি সমাজজীবনের গল্প ‘সত্য মিথ্যা’

‘সত্য মিথ্যা’ চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্যছবি: সংগৃহীত
এই গল্প বাঙালি সমাজজীবনের গল্প, এই গানগুলোও চিরকালীন বাংলাদেশের পরিচয় বহন করে চলে।

‘সামাজিক যাত্রাপালা’, ‘পারিবারিক ছবি’, ‘সপরিবার দেখার মতো ছবি’—আমাদের মধ্যবিত্ত বাঙালি সমাজজীবনে এসব কথা একসময় খুব প্রচলিত ছিল। গ্রামীণ সমাজজীবনের বিনোদনমাধ্যম হিসেবে কোথাও যাত্রাপালার আসর বসলে একই পরিবারের নাতি–নাতনি থেকে শুরু করে ঠাকুদ্দা–ঠাকুমা অর্থাৎ আট থেকে আশি বছরের সবাই মিলে পালা দেখতে যেতেন। হলে নতুন সিনেমা এলে শহুরে নগরজীবনেও নানা-নানি, চাচা-চাচি, আম্মা–আব্বা, রাঙা ভাবিসহ একান্নবর্তী পরিবারের গোটা ব্যাটালিয়ন ছুটির দিনে গিয়ে হাজির হতো। মধ্যবিত্ত পরিবারের নীতি–নৈতিকতা, পারস্পরিক সম্মান, পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধ থেকে সবাই মিলে একসঙ্গে বসে দেখার মতো ছবি পেলে যেন একটা উৎসবের ছোঁয়া লেগে যেত। এখনকার মতো ছোট ছোট পরিবারের সামর্থ্য অনুযায়ী ক্ষুদ্র গন্ডিতে শুধু স্বামী তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে বা প্রেমিক তাঁর প্রেমিকাকে নিয়ে ছবি দেখতে যেতেন না। ফলে পরিচালকদেরও একটা দায় থাকত সবার মন জয় করে নেওয়ার মতো ছবি বানানোর।

বাংলাদেশের এ জে মিন্টুর মতো জনপ্রিয় পরিচালকেরা এমন ধারার ছবি বানাতেন। অসাধারণ শিল্পশৈলী, চলচ্চিত্রায়নের দক্ষতায় ১৯৮৯ সালে নির্মিত তাঁর ‘সত্য মিথ্যা’ ছবিটি তেমনই সুন্দর একটি পারিবারিক চলচ্চিত্র। ছবির গল্প ও সংলাপ লিখেছেন ছোটকু আহমেদ। ছবিটি এতটাই জনপ্রিয় হয়েছিল যে পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের কিছু পুরোনো কলাকুশলী এবং পশ্চিমবঙ্গের কিছু নতুন কলাকুশলী মিলে সংশোধন করে ছবিটি আবার নির্মাণ করেন।

আমাদের সমাজব্যবস্থায় নারীকে বারবার অগ্নিপরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয়। এই ছবিতে দেখলাম একজন পুরুষকে—স্নেহশীল, মমতাময় বাবাকে অগ্নিপরীক্ষার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। আবার আমরা সৃষ্টিশীল মানুষেরাও চিরকাল মাকে এগিয়ে রাখি; মাকে নিয়ে কবিতা, গান, গল্প লিখি সবচেয়ে বেশি। এই স্নেহের বন্ধন, সন্তানের প্রতি দায়দায়িত্ব মায়া, মমতা বাবার মধ্যেও কিন্তু সমানভাবে থাকে। ছবির বিখ্যাত গান ‘মন্দ হোক, ভালো হোক, বাবা আমার বাবা/ পৃথিবীতে বাবার মতো আর আছে কে–বা?...’ আজও জনজীবনে সমাদৃত। আবেগ আর কান্নাজড়ানো কণ্ঠে আজও বঙ্গদেশের সন্তানেরা গেয়ে চলে ‘স্বর্গের মতো ছিল আমাদের ঘর/ যেখানে ছিল শুধু সোহাগ আদর/ সেই ঘর থেকে বাবা হারিয়ে গেল/ আমার কপালে তাই দুঃখ এল/ আজ আমি বুঝেছি বাবা কী ছিল।’ পিতার অপমানে আবেগতাড়িত সন্তান আজও দুঃখকাতর প্রতিবাদে গেয়ে ওঠে, ‘বাবার চেয়ে দামি নয়তো কোনো ধন/ তুচ্ছ তারই কাছে মানিক–রতন/ টাকা দিয়ে বাবার স্নেহ যায় না কেনা/ কারও সঙ্গে হয় না তার তুলনা/ সেই সে বাবার নামে গালি দিয়ো না।’ গানের প্রতিটি চরণে যেন মাতা-পিতার আশীর্বাদের চরণছোঁয়া লেগে থাকে। শাম্মী আক্তারের কণ্ঠে সাড়াজাগানো গানটির কথা লিখেছেন মনিরুজ্জামান মনির, সুর করেছেন আলম খান।

