প্রতিদিনের সূর্যের মতন তিনি চির নূতন

কাজী নজরুল ইসলাম

প্রাত্যহিক পথচলার প্রতিটি অনুভবই জীবনকে এগিয়ে নেয়। তার পরও হাসি-খেলার জীবনে বেধনাবোধের মূল্য বেশি। বেদনাবোধ জীবনকে শুদ্ধ করে। বেদনা যার যত বিশাল, জীবনকে তিনি তত বেশি উপভোগ করেন। সৃষ্টিশীল মানুষের ক্ষেত্রে বিষয়গুলো বেশি উপলব্ধি করা যায়। সৃষ্টির নিশ্চলতায় ফুটে ওঠে নানা অনুভবের ছবি।
দিনে দিনে সব বিবর্তিত হয়; কোনো কোনো ক্ষেত্রে গঠনও বদলায়, প্রতিটি বিষয়ের উৎকর্ষ ঘটে। সাহিত্যও বদলেছে। প্রতিটি ধারায় স্থান পেয়েছে মানবজীবনের আখ্যান। ভালোবাসা, প্রেম, বিরহসহ প্রতিটি অনুভব নিয়েই বর্তমান সাহিত্যে কলম ও কালির অনবরত ছুটে চলা। আর বাংলা সাহিত্যের প্রায় প্রতিটি ধারা যে কজন প্রাণপুরুষের স্পর্শে সমৃদ্ধ হয়েছে, তাঁদের একজনকে স্মরণ করতেই কি-বোর্ডের বোতামে আঙুল রাখা।

না, মানুষটি কখনো আয়োজন করে গান লেখেননি। কোনো কোনো গান হারমোনিয়াম বাজিয়ে নির্দিষ্ট বিষয় ছাড়ায় সুরে সুরে গেয়ে উঠেছেন। আবার কোনো গানের কথা সাজিয়েছেন রাগের কাঠামো অনুযায়ী। বাংলা সাহিত্যের সূর্যসম এই মানুষটির সাহিত্য–জীবনের বড় অংশটি ব্যয় হয়েছে গান রচনার কাজে। ভাবলে আশ্চর্য হতে হয়, কতটা প্রতিভা নিয়ে জন্মালে মুহূর্তের মধ্যে এমন একটি গান লিখতে পারা যায়! গানের কথা বলব। তার আগে গান লেখার গল্পটা বলি।

প্রায় আধা ঘণ্টা পর দরজা খুলে বেরোলেন তিনি। একটা কাগজ দিলেন সুরসম্রাটের হাতে। মাত্র ৩০ মিনিটের সাধনায় গাঁথা শব্দের মালায় নজর বোলালেন আব্বাসউদ্দীন।
‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এল খুশির ঈদ/ তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে শোন আসমানী তাগিদ।’ কথাগুলো পড়তেই আব্বাসউদ্দীনের দুই চোখ বেয়ে অশ্রু নামল।

সুরসম্রাট আব্বাসউদ্দীন আহমদ মানুষটিকে সম্মান ও সমীহ করতেন। একদিন পথিমধ্যে তাঁর সঙ্গে দেখা। প্রিয় সম্বোধনে মানুষটিকে ডেকে বিষয় উল্লেখ করে সুরসম্রাট বললেন, একটা গান লিখে দেন। তারপর নানা কথা শেষে মানুষটি রাজি হলেন। আব্বাসউদ্দীন মানুষটির কথামতো সব বিষয় সমাধান করে তাঁর কাছে গান নিতে গেলেন। মানুষটি চা-পান পছন্দ করতেন। তাই যাওয়ার সময় এক ঠোঙা পান ও চা সঙ্গে নিলেন। দেখা হতেই বিস্তারিত খুলে বললেন। সব শুনে খাতা ও কলম নিয়ে ঘরে ঢুকে মানুষটি দরজা বন্ধ করে দিলেন। সুরসম্রাট বাইরে অপেক্ষায়, পায়চারি করছেন। সময় যেন আর এগোই না। প্রায় আধা ঘণ্টা পর দরজা খুলে বেরোলেন তিনি। একটা কাগজ দিলেন সুরসম্রাটের হাতে। মাত্র ৩০ মিনিটের সাধনায় গাঁথা শব্দের মালায় নজর বোলালেন আব্বাসউদ্দীন।
‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এল খুশির ঈদ/ তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে শোন আসমানী তাগিদ।’ কথাগুলো পড়তেই আব্বাসউদ্দীনের দুই চোখ বেয়ে অশ্রু নামল।

