বিষ্যুদবার

অলংকরণ: তুলি

ডাইনিং স্পেসজুড়ে ছড়ানো–ছিটানো শার্ট, লুঙ্গি, প্যান্ট। কোথাও কেউ নেই! অদ্ভুত বিষয় হলো, ময়ূরাক্ষী আর গুচ্ছ একসঙ্গে থাকার পরও এখানে ময়ূরাক্ষীর কোনো পোশাক নেই। ঘরের দরজা খোলা। বিছানা ফাঁকা। দুটো বালিশ কাছাকাছি থাকলেও গুচ্ছ ও ময়ূরাক্ষীর কেউই নেই সেখানে। দেয়ালঘড়ির জায়গায় একটা সাদা হাঁস উল্টো হয়ে ঝুলে আছে। ইলেকট্রিক চুলা দুই হাজার পাওয়ারে জ্বলছে। চুলার ওপর পাতিলের জায়গায় একটা জ্যান্ত বাগানবিলাসগাছে আগুনরঙা বাগানবিলাস ফুল ফুটে চলছে। চুলার পাওয়ার দুই হাজার থেকে ক্রমে বেড়ে যাচ্ছে। যত বাড়ছে তত দ্রুত এবং বেশি ফুল ফুটছে গাছটিতে। সুইচ বোর্ড বা প্লাগ খোলার সংযোগের নির্দিষ্ট স্থান নেই। তাপ বাড়তে থাকে। যে তাপ আস্তে আস্তে ছেয়ে ফেলে ময়ূরাক্ষীর মুখ! ময়ূরাক্ষী হাঁসফাঁস করতে থাকে, নড়তে পারে না, সরতে পারে না, কিছু বলতেও পারে না। জানালার কাচে হামাগুড়ি দেওয়া সূর্যের আলো ক্রমে বড় হতে থাকে। যা এসে পড়ে ময়ূরাক্ষীর মুখে। আলোকিত মুখ চেয়ে চেয়ে দেখছে গুচ্ছ।

অন্যদিকে ময়ূরাক্ষী দেখছে অদ্ভুত সব স্বপ্ন! গুচ্ছর চোখ আটকানো আলোমাখা মুখে…
শ্যামলা মুখের মায়াবী চোখে গাঢ় কাজল। এমন মায়াবী; যে মায়াবী মুখের জন্য অন্ধও তাকিয়ে থাকার দৃষ্টি চাইবে। অপলক তাকিয়ে থাকতে থাকতে মৃদু কণ্ঠে ময়ূরাক্ষীকে ডাকে। ময়ূরাক্ষী যেন গুচ্ছর বুক জমিনে বয়ে চলা রূপসী নদী। সেই নদীতে অনন্তকাল স্নানে নেমে ভেসে ডুবে বেঁচে যেতে চাইছে গুচ্ছ!

গুচ্ছ ফ্যাক্টরিতে প্রবেশ করতে করতে ময়ূরাক্ষীর ফোন...ঠিকমতো পৌঁছেছে কি না! গুচ্ছ ফোন রাখে। তাকিয়ে নেয় পুরু প্রাচীরের দিকে।

এই একটা নারী, যে নারী পুরো পৃথিবীকে একদিকে রেখে আরেক দিকে গুচ্ছকে রেখেছে, যুদ্ধ করেছে নিজের পরিবারের সঙ্গে। সব ছেড়ে পড়ে আছে তারই বুকে সদ্য প্রস্ফুটিত কোমল ক্যাওলা ফুলের মতো।

আলসেমি ছেড়ে গেলেও বুকের মধ্যে থেকে ময়ূরাক্ষীকে ছাড়িয়ে কিছুইতে কর্মক্ষেত্রে যেতে ইচ্ছা করছে না গুচ্ছর। তবু মনকে বোঝায়, বিষ্যুদবার আজ, চেষ্টা করবে তাড়াতাড়ি ঘরে ফেরার। কাল তো অফ ডে, পুরো দিন না হয় ময়ূরাক্ষীর গন্ধ নিয়ে কাটানো যাবে। ময়ূরাক্ষীকে জাগিয়ে তোলে, ফ্রেশ হয়ে খালি মুখেই বেরিয়ে পড়ে গুচ্ছ। অদ্ভুত স্বপ্নের কিছুই মনে নেই ময়ূরাক্ষীর। গুচ্ছের চলে যাওয়ার পথে দরজা লাগাতে লাগাতে উপদেশ দিতে থাকে, ‘দোকান থেকে খেয়ে নিয়ো, পানি খেয়ো ঠিকমতো, মাস্ক যেন খোলো না, মনে রেখো, ডাস্টে কিন্তু তোমার অ্যালার্জি।’

