অরণি আমি আর বৃষ্টি

ছবি: লেখকের সৌজন্যে

কনকনে ঠান্ডা হিমেল বাতাসে বারান্দায় দাঁড়িয়ে হঠাৎ করে মনে মনে চাইছি, শহরজুড়ে একপশলা বৃষ্টি নামুক। একটু পর ঠিকই বৃষ্টি নামল। জানালা দিয়ে বৃষ্টি দেখতে দেখতে ভাবছি, সব ঠিকঠাক থাকলে পরদিন একটা নীল ছাতা হাতে নিয়ে আমাদের দেখা হবে। হঠাৎ ঝুম বৃষ্টি নামলে ওই ছাতার নিচে জড়সড় হয়ে দাঁড়াব দুজন!

সেদিন শ্রাবণ মাসের শেষ দিবসে ভীষণ বৃষ্টিময় সুন্দর একটা সময়ে আমাদের দেখা। সকাল থেকেই বৃষ্টির পালা শুরু। আকাশ যেন মনে মনে পণ করছে, আঁধার-জড়ানো এই দিনে শ্রাবণকে হারিয়ে দেবে। আমার সাদামাটা জীবনে একপশলা বৃষ্টি নিয়ে এসেছিল অরণি। ঝুম বৃষ্টি নামার পর তড়িঘড়ি করে আমরা একটা চায়ের দোকানের নিচে আশ্রয় নিলাম। ফুটপাথের ওই ভেজা বেঞ্চটাতে বসে জবুথবু হয়ে ভেজা কাকের মতো চায়ের কাপে উষ্ণতা খুঁজে বেড়াতে চেষ্টা করি। হঠাৎ পৃথিবীর বুকে একটা দমকা হাওয়ার বৃষ্টি বয়ে যায়। সেই বৃষ্টিতে তোমার অবাধ্য এল চুল যখন চোখের সামনে চলে এসে তোমার দৃষ্টিকে ক্ষণিকের জন্য অন্ধ করে দেয়, তুমি চুল সরিয়ে বলো, ‘চলো আমরা আজকে ইচ্ছেমতো ভিজি।’ আমার দীর্ঘদিনের চাওয়া হঠাৎ তার মুখে শুনতে পেরে মুহূর্তেই উচ্ছ্বাসে রাজি হয়ে গেলাম।

দুপুর গড়িয়ে বিকেল হচ্ছে। পথের পাথরে জলের ধোঁয়া উঠছে, উঁচু গাছগুলো মাথা নিচু করে চুপ হয়ে আছে। ফাঁকা রাস্তায় সে নিজেকে রানি ভেবে হেঁটে যাচ্ছে! আর গাছগুলো তাকে মাথা নিচু করে কুর্নিশ করছে।

ভীষণ বৃষ্টিতে সুন্দর রাস্তাটায় দিন ফুরিয়ে বিকেলে হাঁটছি আমরা। এ শহরের আবহাওয়া ঠিক যেন টিনএজের আমরা! বৃষ্টি এলে লোকে বিড়বিড় করে বলে, ‘এপ্রিলের বৃষ্টি মে’র ফুল নিয়ে আসে’। ভুল বলে না বোধ হয়। আমার পাশে হাঁটতে থাকা ফুলটারও জন্ম মে মাসেই। অবশ্য এখন মে না। আগস্ট মাস চলছে। দেশটা কিছুদিন আগে নতুন করে স্বাধীন হলো। শহরের ঘাস সবুজ হয়ে উঠেছে। ফুল ফুটছে নানা রঙের। কদম নিয়েই বেশির ভাগ লোক উৎসবে ব্যস্ত হলেও ছোট্ট হলদে ঘাসফুলের মাথা তোলাও চোখে পড়ে রোজ পথ চলতে!

তখনো মাঝেমধ্যে বিশ্বাস হচ্ছিল না, আমি তার সঙ্গে ঝুম বৃষ্টিতে ভিজে এই শহরে হাঁটছি। বহুদিনের স্বপ্ন হঠাৎ অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে ধরা দিলে যেমনটা লাগে ঠিক তেমন। তখন তার হাতটি শক্ত করে ধরি। শীতল একটা স্পর্শ অনুভব হচ্ছে। বরফ শীতল হৃদয়টা জমে আছে অনেক যুগ ধরে! কেরানিকীর্ণ খাঁচার রন্ধ্র দিয়ে থেকে থেকে লাগে সিক্ত কোমল ছোঁয়া। এমন সময় ভীষণ সত্য একজোড়া হাতের স্পর্শ আমার হাতে ছোঁয়া দিচ্ছে।

আমরা হাঁটতে থাকি আপন মনে। হাতের ঘড়ি জানিয়ে দেয় আমার আজকের হাঁটার টার্গেট পূর্ণ হয়ে গেছে। তবু হাঁটছি বৃষ্টিতে ভিজে আপনমনে। সেই বৃষ্টিতে নিঃশেষে মিশে গিয়ে চলছি নিরুপাধি, নামহীন হয়ে। ভালো লাগছে ভীষণভাবে। রিমঝিম এই ঘন বর্ষণ আপাত-আত্মহারা হয়ে জানিয়ে দিচ্ছে, পৃথিবীতে যেন দিন নেই, রাত নেই; শুধু আছে স্তম্ভিত কাল মেঘ-মায়ালোক।

