ফুটবল ইতিহাসের সেরা গোলকিপার কে

জিয়ানলুইজি বুফন, ইকার ক্যাসিয়াস ও ম্যানুয়েল নয়্যারছবি: সংগৃহীত

সদ্য পেশাদার ফুটবল ক্যারিয়ার থেকে অবসর নিয়েছেন ইতালিয়ান কিংবদন্তি গোলকিপার জিয়ানলুইজি বুফন। ২৩ বছরের অবিশ্বাস্য ক্যারিয়ার শেষ করার সময় তাঁর বয়স হয়েছে ৪৫ বছর। জিতেছেন বিশ্বকাপসহ অসংখ্য শিরোপা। নিজেকে নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়। কেউ কেউ বলে থাকেন, তিনিই ইতিহাসের সর্বকালের সেরা গোলকিপার।

যদিও এ নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে। কারণ, আরও কয়েকজন গোলকিপারকে ইতিহাসের সর্বকালের অন্যতম সেরা বলা হয়ে থাকে। তাঁরা সবাই নিজ নিজ সময়ে সম্ভাব্য সবকিছু অর্জন করেছেন। এর মধ্যে স্পেনের বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক ইকার ক্যাসিয়াস, জার্মানির ম্যানুয়েল নয়্যার, ইতালিয়ান কিংবদন্তি দিনো জফ অন্যতম।

এডউইন ফন দের সার

সম্প্রতি ফুটবলবিষয়ক জনপ্রিয় ওয়েবসাইট গোলডটকম, ইতিহাসের সর্বকালের সেরা ১০ জন গোলকিপারের তালিকা তৈরি করেছে। চলুন দেখে নেওয়া যাক—

পিটার শিল্টন
দীর্ঘ সময় পেশাদার ফুটবল ক্যারিয়ারের দিক বিবেচনা করলে পিটার শিল্টনের ধারেকাছে আর কেউ নেই। তিনি তিন দশকের বেশি সময় ধরে ইংল্যান্ড জাতীয় দলসহ বিভিন্ন ক্লাবকে সার্ভিস দিয়েছেন। এমনকি ১৯৯০ সালের বিশ্বকাপে বয়স ৪০ হওয়া সত্ত্বেও ইংল্যান্ডের প্রথম পছন্দ ছিলেন এই গোলকিপার। ১৯৭৯ ও ১৯৮০ সালে টানা দুবার তাঁর অসাধারণ নৈপুণ্যের কারণে ইউরোপিয়ান কাপ জয় করে নটিংহাম ফরেস্ট।

এডউইন ফন দের সার
১৯৯৫ সালে চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতেছিল ডাচ ফুটবল ক্লাব অ্যাজাক্স। সেই দুর্দান্ত দলটির গোলকিপার ছিলেন এডউইন ফন দের সার। তারপর তিনি জুভেন্টাস ও ফুলহামের হয়ে খেলেন। সেখানেও নিজের সেরা পারফরম্যান্স দেখান। ২০০৮ সালে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের হয়ে আবারও চ্যাম্পিয়নস লিগ জয় করেন এই ডাচ তারকা। সেবার ফাইনালে ম্যাচসেরা হয়েছিলেন তিনি। সবচেয়ে বয়স্ক ফুটবলার হিসেবে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ জয়ের কৃতিত্ব আছে তাঁর। ২০১১ সালে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের হয়ে প্রিমিয়ার লিগ জয়ের সময় এডউইন ফন দের সারের বয়স ছিল ৪০ বছর।

প্রিমিয়ার লিগ ইতিহাসে গোলকিপারদের মধ্যে প্রথম গোল করেন পিটার স্মাইকেল
ফাইল ছবি : এএফপি

ইকার ক্যাসিয়াস
মাত্র ১৮ বছর বয়সে রিয়াল মাদ্রিদের প্রথম একাদশে সুযোগ পেয়ে যান ইকার ক্যাসিয়াস। ২০০০ সালে চ্যাম্পিয়নস লিগ জয়ের সময় তাঁর বয়স ছিল মাত্র ১৯ বছর। একই বয়সে স্পেন জাতীয় দলের প্রথম পছন্দ বনে যান তিনি।

ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা আন্তর্জাতিক দল বলা হয় ২০০৮-২০১২ সালের মধ্যে স্পেনের ইউরো-বিশ্বকাপ-ইউরো জেতা স্কোয়াডটিকে। সেই দলের অধিনায়ক ছিলেন ক্যাসিয়াস। ২০১৫ সালে রিয়াল মাদ্রিদ ছেড়ে পোর্তো যাওয়ার আগে ক্লাবটির হয়ে আরও দুবার চ্যাম্পিয়নস লিগ জয় করেন এই কিংবদন্তি। তাঁর সম্পর্কে একবার জিয়ানলুইজি বুফন বলেছিলেন, ‘সত্যি বলতে, সে কতটা দুর্দান্ত তা প্রকাশ করার জন্য আমার ভাষা নেই। ফলাফলই তাঁর পক্ষে কথা বলে।’

পিটার স্মাইকেল
অবিশ্বাস্য শারীরিক গঠন, মেন্টালিটি এবং গোলপোস্টের সামনে তৎপরতার জন্য বিখ্যাত ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের এই কিংবদন্তি। তিনি প্রতিপক্ষে ফরোয়ার্ডদের জন্য আতঙ্কের নাম ছিলেন। দূরে বল নিক্ষেপ করার জন্যও তাঁর খ্যাতি ছিল; যা কাউন্টার অ্যাটাক করতে দলের খেলোয়াড়দের জন্য সহজ করে দিত। পিটার স্মাইকেল ছিলেন প্রকৃত বিজয়ী। ওল্ড ট্রাফোর্ডে থাকাকালে রেড ডেভিলসদের হয়ে ১৫টি শিরোপা জয় করেন। তবে সবচেয়ে বড় সফলতা সম্ভবত ১৯৯২ সালে ডেনমার্কের হয়ে ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ জয় করা।

গর্ডন ব্যাঙ্কস

গর্ডন ব্যাঙ্কস
ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা সেভ করার জন্য বিখ্যাত গর্ডন ব্যাঙ্কস। ১৯৭০ সালের মেক্সিকো বিশ্বকাপে ব্রাজিলের বিপক্ষে পেলের একটি দুর্দান্ত শট দারুণ ক্ষিপ্রতায় আটকে দেন তিনি। এতে অবশ্য গোলবারের সহায়তাও ছিল। তারপরও এই সেভটি এখনো ইতিহাসের অন্যতম সেরা হিসেবে বিবেচিত হয়। এতটাই দুর্দান্ত ছিল যে পরে পেলে বলেছিল, ‘আমি যা দেখেছি তা এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না!’ ওই শট দেওয়ার পর গোল হয়েছে ভেবে উদ্‌যাপনও শুরু করে দিয়েছিলেন পেলে।

১৯৬৬ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত টানা ছয় বছর ফিফার বর্ষসেরা গোলকিপার নির্বাচিত হয়েছিলেন ইংলিশ এই কিংবদন্তি। পরবর্তী সময়ে অবশ্য এক দুর্ঘটনায় চোখের সমস্যায় পড়ে ক্যারিয়ার আর বড় করতে পারেননি তিনি।

সেপ মায়ার
নিজেদের ইতিহাসের সেরা সময়ে পশ্চিম জার্মানি ও বায়ার্ন মিউনিখের ১ নম্বর তারকা ছিলেন সেপ মায়ার। নিজ দেশের হয়ে ১৯৭২ সালে ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ এবং ১৯৭৪ সালে বিশ্বকাপ জয় করেন তিনি। পাশাপাশি ১৯৭৪ থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত ক্লাবের হয়ে তিনবার ইউরোপিয়ান কাপ জয় করেন।