প্রায় দিন পাশের ইউনিটের ভাবিরা গুচ্ছ আর ময়ূরাক্ষীর ছেলেমানুষি ভালোবাসা নিয়ে হাসাহাসি করে। আজও ব্যতিক্রম হলো না। প্রাণের স্বামীকে বিদায় দিয়ে দোয়া পড়তে থাকে ময়ূরাক্ষী। একটা মানুষকে পাওয়ার আগে হারানোর ভয় থাকে জানত, পেয়েও হারানোর ভয় এত তীব্র হয়, পাওয়ার পরই বোঝা যায়!

দরজার ছিটকিনি লাগিয়ে নিজের রুমে ফিরেই জলদি স্নানে যায়। স্নানের প্রতিটি জলের ফোঁটা যেন গুচ্ছের হাত, ঠোঁট হয়ে ছুঁয়ে যায় ময়ূরাক্ষীর বাহুকে। স্নানঘরের দেয়াল হয় গুচ্ছের চোখ! সাবানের ফেনা আবেগপ্রবণ অপবিত্রতাকে ধুয়েমুছে সাফ করে দিলেও হৃদয় ও মন থেকে প্রিয় মানুষের স্পর্শ, চুমু, নিশ্বাস, গন্ধ—কোনো কিছুই মুছে দিতে পারে না। ভেজা চুলে তোয়ালে পেঁচিয়ে প্রথমেই চোখ ভর্তি করে কাজল দেয়। তারপর ছাদে ভেজা কাপড় শুকাতে দিতে যায়। অচেনা শহরে চেনা কেউ নেই। কারখানার মেশিনের শব্দ, প্রতিদিনের পাঁচটা টু আটটা বাজা ঘড়ির কাঁটা, আশপাশের ইটপাথরের স্থির হয়ে থাকা বিল্ডিং, বারান্দার ফুল গাছেরা, উড়ে আসা চড়ুই, বুলবুলি ও দু-একটা কাক, ঘরের দেয়াল আর রান্নাঘরটাই চেনা ও আপন। সর্বহারা দলের লোকজন যেমন মাটির নিচে লুকিয়ে থাকে আলো-বাতাসভরা জীবন বাদ দিয়ে, ওরাও তেমনই লুকিয়ে আছে চেনা মুখ, চেনা ঘর–পরিবার ফেলে। শুধু ভালোবাসাকে টিকিয়ে রাখতে, জিতিয়ে দিতে।

গুচ্ছ ফ্যাক্টরিতে প্রবেশ করতে করতে ময়ূরাক্ষীর ফোন...ঠিকমতো পৌঁছেছে কি না! গুচ্ছ ফোন রাখে। তাকিয়ে নেয় পুরু প্রাচীরের দিকে। গুচ্ছর ইচ্ছা করে না গার্মেন্টস নামক হাজতে ঢুকতে, তবু ময়ূরাক্ষীর মুখ বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে যায় শ্রমশিল্পী হিসেবে। ঘাম ঝরে, ঝরে যায় সময়, তবু মাস যেন সহজে আসে না। মাস গেলেও পাওনা বেতনের জন্য শ্রমিকদের কাঁদতে হয়, কখনো কখনো প্রাণও দিতে হয়! বেতনের কটা টাকায় চাল–নুন জোটানো যায়। বাসাভাড়া, গ্যাস বিল, কারেন্ট বিল, ময়লা বিল, পানি বিল—সবকিছু চুকিয়ে হাতে কিছুই থাকে না। গুচ্ছ যখন বাজারে যায় তখন তার কেবলই মনে হয়, নিজের মাথা, কলিজা বাজারের ব্যাগ ভর্তি করে নিয়ে যাচ্ছে। সেগুলোই রান্না শেষে ভাতের সঙ্গে চিবিয়ে খাচ্ছে। দ্রব্য নয় যেন, নিজের জীবন গিলে নিচ্ছে ঊর্ধ্বগতির বাজার!

