জহির রায়হানের বেহুলা, কালের মহাযাত্রা

‘বেহুলা’ মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল জীবনের

গ্রামবাংলার চিরন্তন লোকগাথা, ‘পদ্মপুরাণ’, ‘মনসামঙ্গল’ কাব্য অবলম্বনে জহির রায়হানের কালজয়ী চলচ্চিত্র ‘বেহুলা’, যা বাংলা চলচ্চিত্রজগতের একটি আলোকস্তম্ভ। ‘পদ্মপুরাণ’ মূলত দেবতার রূপকথার ডালপালায় মানুষেরই কথা। ‘মনসামঙ্গল’ বিষাদবেদনা বিজড়িত, গ্রামবাংলার মাঠ, গাছ, ঘাস, মাটি, আকাশ, নদীর জল জারিত জনজীবনের উপাখ্যান, যার আবেদন চিরকালীন।

গোটা পৃথিবীতে গ্রিক দেবদেবীদের সৌন্দর্য এবং গল্পগাথা নিয়ে এত মাতামাতি হয়, আমাদের আবহমানকালের বাংলা সাহিত্যের মঙ্গলকাব্য, মহাকাব্যের চরিত্রগুলো শুধু প্রচারের অভাবে নজরে আসে না। কবিমানসে রচিত এসব চরিত্রকে শুধু হিন্দু দেব–দেবী বলে ভাবাটা কখনোই ঠিক নয়। মূলত আদিম মানুষের ভয় আর অলৌকিক বিশ্বাস থেকে এসব দেবদেবীর জন্ম। আদি মধ্যযুগীয় কবিদের মনোভূমিজাত হয়ে এসব দেবদেবীর মুক্তি।

আমাদের চট্টগ্রামের মানুষেরা প্রতিবছর শ্রাবণ মাসে গোটা ‘মনসামঙ্গল’ কাব্যের পুঁথিটা একবার পড়ে শেষ করেন। বাংলাদেশের অনেক অঞ্চলের নিম্নবর্গের মহিলারা প্রায় সারা বছর চিত্রপটে সাজিয়ে মনসার গীতিকাব্য শুনিয়ে বেড়ান। ছোটবেলায় বগলে ‘মনসামঙ্গল’ কাব্যের পুঁথি নিয়ে ঠাকুমা এবং বয়স্ক ব্যক্তিদের দলবলের সঙ্গে আমিও বাড়ি বাড়ি যেতাম। আমাদের বাড়িতেও বাবা, কাকা, জ্যাঠারা মিলে রাতভর পুঁথিপাঠের আসর বসাতেন। সাম্প্রতিক ও চিরাচরিত গানের সুরকে ঘোষা হিসেবে ব্যবহার করে পুঁথি পড়া হতো। আবার সর্বজনীন পালার আসরে মুসলিম কবিয়ালদেরও দেখতাম উদার চিত্তে মনসার গান করে যেতে।

১৯৬৬ সালে পাকিস্তান আমলে দাঁড়িয়ে জহির রায়হানের মতো আন্তর্জাতিক মানের বোদ্ধা, ‘বেহুলা’কে চলচ্চিত্রায়িত করে মুক্তি দিয়েছেন। দল, মত, ধর্ম, বর্ণ–নির্বিশেষে জনজীবনে এসব চরিত্রের প্রবল আবেদন আছে বলেই পেরেছিলেন।
মূল গল্পকে নিজের মতো করে সাজিয়ে নিতে পেরেছিলেন, জাতির মাটি ছুঁয়ে উঠে আসা এই বিশ্ব বাঙালি পরিচালক। সংগত সংলাপ রচনায় এবং ধলা মিস্তিরির ব্যাটা কালা মিস্তিরি, কথায় কথায় বউ কমলির কাছে বকুনি খাওয়া গোবেচারা স্বামী, বেহুলা–লখিন্দরের বাসরঘরের নির্মাতা বিশু চরিত্রের অসামান্য অভিনয়ে আমজাদ হোসেন এক এবং অদ্বিতীয়। এই চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রথম খুঁটি যদি জহির রায়হান নিজে হন, দ্বিতীয় খুঁটি তবে আমজাদ হোসেন। তৃতীয় খুঁটি সংগীত পরিচালক আলতাফ মাহমুদ। বেহুলা–লখিন্দরের কাহিনি যেমন মূলত সুরের স্রোতধারায় চিরকাল প্রবাহিত, তেমন চলচ্চিত্রের জন্য গ্রামবাংলার চিরকালের বৈচিত্র্যময় সুরের মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন সংগীত পরিচালক। বহুমাত্রিক ধারার বাংলার সুর শিরায় শিরায় প্রবাহিত বলেই না এই সংগীত পরিচালক একদিন ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/আমি কি ভুলিতে পারি’—একুশের প্রধান গানটিতে সুর দিয়ে বাঙালি জাতির মজ্জার ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে যান।