দিনো জফ

ম্যানুয়েল নয়্যার
বায়ার্ন মিউনিখ ও জার্মানির হয়ে গোলকিপারের সংজ্ঞাকে পুরোপুরি পাল্টে দিয়েছেন ম্যানুয়েল নয়্যার। তিনি কেবল গোলকিপারের দায়িত্বই পালন করেন না; দলের জন্য ডিফেন্ডারের কাজও করেন এবং পেছন থেকে বল সাজিয়ে দেওয়ার অন্যতম কারিগর।
ব্যক্তিগত পারফরম্যান্স বিবেচনা করলে নয়্যার বর্তমান প্রজন্মের গোলকিপারদের জন্য আদর্শ। ২০১৪ সালে জার্মানির হয়ে জয় করেন বিশ্বকাপ। ওই বছর সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত পুরস্কার ব্যালন ডি’অরের তালিকায় তৃতীয় হন এই কিংবদন্তি।

দিনো জফ
সবচেয়ে বয়স্ক ফুটবলার হিসেবে বিশ্বকাপ জয়ের রেকর্ড এখনো তাঁর। ১৯৮২ সালে স্পেন বিশ্বকাপে ইতালির হয়ে বিশ্বকাপ জয়ের সময় দিনো জফের বয়স ছিল ৪০ বছর। ইতালিয়ান এই কিংবদন্তি ১৯৬৮ সালে ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপও জয় করেন। পাশাপাশি জুভেন্টাসের হয়ে ছয় বার সিরি-এ শিরোপা জিতেন।

চাপের মুখে শান্ত থাকতে পারতেন দিনো জফ। খেলা নিয়ে তাঁর মেধাও ছিল প্রখর। তাঁকে নিয়ে ইতালির সাবেক কোচ এনজো বিয়ারজোট বলেছিলেন, ‘ম্যাচের সবচেয়ে কঠিন মুহূর্তেও শান্ত থাকার দারুণ ক্ষমতা রয়েছে তার। সব সময় সৎ থাকত। এ জন্য প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়েরাও তাকে সম্মান করত।’

লেভ ইয়াসিন

লেভ ইয়াসিন
ইতিহাসের একমাত্র গোলকিপার হিসেবে ব্যালন ডি’অর জয়ের কৃতিত্ব রয়েছে লেভ ইয়াসিনের। ফুটবল ইতিহাস ও পরিসংখ্যানের আন্তর্জাতিক ফেডারেশন (আইএফএফএইচএস) কর্তৃক ২০ শতকের সেরা গোলকিপার নির্বাচিত হয়েছেন এই রুশ তারকা। ১৯৯৪ সাল থেকে বিশ্বকাপের সেরা গোলকিপার অ্যাওয়ার্ড ‘লেভ ইয়াসিন অ্যাওয়ার্ড’ হিসেবে নামকরণ হয়ে আসছে।

লেভ ইয়াসিন সম্পর্কে গর্ডন ব্যাঙ্কস একবার বলেছিলেন, ‘সে যা কিছুই করেছে সব বিশ্বমানের। আগামী ১০-১৫ বছর সে সব গোলকিপারের জন্য আদর্শ। এমনকি আমি যদিও এরই মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে খেলেছি, তারপরও তাঁর কাছ থেকে শিখছি।’

জিয়ানলুইজি বুফন
টিনএজ বয়সে এসি মিলানের বিপক্ষে বিখ্যাত সিরি-এ অভিষেক থেকে শুরু করে জুভেন্টাসকে ঐতিহাসিক টানা আটবার শিরোপা জেতানো; জিয়ানলুইজি বুফন এমন কিছু অর্জন করেছেন, যা অবিশ্বাস্য। তাঁকে নিয়ে ইকার ক্যাসিয়াস একবার মন্তব্য করেছিলেন, ‘তাঁর খেলায় কোনো দুর্বলতা খুঁজে পাওয়া প্রায় অসম্ভব।’

বুফনের ক্যারিয়ারের সেরা অর্জন সন্দেহাতীতভাবে ২০০৬ সালে ইতালির হয়ে বিশ্বকাপ জয়। যদিও তাঁর ক্যারিয়ারে কোনো চ্যাম্পিয়নস লিগের শিরোপা নেই। তবু ফুটবলে তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে কারও সন্দেহ নেই। কারও কারও মতে, ইতিহাসের সেরা গোলকিপার বুফন।