দিন শেষে অন্তত ভেতর থেকে দরজা খোলার কেউ আছে, ভাবতেই হাওয়াই মিঠাইয়ের মতো সব ক্লান্তি, ঘাম, দেশের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, অস্থিতিশীল চোষক ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।

পুরুষের পাঁজর শান্ত করার মতো স্ত্রী যদি কপালে না জোটে, সে পুরুষ দুনিয়াতেই জাহান্নামের সাজা ভোগ করে। গুচ্ছ সেদিক দিয়ে সৌভাগ্যবান। ময়ূরাক্ষী একটু জেদি, ঘাড় ত্যাড়া হলেও তাকে ভালোবাসার হাতে কাদামাটির মতো যেমন খুশি তেমন আকার দেওয়া যায়। গুচ্ছর ভাবনাজুড়ে ময়ূরাক্ষী থাকায় শ্রম ঘাম ঝরানোর পরও গার্মেন্টসের গালিগালাজ মাথায় খুব বেশিক্ষণ টেকে না।

হোমিওপ্যাথিক ওষুধের ফোঁটার মতো করে সকাল থেকে বিকেল অব্দি ফোনে কথা, ভিডিও কলে দেখা, ছবি দেওয়া-নেওয়া করে নিজেকে সুস্থ রাখে। বিকেল পাঁচটা বাজার ১৫ মিনিট আগে গুচ্ছ যেন গিরিবাজ কবুতর হয়ে যায়, বন্দী খাঁচা থেকে বের হয় মুক্ত আকাশের খোঁজে। শুধু গুচ্ছ নয়, প্রত্যেক গার্মেন্টস শ্রমিক ছুটির আগমুহূর্তে ইবাদতের গুরুত্বের মতো করে ঘড়িকে গুরত্ব দেয়।

গুচ্ছ ও ময়ূরাক্ষীর ভালোবাসাকে হিংসা করে বারান্দার চড়ুই, দরজার পাপোশ, ঘরের দেয়াল, নিজেদের পোশাক, বিছানার চাদর, বালিশ ও কালো রঙের দেয়ালঘড়ি। ঘড়ি থেকে চোখ সরিয়েই ময়ূরাক্ষী জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়। দরজা খুলে উঁকি মারে। পাঁচটা বেজে গেছে, আজ অনেক ব্যস্ততা। চুলায় মুরগির গোশতকষা নামিয়েই উঠিয়ে দিয়েছে বিরিয়ানি। ময়ূরাক্ষীর হাতে রান্না করা বিরিয়ানি গুচ্ছর খুব পছন্দ। বেশ কিছুক্ষণ সময় পার হয়ে যায়। ঘড়িতে তখনো পাঁচটা বাজতে দেখে ময়ূরাক্ষী টুলে দাঁড়িয়ে ঘড়ির কাঁটা সারাতে যায়। হঠাৎ ঘড়ির কাঁটা উল্টা ঘুরতে থাকে, ঘড়ির মধ্য থেকে ধোঁয়া আর আগুনের উত্তাপ আসতে শুরু করে। যার জন্য ঘড়িটা হাত থেকে ফেলে দেয়! ময়ূরাক্ষীর মনে হয়, এমন কিছু তার সঙ্গে আগেও ঘটেছে! টাইলসের মেঝেতে ঘড়ি পড়েই কাচগুলো খান খান হয়ে যায়। ফোন হাতে নিয়ে গুচ্ছের নম্বরে ডায়ালের পর ডায়াল করতে থাকে। রিং হয়, ফোন রিসিভ হয় না। ৬-৭ বার রিং হওয়ার পরও যখন ফোন রিসিভ হয় না, ময়ূরাক্ষীর হাত–পায়ে কেমন যেন কাঁপুনি উঠতে থাকে।