দুপুর গড়িয়ে বিকেল হচ্ছে। পথের পাথরে জলের ধোঁয়া উঠছে, উঁচু গাছগুলো মাথা নিচু করে চুপ হয়ে আছে। ফাঁকা রাস্তায় সে নিজেকে রানি ভেবে হেঁটে যাচ্ছে! আর গাছগুলো তাকে মাথা নিচু করে কুর্নিশ করছে। বৃষ্টিভেজা তাকে ভীষণ সুন্দর লাগছে। কিন্তু বৃষ্টির ফোঁটায় আমার মোটা কাচের চশমাটা ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। ঝাপসা কাচের মধ্য দিয়েই একটা মুখ দেখতে পাই। মুখটা ঝাপসা। শুধু অবয়ব দেখছি। অসম্ভব মায়া সেই মুখে।

ভাবলাম গাড়ি করে ফিরব না, রিকশায় ফিরব দুজনে। তার হাত ধরে বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে রিকশা খুঁজতে খুঁজতে অনেক দূর হেঁটে গেলাম। বৃষ্টিতে ভিজে তার ভীষণ শীত করছে। ঠান্ডা লেগে যাওয়ার আশঙ্কায় তার ভেজা চুলগুলো যত্ন করে মুছে দিই। তখনই কোত্থেকে যেন দেবদূতের মতো এক রিকশাওয়ালা এসে নিজেই বললেন, ‘যাবেন নাকি?’

আমরা উঠে বসলাম। দুজন জড়াজড়ি করে রিকশার হুড তুলে আর অর্ধেকটা ভিজে চলতে থাকলাম। শহরের পিচঢালা ভেজা রাস্তায়, ভেজা ল্যাম্পপোস্টের ঘোলাটে হলুদ আলোয় সবকিছু মায়ায় আবর্তিত হচ্ছিল বারবার। কী যে মায়া! গুন গুন করে গাইছিলাম-
‘কেন মেঘ আসে হৃদয়-আকাশে,
তোমারে দেখিতে দেয় না
মাঝে মাঝে তব দেখা পাই,
চিরদিন কেন পাই না...’

দিন শেষ হচ্ছে আমাদের; বৃষ্টি শেষের নেশা তখনো কাটেনি। প্রায় ঘণ্টাখানেক তাকে পাশে রেখে, চোখে চোখ রেখে মুচকি হেসে রিকশায় করে দুজন চলতে থাকলাম। সে-ও কয়েকটা গান গেয়ে শোনাল। আমি চোখ বুজে আছি, অনেক বেশি ভালো গান করে মেয়েটা। অবশ্য প্রায়ই সে গান গেয়ে রেকর্ড করে পাঠায়। মন খারাপ হলে তার গান শুনতাম। রেকর্ড করা গানের গলা থেকে তার সামনাসামনি করা গান এত বেশি সুন্দর যে হৃদয় ছুঁয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু উচ্ছ্বাস বেশিক্ষণ টিকল না।

এই শহরের হাজারখানেক ফুটপাথ আর কান পেতে থাকা স্যাঁতসেঁতে দেয়াল, লাল-নীল রিকশাটা আর অজস্র অলিগলিকে সাক্ষী রেখে আমাদের গল্প শেষ হতে চলেছে গন্তব্যে এসে।

অরণি বাড়ি চলে যাচ্ছে। বাড়ি যাওয়ার গন্তব্য আমাদের ভিন্ন। সে অন্য গাড়িতে উঠে পড়ল। ওঠার আগে অভিবাদন করল আরেকটি বার। হাত নেড়ে বিদায় জানাল। মেয়েটা প্রচণ্ড খুশি আজ। চোখেমুখে বিজয়ের উচ্ছ্বাস। খুব সম্ভবত আমাদের অনেক দিন দেখা করার সুযোগ নেই আর, কখন দেখা হয়, সেটা বোধ হয় সময়ও জানে না। চাইলে তাকে আরও কিছুক্ষণ পাশে বসিয়ে রাখতে পারতাম। কিন্তু কেন যেন যেতে দিলাম! যাকে সারা জীবনের জন্য রেখে দিতে মরিয়া, তাকে এক বিকেলের জন্য রেখে দিয়েই-বা কী হবে?

তার গাড়ির জানলার ধারে দাঁড়িয়ে আছি অনেকক্ষণ। বৃষ্টি পড়ছে গুঁড়ি গুঁড়ি, বৃষ্টির ছটা এসে লাগছে আমার চোখেমুখে। হঠাৎ খেয়াল হলো, চোখ ভারী হয়ে আসছে। লোনাজল গড়িয়ে নামছে গাল বেয়ে।

তোমাকে দুফোঁটা চোখের জলের সঙ্গে বৃষ্টি পাঠালাম অরণি। তুমি জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে স্পর্শ করো আমার ভালোবাসা। আমাকে ছাড়া ভিজো না কিন্তু, জ্বর লেগে যাবে তোমার!

চট্টগ্রাম