ভাটির দেশে মাটির ছবি ‘কুড়া পক্ষীর শূন্যে উড়া’

‘কুড়া পক্ষীর শূন্যে উড়া’ সিনেমার একটি দৃশ্যছবি: সংগৃহীত

ট্রেলার দেখার পর থেকে মন কেমন করতে শুরু করেছিল। কংক্রিটের শহরে আমাদের শিকড়গুলো যেন পাথরচাপা পড়ে থাকে। মাটির সন্ধান পেলে তরতরিয়ে ছোটে। আকুলি–বিকুলি মনের প্রাণ সন্ধান ও নিজেকে হারিয়ে খুঁজে পাওয়ার একটা ছবি ‘কুড়া পক্ষীর শূন্যে উড়া’।

আমরা অনেকে চোখের সামনে অনেক কিছু দেখি। কিন্তু দেখেও দেখি না। একজন শিল্পী, কবি ও একজন পরিচালক কখনো কখনো এমনভাবে সেই চেনা ও দেখা দৃশ্য চোখের সামনে এনে হাজির করেন; ভাবনায় দোলা লাগে। মোরগের মাথায় ঝুঁটি, মোরগঝুঁটি ফুল আমরা কতই–না দেখেছি। সেই মোরগঝুঁটিকে কবি যদি লাল নিশানের মতো করে ওড়াতে পারেন, সাংকেতিক রূপ দিতে পারেন; তখন আমাদের মনের কেতনে এসে হাওয়া লাগে।

সেই মোরগ, সেই কুড়া এবার শূন্যে উড়াল দেবে মুহাম্মদ কাইউমের চলচ্চিত্রে। অসীম শূন্যে। যেখান থেকে জীবনের প্রাণকেন্দ্র নিয়ন্ত্রিত হয়। অথচ তার কোনো মূর্ত সত্তা নেই। দেখনদারি ভূমিকা নেই। এই যে জল, নদী; নদীর ওপর সকাল-দুপুর-সন্ধ্যা-রাতের প্রতিফলন। এই যে মেহনতি মানুষের জীবনসংগ্রাম। বড় বড় ঢেউয়ের সঙ্গে মানুষের লড়াই। হাসি-কান্না, বেদনা-চিৎকার, হাহাকার। এই যে লোককথা, লোকগান, জীবনের শিক্ষায় ভেঙেচুরে গুঁড়িয়ে, মেরুদণ্ড সোজা করে ফের উঠে দাঁড়ানো। বেঁচে থাকা, মরে যাওয়া, চরম ধস নামা। স্রোতে পাড় ভেঙে যাওয়া। শিকড় হড়কে ভেসে যাওয়া। জেগে ওঠা চরে ধ্বংসযাপন।

ফসলের হাসি। সৃষ্টির বাণী। ক্ষতের সঙ্গে অক্ষতের, লৌকিকতার সঙ্গে অলৌকিকের বহুমাত্রিক সন্ধান। এই যে আচার–অনুষ্ঠানে, উৎসব–পার্বণে বেঁচে ওঠা। প্রাণের সঙ্গে প্রাণের পরিণয়। জেগে ওঠার আপ্রাণ চেষ্টা।
যদিও তারা চলমান জীবনের বিপুল জনগোষ্ঠীর, লোকচক্ষুর আড়ালে। পিঁপড়ে নামক ক্ষুদ্র প্রাণ; তারাও তো এ পৃথিবীতে বেঁচে থাকে। মানুষেরাও সেভাবে প্রান্তিক, বেঁচে আছে। সীমার মাঝে অসীমের সেই বার্তা আবার যেন দেওয়ার চেষ্টা করলেন পরিচালক।

হাওরাঞ্চলের মানুষের বারোমাস্যা যাপন নিয়ে গড়ে উঠেছে এ চলচ্চিত্র। জীবন আর প্রাণের সন্ধান নিয়ে এ চলচ্চিত্র। কারণ, শুধু মানুষ নয়, নদী–জল–গাছপালা এমনকি ভাসমান ঘাস, আকাশ আর জলের তরঙ্গ সবকিছুর অন্তর্নিহিত প্রাণ নিয়ে এর গল্প এগিয়েছে।

বছরে ছয় মাস যে অঞ্চল জলে ডোবা থাকে। জীবন, মরণ, আয়, ব্যয়, সঞ্চয়, সর্বোপরি মারণক্ষুধা, সবকিছুর পুঁজি বলতে শুধু ধান। ফলনের হাসিতে জীবন রাঙিয়ে যায়। পরক্ষণে ভয়, আসতে চলেছে সেই ভয়াবহ চেনা দুর্যোগ জলোচ্ছ্বাস। সাম্পান যেভাবে ভেসে চলে। ভেসে ভেসে কূলে গিয়ে ভেড়ে। কূলহীন মানুষের এভাবে পারাপারে ভেসে ভেসে টিকে থাকার পালা।

বাংলা লোকগানের দুই প্রাণপুরুষ হেমাঙ্গ বিশ্বাস আর রাধারমণ দত্তের গান এসেছে প্রাণের টানে। ভাটির দেশে মাটির ছবি এই ‘কুড়া পক্ষীর শূন্যে উড়া’। গ্রামবাংলার প্রান্তিক মানুষের চিরন্তন জীবনসংগ্রাম নিয়ে এক মহাকাব্যিক আখ্যান। সাড়ে তিন বছর ধরে একটু একটু করে গড়ে উঠেছে সিনেমাটিক রূপ।