ওদিকে শখের বিরিয়ানিতে আর মন বসে না। মনে মনে নিজেকে শান্ত করতে ভাবে, হয়তো আজ বৃহস্পতিবার বলে সহকর্মীদের সঙ্গে ক্যারম খেলতে গেছে! কিন্তু মন মানে না। এর আগেও এ রকমই এক বৃহস্পতিবারে বেতন আদায়ের জন্য আন্দোলনে নেমেছিল শ্রমিকপক্ষের হয়ে। পুলিশের লাঠিচার্জ, এমনকি প্রশাসন পেরে না ওঠায় বর্বরভাবে শ্রমিকপক্ষের ওপর গুলি চালিয়েছিল। গুচ্ছর কানের কাছে দিয়ে সাঁই করে বুলেট গিয়ে বিঁধেছিল ২৬ বছর বয়সী সুজনের বুকে। তবে কি আজও কোনো আন্দোলনে নেমে বিপদ হলো? ১৫ মিনিট বাদে গুচ্ছর নম্বর থেকে কলব্যাক আসে। ফোনে গুচ্ছের কণ্ঠ নয়। তার সহকর্মী রানার কণ্ঠ! অস্থির গলায় যখন জানতে চায় গুচ্ছ কোথায়?
ফোনের অপর প্রান্ত থেকে ভেসে আসে, ‘গুচ্ছর ফ্লোরে আগুন লেগেছে, ফোন আমার কাছে। গুচ্ছকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকা অবস্থায় ওর ফোন নিয়েছিলাম বাসায় ফোন দেওয়ার জন্য।’

এই সবকিছু বুকের মধ্যেই চাপিয়ে রেখে ময়ূরাক্ষীর সামনে এমন আচরণ করছে, যেন কিছুই হয়নি। জোর গলায় বলছে, ‘বউ, রান্না কিন্তু দারুণ হয়েছে।’

ময়ূরাক্ষী গরম তেলে পড়া তাজা কইয়ের মতো ছটফট করতে থাকে। বিরিয়ানির ঘ্রাণ নাকে আসতে আসতে হৃদয় পোড়ার গন্ধ ছোটে! এক দৌড়ে ময়ূরাক্ষী গিয়ে দাঁড়ায় গুচ্ছর কর্মস্থলে গেটের সামনে। লোকজনের প্রচুর ভিড়, চিৎকার–চেঁচামিচি। ভেতরে অন্ধকার। বিদ্যুৎ–সংযোগ ছিন্ন করা হয়েছে অগ্নিকাণ্ডের জন্য। গেটের ভেতরে বাইরের লোকেদের ঢুকতেও দিচ্ছে না। ময়ূরাক্ষী চিৎকার করে কাঁদছে আর বলছে, ‘আমাকে ভেতরে যেতে দিন...ভেতরে আমার কলিজা আছে। আমাকে ভেতরে যেতে দিন।’

দরজায় টোকা পড়ার শব্দে বোধ ফিরে দেখে, ময়ূরাক্ষী নিজেদের সদ্য সাজানো ঘরেই কাঁদছে। কান্নার আওয়াজ শুনে পাশের রুমের রেনি আপু এগিয়ে এসেছে। তাকে দেখে আরও জোরে কান্না আর কাঁপুনি বেড়েছে ময়ূরাক্ষীর। রেনি জিজ্ঞেস করায় বলে, ‘ওর গার্মেন্টসে আগুন লেগেছে। ওর ফোন তোমার ভাই রানার কাছে। ওকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।’
রেনি ছুটে যায় তার ঘরে, স্বামী এবং ভাইকে ফোন করে। রেনিদের সবাই ঠিক আছে।

চুলায় অযত্নে পড়ে আছে বিরিয়ানির কড়াই। পাতিলে ঝলমল করছে মুরগির গোশত। গুছিয়ে রাখা বিছানা হাসছে। আলমারিতে দুজনের ভাঁজ করা কাপড় জড়িয়ে–জাপটে ঠিকই আছে। ময়ূরাক্ষী কাঁদছে হাউমাউ করে। কী করবে, কোথায় যাবে, বুঝতে পারছে না। পরিবার ছেড়ে গুচ্ছকে আপন করেছে। নতুন সংসার সাজিয়েছে। পুতুল পুতুল সংসার এখনো সাজানো–গোছানো বাকি। এই অল্প সময়ের মধ্যেই একা হয়ে যাবে?

