জাটকা

নদীতে জাল ফেলে মাছ ধরছেন জেলেরা

দুপুর গড়িয়ে বিকেল হওয়ার উপক্রম। আজও উনুন জ্বলেনি রহিমের ঘরে। ছেলেপুলের পেট যেন পিঠের সঙ্গে লেগে আছে। প্রায় দুদিন পানি আর শুকনা চিড়া খেয়ে পার করছে রহিম ও তাঁর স্ত্রী। মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে এটা সেটা চেয়ে ছেলেপুলের ক্ষুধা নিবারণের চেষ্টা করছে তারা। ছোট ছেলেকে নিয়ে মহাবিপদে। দুধ ছাড়া ছেলেটা কিছুই খেতে পারে না। ছেলের কান্না সইতে না পেরে রহিমের বউ চুরি করে বসল। দুধ চুরি। পূর্বপাড়ায় রাখালেরা ছাগল চরায়। দুপুর গড়ালে রাখাল গাছের তলায় তন্দ্রা যায়, সেই সুযোগে রহিমের বউ ছাগলের দুধ চুরি করে। অবশ্য প্রথম দুই বাচ্চার মা হওয়ার পর দুধ কিনতে হতো না। তখন বুকে পর্যাপ্ত দুধ থাকত। পুষ্টিহীনতায় ভুগে পাঁচ সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে বউটার এমন দশা। রহিম ঘরে ফিরে দেখে ত্যানা দুধের বাটিতে ভিজিয়ে বউ ছেলের মুখে দুধ তুলে দিচ্ছে।

দুধ কোথা থেকে এল? জানতেও চাইল না রহিম।
কোনো ব্যবস্থা হলো? কি আর হবে রে বউ! মাছ ধরা ছাড়া যে আর কিছুই পারি না। বাপ–দাদা থেকে পাওয়া এই পেশা আর অভাবটাই তো পেয়েছি। তয়, মিয়াবাড়ির বড় মিয়া কইছে, নিষিদ্ধ এই মৌসুমেও খিদিরপুর চরে সে মাছ ধরার ব্যবস্থা করে দিতে পারবে!
দুইখান শর্ত আছে—পয়লা ধরো, বড় মিয়া নিজের জাল দেবে না, আর সাতখান মাছ পাইলে চারখান মিয়ারে দিতে হইব। ভাবছি, সন্ধ্যায় নামাজ পড়েই রওনা দেব। ভবেশ পুজো শেষ করে মন্দিরের সামনে এসে দাঁড়াবে, তারপর মিনিট চল্লিশেক দাঁড় টেনে খিদিরপুরে পৌঁছাতে হবে।
দু–চার মুঠো চিড়ে নিয়ে যেয়ো টেটনের বাপ।
চিড়ে খাওয়ার সময় কি পাইব রে বউ?
নিষিদ্ধ সপ্তাহ থাকায় ইলিশ নদীতে গিজগিজ করছে। বড় মিয়ার জাল হইলে কী যে হইতো রে ভবেশ! আমাগো ছেঁড়া জাল দিয়ে কি আর ইলিশ ধরন যায়? গরিবের কপাল রে ভবেশ্যা!

ভোর চারটা পর্যন্ত জাল টেনে তেইশটা মাছ পেল রহিম ও ভবেশ। পুব আকাশ লাল হতে না হতেই বড় মিয়ার ট্রলার হাজির। ছোঁ মেরে তেরোটা ইলিশ নিয়ে চলে গেল। পাঁচটা ভবেশকে দিয়ে দাঁড় টেনে গঞ্জের দিকে ছুটল রহিম ও ভবেশ। গঞ্জে পৌঁছে ভবেশ ইলিশের পোঁটলা বগলদাবা করে কাঁথা মুড়ি দিয়ে হাটের ভিড়ের মধ্যে মিলিয়ে গেল। রহিম গিয়ে দাঁড়াল হাটের পশ্চিম কোণে কবরস্থানের গলিতে।
যেখানে বাঘের ভয় সেখানে রাত পোহায়, কথাটি আজ রহিম হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারল। মাছের পোঁটলা খুলতেই দুজন পুলিশ হাজির। রহিমকে লাঠি ও চড়-থাপ্পড়ের ভয় দেখিয়ে দুটি ইলিশ নিয়ে গেছে। ইলিশের ঘ্রাণ থানার বড় বাবুর নাকেও পৌঁছে গেল।
বড় বাবু তৎক্ষণাৎ কবরস্থানের গলিতে আসেন। লাঠি দিয়ে রহিমের পিঠে আঘাত করেন, সঙ্গে তিনটি ইলিশও ছিনিয়ে নেন। একটি ইলিশ কনস্টেবলকে দিয়ে দুটি নিজের বাসায় পাঠিয়ে দেন। আর দুটি ইলিশ জাটকা হিসেবে জব্দ করে রহিমকে জেলে পুরে দিল। জেলের মধ্যে বড় বাবুর সঙ্গে রহিমের দুই মিনিট কথা হয়।
রহিম, তোমাকে ছেড়ে দেব, যদি আমি যা যা বলি তা মেনে নাও।
বাবু, আমি সব শর্তে রাজি।

ছোট ভাই পরশ মিয়া হাতেনাতে জাটকাসহ ম্যাজিস্ট্রেটের হাতে ধরা খাইছে। পরশ মিয়ার দায় যদি নিজের কাঁধে নাও, তবে তোমার পোলার বউ ভালো থাকবে। তুমিও জামিনে খালাস পাবা।
বড় বাবু পরশ মিয়াকে ছেড়ে দিল। আর রহিমকে রাখল পরশ মিয়ার সেলে।
দিন গিয়ে রাত এল, রহিমের কোনো খোঁজ নেই। তাঁর বউ দৌড়ে গেল মিয়া বাড়ি।
বড় মিয়া বলল, ‘তোমার স্বামীকে মাছ ধরতে চাঁদপুর পাঠাইছি। ফিরতে কয়েক মাস লাগবে। টাকাপয়সা আর যা যা লাগে পরশের কাছ থেকে নিয়ে যাবা।’ জবাবে রহিমের বউ বলল, আচ্ছা! বড় মিয়া।
৯ মাস পার হয়ে গেছে। রহিম এখনো ফেরেনি। অপেক্ষায় পথ চেয়ে বসে থাকে তাঁর স্ত্রী। সন্তানেরা জানে না বাবা কবে আসবে!