এই চলচ্চিত্রের চতুর্থ খুঁটি বেহুলা ও লখিন্দর চরিত্রে সুচন্দা ও রাজ্জাকের অভিনয়। সুচন্দার চোখের চাহনি একেবারে সুচিত্রা সেনের মতো, ব্যক্তিজীবনে যিনি জহির রায়হানের ঘরনী। জহির রায়হান যদি অকালে দেশের জন্য প্রাণ না দিতেন, একের পর এক মননশীল চলচ্চিত্র নির্মাণ করে যেতে পারতেন। জহির-সুচন্দা জুটির কাজও বিশ্ব চলচ্চিত্রজগতকে সমৃদ্ধ করত।
ময়ূরসাথি লখিন্দরের সঙ্গে বেহুলার প্রথম দেখা, মিষ্টি প্রেমের বনিবনা, লখিন্দরের প্রশিক্ষণে বেহুলার ময়ূর নাচ শেখা, মনসার বিরাগভাজন হওয়া থেকে শুরু করে বেহুলা–লখিন্দরের বিয়ে, বাসররাত—প্রতিটি দৃশ্য সুচন্দা-রাজ্জাক যৌথ অভিনয়ের দীপ্তিতে চমৎকার। এরপর তো জনমদুখিনী বেহুলার একার লড়াই। মৃত স্বামীকে নিয়ে ভেলায় অনন্ত যাত্রা। শেষ পর্যন্ত ইন্দ্রের সভায় গিয়ে মৃতপ্রায় শরীরে নেচে বেড়ানো।

এই যে বেহুলার বাসরঘর, এই যে ইন্দ্রপুরীর সভা, আজকের উন্নত প্রযুক্তির দৃশ্যায়নে কোনো সিনেমাটোগ্রাফারের হাতে পড়লে চাকচিক্যে তাক লাগিয়ে দেবেন। বেহুলাকে চরিত্রহীন বদনাম দিতে মনসার কৌশলে ধূমকেতুতে পাঠানো, অমাবস্যার রাতে শ্মশানে অমৃতসুধার নাম করে সুরা পান করানো এবং চাঁদ সওদাগর ও লখিন্দরের গোটা পরিবারের সামনে বেহুলার অগ্নিপরীক্ষাকে আধুনিক প্রযুক্তিকৌশল আরও ভালো করে ফুটিয়ে তুলতে পারত। বেহুলা–লখিন্দরের ভাসমান ভেলাযাত্রাকে বর্তমানের কোনো চিত্রপরিচালক রীতিমতো অ্যাডভেঞ্চারে পরিণত করতে পারবেন। জহির রায়হান যখন কাজ করেছেন, তখন এত উন্নত প্রযুক্তি ছিল না। সীমিত পরিসরে দুঃসাহসিক যাত্রাকে তবু প্রাণবন্ত করে তুলতে পেরেছিলেন তিনি। আধুনিক প্রযুক্তি দিয়েছে বেগ, কেড়ে নিয়েছে আবেগ। নিখাদ ভালোবাসার সেই পরম প্রাণের স্পর্শ বর্তমান সময়ের অনেক কাজের মধ্যেই নেই।

জনমদুখিনী বেহুলার কথা মনে পড়লে সুচন্দার মুখ কখনো ভোলা যাবে না। পরবর্তী সময়ে রাজ্জাক সারা জীবন কতশত চরিত্রে অভিনয় করে মহানায়ক হয়েছেন। ভাবতেও ভালো লাগে যে এমনই একটা চলচ্চিত্রে কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করে তাঁর মহাযাত্রা শুরু হয়েছিল। মনসা চরিত্রে সুমিতা দেবী, চাঁদ সওদাগর চরিত্রে ফতেহ লোহানী, বেহুলার বাবা শাহী সওদাগর চরিত্রে মোহাম্মদ জাকারিয়া—প্রত্যেকের অভিনয় অসাধারণ। ১৪টি গান, খণ্ডগান, গানের কথা, গানের সুর, গানের কণ্ঠ সম্মিলিত দরদ ঢালা প্রাণের স্পর্শে মহীয়ান। গানগুলোয় কণ্ঠ দিয়েছিলেন শাহনাজ বেগম, নীনা খান, ঝরনা বন্দ্যোপাধ্যায়, মৌসুমি কবীর, কণা, লাভলী, নাজমুল হুদা, দিলীপ বিশ্বাস, নাজমুন হুদা, আবদুল লতিফ, আলতাফ মাহমুদ, মাহমুদুন্নবীর মতো কিংবদন্তি শিল্পীরা।

‘বেহুলা’ নামক চলচ্চিত্রের এসব বাতিস্তম্ভের আলো কখনোই নিভে যাওয়ার নয়। আলোকডিঙা সাজিয়ে এ এক কালের মহাযাত্রা।

হাওড়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত