অধিকাংশ শিশুর মুখের প্রথম উচ্চারিত শব্দ হয় ‘মা’। আমার ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হয়েছিল। সবাই বলে, আমি নাকি সবার আগে ‘বাবা’ শব্দ উচ্চারণ করেছিলাম।
কয়েক বছর আগের ঘটনা। বাবা হঠাৎ হৃদ্রোগে আক্রান্ত হন। রাত তখন দুইটা। গ্রামে থাকায় যাতায়াতব্যবস্থা ভালো ছিল না। বাড়িতে শুধু আমি আর মা। অনেক কষ্টে স্থানীয় একটি হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। চিকিৎসকেরা জানান, রোগীর অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় তাঁরা ভর্তি করাবেন না। যত দ্রুত সম্ভব ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিলেন।
ঢামেক নেওয়ার পর হাসপাতালে সিট পাওয়া গেল না। তারা পাঠিয়ে দিল জাতীয় হৃদ্রোগ ইনস্টিটিউটে। সেখানে ভর্তি করানো হলো। চিকিৎসকেরা জানান, অবস্থা ভালো নয়, তবু তাঁরা চেষ্টা করছেন।
আমি হাসপাতালের করিডরে বসে আছি। আধো আলো, আধো অন্ধকার। বাইরে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। মনে পড়ল ছোটবেলার কথা। বাড়ি থেকে বেশ দূরে ছিল বাবার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। সকাল সাতটায় যেতেন, ফিরতেন রাত আটটায়। যেদিন রাতে ঝড়-বৃষ্টি হতো, আমি হাউমাউ করে কান্না করতাম; বাবা কীভাবে বাসায় ফিরবে, এ চিন্তায়।
বৃষ্টি হলেই গ্রামে বিদ্যুৎ চলে যায়। মুঠোফোনে নেটওয়ার্ক সমস্যা করত। এ কারণে কল দিলে সংযোগ বিচ্ছিন্ন দেখাত। চিন্তা আরও বেড়ে যেত। যত রাতই হোক, বাবা ফেরার আগপর্যন্ত ঘুমাতাম না। দরজায় ঠকঠক শব্দ শুনলে দৌড়ে গিয়ে খুলে দিতাম। দেখতাম বাবা দাঁড়িয়ে আছেন, জড়িয়ে ধরতাম ওনাকে। পৃথিবীর সব সুখ যেন বাবার মধ্যে খুঁজে পেতাম।
পৃথিবীর সবচেয়ে কষ্টের ব্যাপার হচ্ছে সুখ হারিয়ে যেতে দেখা। হাসপাতালের করিডরে বসে এসব ভাবছিলাম। হঠাৎ ভেতর থেকে কান্নার শব্দ ভেসে এল। কেউ হয়তো মারা গিয়েছে। বুকটা মুহূর্তেই কেঁপে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে নামাজে দাঁড়ালাম, দুই হাত তুলে সৃষ্টিকর্তাকে বললাম, ‘আল্লাহ, তুমি আমার জীবনের বিনিময়ে হলেও বাবার জীবনটা ফিরিয়ে দাও। আমি বেঁচে থাকতে বাবার হারিয়ে যাওয়া মেনে নিতে পারব না।’
কিছুদিনের মধ্যেই বাবা সুস্থ হয়ে উঠলেন। হাসপাতালে থাকাকালে তিনি সারাক্ষণ আমার হাত ধরে থাকতেন। আমিও কখনো বাবার কাছ থেকে দূরে যেতাম না।
আজকাল মনে হয়, কবে যে এত বড় হয়ে গেলাম বুঝতেই পারিনি। গুটিগুটি পায়ে বাবার সঙ্গে চলতে চলতে আজ তাঁর দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছি। তবু কখনো বলা হয়ে ওঠেনি, ‘বাবা, তোমায় খুব করে ভালোবাসি। তুমি ছাড়া যে আমি নিঃস্ব।’
সাধারণ সম্পাদক, কেরানীগঞ্জ বন্ধুসভা