সব ছেড়ে ময়ূরাক্ষী ও রেনি যখন ছুটছিল গার্মেন্টসের দিকে, তখন গুচ্ছর নম্বর থেকে ফোন আসে। কাঁপা কাঁপা হাত আর জলভরা ঝাপসা চোখ নিয়ে ফোন রিসিভ করার আগে বারবার বলে, আল্লাহ এখন যেন গুচ্ছ কথা বলে।
ফোন রিসিভ করতেই অপর প্রান্ত থেকে ভেসে আসে গুচ্ছের কণ্ঠ! ‘আমি ভালো আছি পাগলী। কেঁদো না। এই তো, আরেকটু বাদেই ঘরে ফিরছি।’
ময়ূরাক্ষীর বিশ্বাস হয় না। চোখের সামনে ভেসে ওঠে, স্ট্রেচারে শুয়ে আছে গুচ্ছ। গা–হাত–পায়ে পোড়া দাগ। কণ্ঠটা কেমন যেন ছিল গুচ্ছর। আবার ফোন করে গুচ্ছকে। এবারও ৫-৭ বার রিং বাজে। গুচ্ছ রিসিভ করে না। আবারও বুকের ভেতর থেকে কাঁপুনি ওঠে ময়ূরাক্ষীর। রেনির ভাই রেনিকে ফোন করে বলে ময়ূরাক্ষীকে ঘরে নিয়ে যেতে, ওরা ফিরে আসছে।

ময়ূরাক্ষীর কান্না থামছে না। না জানি কত ভয় পেয়েছে গুচ্ছ! পুড়ে যায়নি তো কোথাও?
ধোঁয়ায় নিশ্চয়ই কষ্ট হয়েছে? নানা ভাবনা। ভাবতে ভাবতে গুচ্ছ চলে আসে। স্বামীকে ফিরে পেয়ে ময়ূরাক্ষী জড়িয়ে শিশুর মতো কান্না শুরু করে। স্ত্রীর কান্নার শব্দ ও জল যেন গুচ্ছর বুকের মধ্যে ধারালো চাকু হয়ে প্রবেশ করে।

পৃথিবীতে ভালোবাসার মানুষের চোখের জল, দুঃখ আর কান্না সহ্য করা যায় না। গুচ্ছ স্নান সেরে খেতে এলে বিরিয়ানি আর গোশত পাতে দিতে দিতে আবারও কেঁদে ওঠে ময়ূরাক্ষী। বলতে থাকে, ‘বলেছিলে আজ বিষ্যুদবার, তাড়াতাড়ি ফিরবে। এর আগেও আন্দোলনে গিয়ে মরতে মরতে বেঁচে ফিরেছ। সেদিন থেকেই বিষ্যুদবারে আমার ভয়। আজও বিষ্যুদবার। আজকে তুমি না ফিরে এলে এসব কে খেত? আমি কাকে খেতে দিতাম!’

খাবার মুখে তুলতে তুলতে গুচ্ছর নীরব চোখেও এক ফোঁটা জল হানা দেয়। হানা দেয় পুরুষ হওয়ার বিভৎস স্মৃতি! দাউ দাউ করে চারপাশে আগুন জ্বলছিল। বুকের মধ্যে তখনো জেগে উঠেছিল প্রিয়তমা স্ত্রীর মুখ, মা-বাবা ভাইয়ের মুখ। এই বুঝি তার শেষ নিশ্বাস। জানালা দিয়ে কোনোমতে ফোনটা ঢিল মেরে রানাকে বলে দিয়েছিল, ‘আমি না থাকলেও আমাকে পাগলীর কাছে পৌঁছে দিস। ফোনে ওর আর আমার সুখমাখা হাজার স্মৃতিঘেরা ছবি ভিডিও আছে। ফোনটা ওকে দিয়ে দিস।’ দম বন্ধ হয়ে আসছিল। পুরুষ হওয়ার দায়ভার যে কাঁধে নিয়েছিল, সেই কাঁধ কেমন যেন গলে যাচ্ছিল চিনির তৈরি বাহারি হাতি, ঘোড়া, মাছ ও ফুলের মতো!

এই সবকিছু বুকের মধ্যেই চাপিয়ে রেখে ময়ূরাক্ষীর সামনে এমন আচরণ করছে, যেন কিছুই হয়নি। জোর গলায় বলছে, ‘বউ, রান্না কিন্তু দারুণ হয়েছে।’ খাবারের প্রতি লোকমার সঙ্গে মৃত্যুর আগমুহূর্তগুলো গিলে খেতে খেতে আবারও নিজেকে জিম্মি করে ময়ূরাক্ষীর বুকে!

ভেসে ওঠে ভরা গাঙে একটি মাটির নৌকা, শ্রমের বইঠা, পুরুষের কাকতাড়ুয়াজীবনের জীবন ও দায়িত্বের ছায়া।

সিরাজগঞ্জ সদর, সিরাজগঞ্জ