বলার আর অপেক্ষা রাখে না, নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন, কালজয়ী গানটির রচয়িতা কাজী নজরুল ইসলাম। তাঁর গানের সংখ্যা প্রায় তিন হাজার। গজল, কাব্যগীতি, রাগপ্রধান, শ্যামাসংগীতসহ বিভিন্ন ঘরানার গান রচনা করেছেন নজরুল। গান রচনা ও গাওয়ার পাশাপাশি নজরুল গানও শিখিয়েছেন।

বাংলা সাহিত্যের প্রতিটি ধারা কবি নজরুলের পরশে সমৃদ্ধ হয়েছে। পাঠক মাত্রই তাঁর লেখায় জীবন গঠনের নির্দেশনা পান। শুধু তা–ই না, শোষিত, দুঃখী, বঞ্চিত মানুষের জন্য দৃপ্ত স্বরে কণ্ঠ তুলেছেন তিনি। আর কথার বিস্তার না করি। ধূমকেতুর দিকে নজর ফেরাই। না, হ্যালির ধূমকেতু নয়। অর্ধসাপ্তাহিক ধূমকেতু নজরুলের। ১৯২২ সালের ১১ আগস্ট কলকাতা থেকে তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়। ‘ধূমকেতু’ উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে আর একটি নাম উচ্চারিত হয় ‘অগ্নিবীণা’। এটি নজরুলের প্রথম কাব্যগ্রন্থ। ১২টি কবিতাসংবলিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ দিয়েই পাঠক হৃদয়ে আসন লাভ করেন নজরুল। দিনপঞ্জির হিসাবে ১৯২২ সালের অক্টোবর মাসে অগ্নিবীণার প্রকাশ। সেই হিসেবে অগ্নিবীণার বয়স প্রায় ১০০ বছর। তবু ‘অগ্নিবীণা’র আহ্বান এক ছটাকও কমেনি। এ কারণেই  নজরুল অনন্য, অসাধারণ।

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘বসন্ত’ নাটক নজরুলকে উৎসর্গ করে একটি কপি পাঠানোর সময় বলেছিলেন, ‘তাঁকে বলো, আমি নিজের হাতে তাঁকে দিতে পারলাম না বলে সে যেন দুঃখ না করে। আমি তাঁকে আমার সমগ্র অন্তর দিয়ে অকুণ্ঠ আশীর্বাদ জানাচ্ছি। আর বলো, কবিতা লেখা যেন কোনো কারণেই সে বন্ধ না করে। সৈনিক অনেক মিলবে, কিন্তু যুদ্ধে প্রেরণা জাগাবার কবিও তো চাই।’

১১ জ্যৈষ্ঠ, ১৩০৬ বঙ্গাব্দের এই দিনে পশ্চিমবঙ্গের চুরুলিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তাঁর সম্পর্কে যত জানছি, তাঁর লেখা যত পড়ছি, ততই মুগ্ধ হচ্ছি। কোথায় নেই তিনি, প্রেম, বিরহ, ভালোবাসা, বিদ্রোহ সবেতেই তাঁর সরব উপস্থিতি। প্রতিদিনের সূর্যের মতো বাংলা সাহিত্যের আকাশের সূর্য, নজরুল চির নূতন। তাঁকে প্রতিদিন নতুন নতুনভাবে চেনা যায়। আজকের এই শুভদিনে প্রাণের কবি নজরুলের প্রতি অজস্র শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।