ভাদ্র মাস। তীব্র দাবদাহ। এই গরমে সবচেয়ে বেশি কষ্ট পান বয়োবৃদ্ধরা। তাঁদের ওষ্ঠাগত জীবন রক্ষার্থে গামছা জলে ভিজিয়ে গা ঢেকে দেওয়া হয়। এর নাম জলগামছা। ছোটবেলায় আমরা চার ভাইবোন গরমে ছটফট করতাম। আমাদের শরীর বেয়ে জল নামত। বাবা গভীর রাত পর্যন্ত তালপাখা দিয়ে বাতাস করতেন। শেষ রাতে যখন প্রকৃতি একটু শীতল হতো, তখন বাবা ঘুমাতে যেতেন।
আমাদের অঞ্চলে ধানের ভালো ফলন হওয়ায় সরকার সেচের সুবিধার জন্য বিদ্যুৎ দিয়েছে। বিত্তবানেরা গরমের হাত থেকে বাঁচতে ফ্যানের দোকানে ভিড় করতে লাগলেন। বাবাকে প্রায়ই বলতাম ফ্যানের কথা। বাবা বলতেন, ‘আরেকটু সবুর কর বাপ। ফসল না উঠলে হাতে টাকা আইব কোত্থেকে?’ মতিনদের বাড়িতে গত সপ্তাহে সিলিং ফ্যান লাগিয়েছে। স্কুলে গেলেই মতিন সেই গল্প রসিয়ে রসিয়ে করে বেড়ায়। আমি ওকে বলেছি, ‘দেখিস আমার বাবাও একদিন...’
আমি জানতাম, অত সহজে সে সামর্থ্য আমার বাবার হবে না। এক জোড়া স্কুল-জুতা কিনে দিতেই তার কী যে কষ্ট হয়েছে, সেটা জানি। ফসল উঠলেই যে বাবা ফ্যান কিনতে পারবেন, তা ভাবারও কোনো কারণ নেই। মহাজনদের টাকা শোধ করলেই তো বাবা নিঃস্ব হয়ে যাবেন। রহিম হাওলাদার প্রায়ই বাড়িতে এসে তাগাদার নামে হুমকি ধামকি দেয়, গালমন্দ করে। আমরা চুপ করে থাকি। শুধু বড় আপা কাঁদেন।
এক হাটবারের কথা। বাবা হাটের দিন একটু দেরি করে বাড়িতে ফিরতেন। আমরা অপেক্ষায় থাকতাম, যদি কিছু নিয়ে আসেন! বাবা বাজারের ব্যাগ নিয়ে বাড়িতে ফিরলেন। মুখ হাসি হাসি। রহস্যময় ভঙ্গিতে আমাদের ডাকলেন, ‘কইরে আমার সৈন্য–সামন্তরা?’ আমরা ছুটে এলাম। বাবা ব্যাগ খুললেন। কাগজে মোড়ানো চকচকে নতুন সিলিং ফ্যান। আমরা সবাই হতভম্ব। আমাদের বাড়িতে এত বড় আনন্দের ঘটনা এর আগে আর ঘটেনি। বাবা নিজেই ফ্যান লাগালেন। সুইচ দিতেই ফ্যান ঘুরতে শুরু করল। আহা কী বাতাস! বাবা বললেন, ‘নে এবার ঘুমা, আরাম করে ঘুমা।’
সেই ফ্যান আমরা মোট চার দিন ব্যবহার করতে পেরেছিলাম। পঞ্চম দিন রহিম হাওলাদার তার লোকজন নিয়ে হাজির। এসেই হুংকার, ‘দুই বছরে পাওনা টাকা সুদে–আসলে কত হইছে, তার খোঁজ আছে? আমার টাকা না দিয়া ফ্যান কিননের সাহস তোর ক্যামনে হইল? ওই দাঁড়ায়া কী দেখস? ফ্যান খুল।’
আমাদের সবার সামনেই মহাজন ফ্যানটা খুলে ফেলল। বাবা অনেক অনুনয়–বিনয় করে বলেছিলেন, ‘আমার ছোট ছোট পোলাপাইন গরমে ছটফট করে...।’
‘আমার সব টাকা সুদে–আসলে বুঝায়া দিয়া ফ্যান নিয়া আরাম কইরা হাওয়া খাইস।’
আমরা হাঁ করে তাকিয়ে রইলাম ফ্যানের দিকে। শুধু বাবার চোখ বেয়ে অবিরল ধারায় জল নামল। সে দৃশ্য বড়ই করুণ। বড়ই নির্দয়!
এসি বন্ধ করে এখন আমি মাঝেমধ্যেই সিলিং ফ্যান চালু করে তাকিয়ে থাকি। সেদিনের সেই শীতল বাতাস জীবনে আমি আর কোথাও পাইনি! চোখের জল দেখা যায়। কিন্তু হৃদয়ের রক্তক্ষরণ কি দেখা যায় বাবা?
গুলবাগ, মালিবাগ, ঢাকা