সজীব ও নীহারিকার স্কুলে বিজয় দিবস উপলক্ষে একটি অনুষ্ঠান হবে। শিক্ষকেরা ঘোষণা দিয়েছেন, যারা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ভালো গল্প বলতে পারবে, তাদের জন্য পুরস্কার থাকবে। সজীব এই খবর শোনার পর থেকেই উত্তেজিত। কিন্তু সে জানে না কীভাবে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গল্প বলা যায়।
নীহারিকা বলল, ‘তোর দাদু তো মুক্তিযোদ্ধা, ওনার কাছ থেকে গল্প শুনে বললেই তো হয়।’
সজীব দাদুর কাছে গেল। দাদু তখন উঠানে বসে একটা পুরোনো ট্রাঙ্ক থেকে একটি বই বের করছেন। সে দাদুকে জিজ্ঞেস করল, ‘দাদু, তুমি মুক্তিযুদ্ধ করেছিলে, তাই না? আমাকে তোমার গল্প শোনাবে?’
দাদু মৃদু হেসে বললেন, ‘তোমার জন্যই তো এই ট্রাঙ্ক থেকে আমার পুরোনো ডায়েরি বের করলাম। বসো, তোমাকে শোনাই।’
সেদিন স্কুলের অনুষ্ঠানে সজীব তার দাদুর গল্প শোনাল। পুরো হলরুমে পিনপতন নীরবতা।
দাদু ডায়েরি খুললেন। তাঁর চোখে একধরনের আলো ঝিলমিল করছে। তিনি বলতে শুরু করলেন, ‘১৯৭১ সাল, আমি তখন ২০ বছরের তরুণ। দেশ তখন পাকিস্তানি শাসকদের অত্যাচারে পিষ্ট। গ্রামে গ্রামে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এসে মানুষকে নির্যাতন করত। আমার চোখের সামনেই অনেক নিরীহ মানুষকে ধরে নিয়ে গিয়েছে। আমি আর চুপ থাকতে পারিনি। কয়েকজন বন্ধু মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম যে আমরা মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেব।’
সজীব জিজ্ঞেস করল, ‘তোমরা কীভাবে যুদ্ধ করতে গেলে? তোমরা তো তখন অস্ত্র চালাতেও জানতে না!’
দাদু হেসে বললেন, ‘তোমার মতোই অজানা ছিল সবকিছু। কিন্তু সাহস ছিল। আমরা সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে গেলাম। সেখানে ট্রেনিং ক্যাম্পে অস্ত্র চালানো শিখলাম। শুরুতে খুব ভয় লাগত। কিন্তু মনে হতো, দেশকে বাঁচাতে হলে ভয় পেলে চলবে না। ট্রেনিং শেষ করে ফিরে এলাম বাংলাদেশে। তখন শুরু হলো আসল যুদ্ধ।’
দাদু থামলেন। তাঁর চোখে একধরনের বিষণ্নতা। তিনি ধীরে ধীরে বলতে থাকলেন, ‘যুদ্ধ শুধু বন্দুক চালানো নয়, অনেক কষ্টের গল্প। শীতের রাত, ক্ষুধা, মৃত্যুর ভয়—সবকিছু পেছনে ফেলে আমরা এগিয়ে যেতাম। একদিন আমাদের দলকে একটা ব্রিজ ধ্বংস করতে বলা হলো। সেটা দিয়ে পাকিস্তানি সেনারা আসত। বন্ধুরা ঝুঁকি নিয়ে কাজটা করলাম। ব্রিজ ধ্বংস করার পর আমাদের দলে অনেকেই আহত হয়েছিল। কিন্তু আমরা জানতাম, কাজটা করলে অনেক নিরীহ মানুষ বাঁচবে।’
সজীবের চোখ বড় বড় হয়ে গেল। সে বলল, ‘তুমি কি কখনো ভয় পেয়েছিলে?’
দাদু মাথা নাড়িয়ে বললেন, ‘ভয় পেতাম না, তা নয়। কিন্তু ভয়কে জয় করতে হতো। মনে হতো, আমাদের দেশ একদিন স্বাধীন হবে। ওই আশাই আমাদের শক্তি দিত।’
নীহারিকা তখন এসে যোগ দিল। সে জিজ্ঞেস করল, ‘তারপর কী হলো?’
দাদু বললেন, ‘৯ মাস যুদ্ধ চলল। অনেক প্রাণ গেল, অনেক ত্যাগ হলো। ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১—আমরা বিজয় পেলাম। পাকিস্তানি সেনারা আত্মসমর্পণ করল। সেদিন ঢাকা শহরের আকাশে লাল-সবুজ পতাকা উড়তে দেখলাম। আমি কেঁদে ফেলেছিলাম। এই মাটির জন্য যুদ্ধ করেছি, এই মাটি রক্ত দিয়ে রক্ষা করেছি।’
সজীব চুপচাপ শুনছিল। হঠাৎ বলল, ‘দাদু, তুমি তো আমাদের আসল নায়ক! আমি তোমার এই গল্প স্কুলে বলব।’
দাদু হেসে বললেন, ‘আমাদের মতো অনেক মানুষ ছিল, যারা যুদ্ধ করেছে। সবাই মিলে দেশকে মুক্ত করেছে। কিন্তু তোমাদের কাজ হলো এই দেশকে ভালোবাসা, এর সঠিক ইতিহাস জানা, আর ভবিষ্যতের সুরক্ষা করা।’
নীহারিকা বলল, ‘দাদু, তোমার এই গল্প শুনে আমি গর্বিত। তোমার মতো মুক্তিযোদ্ধারা না থাকলে আমরা তো আজ স্বাধীন থাকতে পারতাম না।’
সেদিন স্কুলের অনুষ্ঠানে সজীব তার দাদুর গল্প শোনাল। পুরো হলরুমে পিনপতন নীরবতা। শেষে সবাই হাততালি দিল। সজীব পুরস্কার পেল। তার চেয়ে বড় পুরস্কার হলো, সে বুঝতে পারল যে দাদু শুধু তার নয়, পুরো দেশের গর্ব।
দুপচাঁচিয়া, বগুড়া