পরের পারিবারিক সাড়াজাগানো গানটি আরও চমৎকার। আজও মানুষের মুখে মুখে ফেরে, ‘আমার এ ঘর যেন স্বর্গ/ স্বামী যে সুখ, ছেলে স্বপ্ন, / আর তো কিছু নাহি চাই গো…।’ নিপুণ পারস্পরিক সংলাপের মতো করে বোনা এই গান। মায়ের কণ্ঠে ওপরের কথাগুলো শুনে ছেলে গেয়ে ওঠে, ‘ও মা কেমন তোমার স্বর্গ/ কলে পানি নাই, / পোলাও, কোরমা পাই না/ আলুভর্তা খাই।’ ছেলের অভিমানের অনুযোগ শুনে বাবা এবার ছেলেকে বোঝাতে গেয়ে ওঠে, ‘চেয়ে দেখো পথে/ কত লোক ঘুমায়/ একবেলা খেয়েদেয়ে/ পায় কী–বা না পায়/ তোমার যা আছে/ ওদের তা–ও নেই তো/ ওদের চেয়ে তুমি/ অনেক ভালো আছ... ।’ এই গানেরও কথা লিখেছেন মনিরুজ্জামান মনির, সুর করেছেন আলম খান, দরদি কণ্ঠ দিয়েছেন সাবিনা ইয়াসমিন, দিবা ও এন্ড্রু কিশোর।

রাজু ঘরসোহাগি বউয়ের সঙ্গে প্রতারণা করবে? নিজের সন্তানকে বাঁচাবে না মালিকের কন্যাকে বিয়ে করে মুখে হাসি ফোটাবে?

খুরশীদ আলম, বেবী নাজনীনের কণ্ঠে ‘আসিতেছে চাচা…’ নামের আবার একটি বেশ মজার গানও আছে। ‘তুমি আমার মনের পাখি আমি তোমার খাঁচা/ ভাতিজার বউ দেখিতে আসিতেছে চাচা…।’ গীতিকারেরা ছবির দৃশ্যের সঙ্গে মিলিয়ে সুন্দর গান রচনা করতে পারতেন। অফিসে কর্মরত এক অবিবাহিত ছোকরা সারাক্ষণই প্রেমিকা খুঁজে বেড়ায়। অফিসের উচ্চপদস্থ সহকর্মী চাচা তাকে সামলে রাখে। পাত্রী খুঁজে নিয়ে শিগগিরই বিয়ে করে নিতে বলে। এই প্রেমিক ছোকরা এবার সত্যি সত্যি জীবনসঙ্গী প্রেমিকা খুঁজে পায়। চাচাকে অনুরোধ করে পার্কে এসে পাত্রী দেখে যেতে। চাচা হেলেদুলে নাচতে নাচতে খোশমেজাজে পার্কে আসে আর আবিষ্কার করে যে তারই মেয়ের সঙ্গে এই ছোকরা জুটি বেঁধেছে।

ত্রিকোণ প্রেমের দ্বন্দ্বে সম্পর্কের কাটাকুটির রিক্ত-তিক্ত যন্ত্রণা আর আনন্দে-বিষাদে ভরপুর এই ছবি। ত্রিকোণ প্রেমের চরিত্ররা হলেন শাবানা, আলমগীর ও নূতন। রাবেয়া চরিত্রে শাবানা আর রাজু আহমেদ চরিত্রে আলমগীরের এক সন্তান নিয়ে মধ্যবিত্ত একটা সুখের সংসার ছিল। মেরুদণ্ড শক্ত রেখে সৎপথে কাজ করতে গিয়ে কোম্পানির অসৎ লোকেদের কারণে হঠাৎ চাকরি হারানোয় রাজু অসহায় হয়ে পড়ে। সে গরিব হতে পারে, কিন্তু অসৎপথে কোনো দিন পা বাড়ায় না। তাদের সন্তান চরিত্রে শিশুশিল্পী জনসন আগাগোড়াই মাতিয়ে রাখে। মূলত তারই অভিনীত চরিত্রের কণ্ঠে বাবার গানটি বাঙালি জনজীবনে ইতিহাস হয়ে উঠেছে।

