পৃথিবীতে যত সুন্দর জিনিস আছে, তার মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর পৃথিবী নিজেই। মানুষ ও জায়গাভেদে ব্যাপক বিচিত্রতা। তাইতো পৃথিবী ও জীবনকে ভিন্নভাবে উপলব্ধি করতে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাসি বিভাগের ‘১ম আবর্তন’ সার্ক ট্যুরের অংশ হিসেবে গিয়েছিলাম ভারত ভ্রমণে। আর এই ভ্রমণ অভিজ্ঞতা যেমন নতুনভাবে জীবনকে উপলব্ধি করিয়েছে, তেমনি প্রশস্ত করেছে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি, শিখিয়েছে নতুন অনেক কিছু।
অনেক দিন যাবৎ আমরা বিভাগ থেকে সার্ক ট্যুরের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করছিলাম। বিভাগের চেয়ারম্যান অর্ঘ্য প্রসূন সরকারের অক্লান্ত পরিশ্রম, সার্বিক সহযোগিতা ও দিকনির্দেশনায় আমাদের প্রস্তুতির পালা শেষ হয়। আমাদের ভ্রমণ শুরু হয় বেনাপোল সীমান্ত পার হওয়ার মধ্য দিয়ে। পরদিন শীতার্ত ভোরে সীমান্ত পাড়ি দেওয়ার জন্য দীর্ঘ লাইনে দাঁড়াই। প্রথম ভারত প্রবেশের অনুভূতি দীর্ঘ লাইনে দাঁড়ানোর কষ্টকে ম্লান করে নতুন উদ্যমতা নিয়ে আসে। এবারের গন্তব্য হাওড়া স্টেশন। যখন হাওড়া স্টেশন পার হচ্ছিলাম, মনে পড়ে গেল ডিসেম্বরের শহরের কথা—‘ঘরে ফেরা তোমার অভ্যাসে নেই আর পিছু ডাকা আমার সিলেবাসে নেই।’ হাওড়া ব্রিজের নান্দনিক সৌন্দর্য আমাদের ভাবুকতায় ডুবিয়ে দেয়। আমাদের মনে তখন একটাই চাওয়া—ঘুরতে হবে অনেক, পাড়ি দিতে হবে অনেক দূরের পথ।
হাওড়া স্টেশন থেকে রাতেই আমরা আগ্রার উদ্দেশে যাত্রা শুরু করি। ট্রেনের ভ্রমণ বেশ উপভোগ্য ছিল। আনন্দ করতে করতে অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে ফেলি। প্রায় ২২ ঘণ্টা ভ্রমণ শেষে স্টেশনে যখন পৌঁছাই, শীতের তীব্রতা যেমন অনুভূত হতে লাগল, তেমনি দূর হতে দেখা রাতের আলোকসজ্জা সংবলিত আগ্রা ফোর্টের সুউচ্চ দেয়াল মনে এক প্রশান্তির দোলা দিয়ে গেল। রাত তখন সাড়ে নয়টা।
পরদিন পুরো আগ্রা শহর ঘুরে দেখি—ফতেহপুর সিক্রি, গুরুদুয়ারা, সিকান্দারা, বেবি তাজ ও আগ্রা ফোর্ট। যে হোটেলে ছিলাম সেখান থেকেই দূরে তাজমহল দেখা যেত। ফতেহপুর সিক্রি শহরটি আগ্রা থেকে ৩৬ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত, যা ১৫৬৯ সালে সম্রাট আকবরের আনুষ্ঠানিক রাজধানী ছিল। বিশ্ব ইতিহাসের অন্যতম সাক্ষী হিসেবে ধরা হয় ফতেহপুর সিক্রিকে, যার পুরোটাই পাথুরে জায়গা। দুর্গ ও প্রাসাদগুলো রক্তবর্ণের বেলে পাথরে তৈরি। এর প্রধান তোরণদ্বার ‘বুলন্দ দরওয়াজা’ ৫৪ মিটার উঁচু, যা এশিয়ার সবচেয়ে উঁচু তোরণদ্বার। ফতেহপুর সিক্রিতে দেখা মেলে ছনের ঘরের আকৃতির সেলিম চিশতির মাজার, যা সাদা শ্বেত পাথরে তৈরি। এর গায়ে মানুষ তাদের মনের ইচ্ছা পূরণের জন্য আজও সুতা বেঁধে রাখে।
চতুর্থ দিনে সকাল ছয়টায় আমরা প্রবেশ করি তাজমহল সীমানায়। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, ‘ইতিহাসের গালে একফোঁটা অশ্রু।’ কবিগুরু ঠিকই বলেছিলেন। এমন মানব নির্মিত আশ্চর্যের প্রতি অপলক তাকিয়ে দেখলে মুগ্ধতায় ছুঁয়ে যায় হৃদয়, ফিরে আসা অবধি পিছু ফিরে তাকানোতে থাকে বিরহের অশ্রু। বিশ্বের সপ্তম আশ্চর্যগুলোর অন্যতম নিদর্শন তাজমহল। ফরাসি প্রভাব ও রুচিময় নকশার ছোঁয়ার সঙ্গে মোগল সাম্রাজ্য শৈলীর নকশা সমগ্র ভবনটিতে রয়েছে, যার নির্মাণ সম্পন্ন করার জন্য ২০ হাজার মানুষ ২২ বছর ধরে পরিশ্রম করেছেন।
তাজমহলের পর আমাদের গন্তব্য ছিল আজমির শরিফ, খাজা মঈনুদ্দিন চিশতির মাজার। সেখান থেকে রাতেই রওনা হই রাজস্থানের জয়পুর শহরের উদ্দেশে।
মরুর দেশে ভ্রমণের পরিকল্পনা করলে ভেসে ওঠে সেই প্রাচীন প্রাসাদ, স্থাপত্য, রাজা-মহারাজাদের গল্প আর সুস্বাদু খাবার। রাজস্থান বিশাল রাজ্য এবং এর প্রতিটি শহর ও গ্রামের মধ্যে লুকিয়ে আছে রাজপুত রাজাদের নিদর্শন, যা এক জীবনে ঘোরা অসম্ভব। রাজস্থানের রাজধানী জয়পুর এক আশ্চর্য সুন্দর শহর। অবিকল্প সে সৌন্দর্য। অপরূপ স্মৃতিঘেরা জীবন্ত নগরীটি ‘পিংক সিটি’ হিসেবেও সুপরিচিত। জয়পুরে ঘুরে দেখি— হাওয়া মহল, যন্তর-মন্তর, আম্বার ফোর্ট, জয়গড় ফোর্ট, শিশমহল, জলমহল, আরও কত কী!
রাজস্থানের মরুভূমির সঙ্গে আমরা পরিচিত হই। এ এক নতুন অভিজ্ঞতা। সেখানকার ঐতিহ্যবাহী পোশাকের বেশে সবাই ফটোশুট করি। সেসব পোশাক তৈরির কারখানাগুলোও আমরা দেখতে থাকি আর বিস্মিত হই। জয়পুরের জলমহল (জল প্রাসাদ) হ্রদেও পৃষ্ঠে ভাসমান বিভ্রম দেয়। এটি একটি পাঁচতলা প্রাসাদ, যেখানে চারটি তলা পানির নিচে থাকে। জলমহল রাজস্থান ও মোগল স্থাপত্যের একটি মিশ্র স্থাপত্য, যা রাজপুতদের প্রকৌশল দক্ষতার একটি সাক্ষ্য।
পরের গন্তব্য হিমাচল প্রদেশ। শীতের অনবদ্য অনুভূতি। হিমাচলের পাহাড়ি রাস্তায় ভ্রমণ রোমাঞ্চকর। গানের ছন্দমাদকতায় অজান্তেই বন্ধুরা সবাই নাচের তালে হাত-পা দোলাতে থাকি। কত সুন্দর এ জীবন!
সিমলায় মাইনাস ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ‘কুফরি’তে ঘোড়ার পিঠে চড়ে পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথে ঘুরে বেড়ানোর মতো অ্যাডভেঞ্চার আমাদের জীবনে ইতিপূর্বে কখনো আসেনি। সেখানকার শ্বেতশুভ্র বরফের চাদরে মোড়ানো পাহাড়ের অপার্থিব সৌন্দর্য ভাষায় প্রকাশের মতো নয়। পরদিন আমরা হিমাচলের বিলাসপুর, মান্ডি, কটলা-কুল্লু সর্বত্র চষে বেড়াই। সেখানে বিয়াস নদীর সৌন্দর্য আমাদের বিমুগ্ধ করে, যার দুই কূলজুড়ে নুড়ি পাথরের বিশাল জমায়েত। নদীর কিনারের বাড়িগুলো আর প্রকৃতির সম্মিলন যেন এক অদ্ভূত জগৎ সৃষ্টি করে।
হিমাচল প্রদেশের হিমালয়ের কোল ঘেঁষে মানালি। মানালি ভ্রমণের অন্যতম টার্নিং পয়েন্ট হলো ‘অটল টানেল’ অতিক্রম করা। ১০ হাজার ফুট উচ্চতায় এত বড় হাইওয়ে টানেল পৃথিবীতে আর নেই। মানালিতে মাইনাস ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা, বাংলাদেশের পতাকা হাতে ফটোশুট আর সেই সঙ্গে চেয়ারম্যান স্যারের অফার করা সুইটকর্ন ছিল অমৃত এক উপভোগের নামান্তর। এরপর মানালিতে দুপুরের খাবার সেরে পশ্চিমবঙ্গের উদ্দেশে রওনা হই।
এবারের গন্তব্য পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার বোলপুর। যেখানে রয়েছে কবিগুরুর স্মৃতিবিজড়িত শান্তিনিকেতন ও বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়। সেখানে পৌষ মেলা উপভোগ করা এবং সাঁওতাল সম্প্রদায়ের নিজস্ব নৃত্যকলায় অংশগ্রহণ ছিল আমাদের জীবনের এক আনন্দঘন অভিজ্ঞতা। বাদ যায়নি খেজুর রসের স্বাদ নেওয়া থেকেও।
এরপর কলকাতা শহর। সেলুলয়েডের ফিল্মে মোড়ানো মুগ্ধতার এক শহর। পার্ক স্ট্রিট, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল আর কলকাতার স্ট্রিটফুড— সবকিছুই ছিল অসাধারণ! মোহরকুঞ্জে পৌষ উৎসব উপভোগের পর ফার্মাসি বিভাগের চেয়ারম্যান অর্ঘ্য প্রসূন সরকার স্যারের দেওয়া রাতের খাবারের অভিজ্ঞতা ছিল অনন্য। সেদিনের অন্যতম আকর্ষণ ছিল ভেটকি মাছের পাতুরি, যার স্বাদ আজও মুখে লেগে আছে।
সব শীতের শেষে বসন্ত আসবে। কিন্ত আমাদের যে গেছে দিন, তা কী আর ফিরে আসবে! এই আমাদের বেঁচে থাকার রসদ, সারা জীবনের স্মৃতি। আমাদের ক্যাম্পাস জীবনের স্মরণীয় লগন, যা চির অমলিন হয়ে থাকবে প্রত্যেকের হৃৎ–কন্দরে।
শিক্ষার্থী, ফার্মেসি বিভাগ, কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়