মিস্টার চৌধুরী চরিত্রে অসাধারণ অভিনয় করা কিংবদন্তি অভিনেতা গোলাম মোস্তফা, একজন প্রতিষ্ঠিত শিল্পপতি। চট্টগ্রাম, ঢাকাসহ বিভিন্ন জায়গায় ব্যবসার অফিসসহ অনেক গাড়ি-বাড়ি ও সম্পত্তির মালিক সে। কিন্তু একমাত্র সন্তান রিতা চৌধুরী চরিত্রে নূতনকে নিয়ে খুব অসহায়। জীবনে ঘটে যাওয়া অনাখাঙ্ক্ষিত একটি ধর্ষণের পর থেকে মা–মরা মেয়েটি ঘরবন্দী হয়ে থাকে। কারও সঙ্গে কথা বলে না, হাসে না; শুধু কাঁদে আর একমনে সেতার বাজিয়ে চলে। পারিবারিক অভিভাবকসম পরিচারক গফুর চরিত্রে অন্য এক কিংবদন্তি অভিনেতা আনোয়ার হোসেন। গফুর মিস্টার চৌধুরীকে পরামর্শ দেয়, মেয়ের মন ভালো করতে ঢাকার বাড়িতে চলে যেতে। এরপরই তিনজনে ঢাকার বাড়িতে চলে আসে। মিস্টার চৌধুরী নতুন করে ঢাকার অফিসে ব্যবসা সাজানোর কাজে মন দেয়।

কাগজে বিজ্ঞাপন দেখে সেই অফিসে কাজ করতে আসে রাজু। শুধু অফিস নয়, মিস্টার চৌধুরী অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকেও সুস্থ করে তোলার জন্য সারাক্ষণ পাশে পাশে থাকে রাজু। এভাবেই সে রিতার মন স্পর্শ করে ফেলে। গফুর লক্ষ করে, রাজুর সংস্পর্শে এসে রিতা কেমন হাসে। মিস্টার চৌধুরীর সঙ্গে রিতাও ধীরে ধীরে আগের মতো প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। এভাবেই রাজুর প্রেমে পড়ে যায় রিতা। রাবেয়া আর রাজুর একমাত্র সন্তানের সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানির শঙ্কা ঘটে। চিকিৎসক জানায় যে অনেক টাকা না হলে ছেলেটিকে সুস্থ করা সম্ভব নয়। একমাত্র সন্তানকে বাঁচাতে পিতার সামনে অগ্নিপরীক্ষা এসে হাজির হয়। গফুর বলে, চিকিৎসার জন্য যত টাকা লাগবে সে ব্যবস্থা করে দেবে, বিনিময়ে শুধু রিতাকে পুরোপুরি সুস্থ করে তুলতে হবে আর মিস্টার চৌধুরীর মুখে হাসি ফোটাতে রিতাকে বিয়ে করতে হবে। রাজু ঘরসোহাগি বউয়ের সঙ্গে প্রতারণা করবে? নিজের সন্তানকে বাঁচাবে না মালিকের কন্যাকে বিয়ে করে মুখে হাসি ফোটাবে?

ধর্ষক চরিত্রে আমজাদ, অভিনয়ে ওয়াসীমুল বারী রাজীব জেল থেকে ছাড়া পেয়ে আবার রিতার জীবনে ছায়া ফেলে। সদ্য বিবাহিত রিতার সম্পত্তি দখল করতে চায়। নারীলোলুপ এই চরিত্র রাবেয়ার শরীরের ওপরও ঝাঁপিয়ে পড়ে। রাজু তাকে শায়েস্তা করে। এভাবে বিবাদ-বিসম্বাদ বাড়তে বাড়তে সম্পর্কের টানাপোড়েনের কাটাকুটিতে সবাই সবার জীবনের সব সত্য–মিথ্যা জেনে যায়। আমজাদের হাতে রিতার প্রাণ যায়। আমজাদের গুন্ডা বাহিনীর হাত থেকে রিতাকে ফিরিয়ে আনতে না পারলেও আপন সন্তানকে ফিরিয়ে আনে রাজু। শেষ মুহূর্তে এসে এই সন্তানও স্কুল থেকে ফেরার পথে নিজের বই-খাতা-ব্যাগ-জুতাসহ অস্তিত্বের চিহ্নগুলো ছড়িয়ে রেখে রাজুকে গুন্ডাবাহিনীর গতিপথ চিনতে সাহায্য করে, যা বেশ আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। টান টান উত্তেজনায় জমে ওঠে নিপুণ আনন্দে ভরপুর পারিবারিক ছবিটি। তবে হোটেলের নাচ-গান ও মারামারির দৃশ্যগুলোয় একটা মুম্বাইয়া অনুকরণের চিহ্ন আছে। বাঙালি একশ্রেণির দর্শক মুম্বাই আর বাংলাদেশকে কখনো আলাদা করতে পারেনি। তাই পরিচালক বাঙালি হয়েও বলিউডি মোহে আচ্ছন্ন ছিল বোঝা যায়। তবে এই গল্প বাঙালি সমাজজীবনের গল্প, এই গানগুলোও চিরকালীন বাংলাদেশের পরিচয় বহন করে চলে।

হাওড়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত