অপুরা ‘অপরাজিত’ হয়ে থাকে এই ত্রিভুবনে

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘অপরাজিত’
‘অপরাজিত’ উপন্যাসে উঠে এসেছে গ্রামের সহজ–সরল জীবন, বাংলার সুন্দর প্রকৃতির রূপ, সহজ জীবনের নানা রং, গ্রামের মানুষের স্নেহ, আদর আর ভালোবাসা।

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পথের পাঁচালী’ পড়া শেষ করার পর শুধু ভাবতাম, না জানি কী হয়েছে অপুদের? দুর্গার মৃত্যুতে কষ্ট পেয়েছিলাম। দুর্গার মৃত্যুর পর অপুরা কাশীতে চলে গিয়েছিল। কাশীতে হরিহর বাবুর মৃত্যুর পর তাদের স্থান হয় রায়চৌধুরীর বাড়িতে।

তারপর ‘অপরাজিত’ পড়ার মাধ্যমে বাকিটা জানলাম। জীবনের নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আপন মানুষজন হারিয়ে শত অপমান, ক্ষুধা, দারিদ্র্যকে জয় করে কীভাবে অপু এই ত্রিভুবনে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে, সেটাই প্রকাশ পেয়েছে ‘অপরাজিতা’ উপন্যাসে।

রায়চৌধুরীর বাড়ি থেকে দূরসম্পর্কের আত্মীয় ভবতারণ চক্রবর্তীর মনসাপোতা গ্রামের বাড়িতে গিয়ে নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখেছেন মা ও ছেলে। অপু গ্রামের দুই ক্রোশ পথ পাড়ি দিয়ে স্কুলে পড়াশোনা করেছে। সেখান থেকে প্রথম হয়ে মাসিক পাঁচ টাকা স্কলারশিপ পেয়ে দেওয়ানপুর মহকুমার বোডিং স্কুলে পড়াশোনা করেছে। মাসিক খরচ সামলাতে না পেরে বোডিং খরচ বকেয়া পড়েছে। হেডমাস্টারের সহযোগিতায় ডেপুটির বাড়িতে লজিং মাস্টার থেকে পড়াশোনা চালিয়েছে। সেখানে গৃহকর্ত্রীর মমতা–স্নেহ আর আদর মায়ের কষ্ট ভুলিয়েছে। নির্মলার পরমযত্ন আর ভালোবাসা সারা জীবন মনে রাখার মতো সাক্ষী হয়েছে।

সেখান থেকে পাস করে অপু কলকাতায় গিয়েছে। কলকাতার রিপন কলেজে ভর্তি হয়েছে। কলকাতা পড়াশোনা করতে গিয়ে জীবনের কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয়েছে অপুকে। ক্ষুধার জ্বালা, থাকার অসুবিধা, পড়ার কষ্ট, আপন মানুষজনদের নীরব ব্যবহার, বকেয়া পড়ায় খাবারের কষ্ট, ঠাকুরবাড়িতে সন্ধ্যার আরতি শেষ হওয়ার পর রাতের ফ্রি খাবারের অপেক্ষা, কষ্ট পেলেও কারও কাছে নিজের অসহায়ত্বের কথা না প্রকাশ করা, নিজে কষ্টে থেকেও অনেককে সহায়তা করা, ইম্পিরিয়ালসহ বিভিন্ন লাইব্রেরিতে বসে বসে বই পড়া আর জল–মুড়ি খেয়ে ক্ষুধা নিবারণ করা, মাকে কথা দেওয়া—একটা চাকরি হলেই কলকাতায় নিয়ে যাওয়া, শহর ঘুরিয়ে দেখা ইত্যাদি বিভিন্ন কিছুর মধ্য দিয়ে দীর্ঘ সময় কলকাতার কঠিন জীবনের মুখোমুখি হতে হয়েছে অপুকে।

দুর্গাদি ও বাবা মারা যাওয়ার পর চিকিৎসা আর যত্নের অভাবে মায়ের মৃত্যুও দেখতে হয়েছে অপুকে। আইএ পাস করে চাকরি করা অবস্থায় বন্ধু প্রণবের অনুরোধে তার মামার বাড়িতে মামাতো বোনের বিয়েতে গিয়ে নিজেরই বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়েছে অপুকে। অপুর জীবনে অপর্ণার আগমনে নতুন করে সংসারী হওয়ার বাসনা হয়েছিল। সংসারও করেছিল দুজন মনের মতো করে।

ভালো অবস্থাসম্পন্ন বাড়ির মেয়ে হয়েও দরিদ্র অপুর সংসারে নিজেকে ভালোভাবে মানিয়ে নিয়েছিল অপর্ণা। মনসাপোতা গ্রামের বাড়িতে খড়ের ঘরে ও কলকাতার ভাড়া করা ছোট্ট বাসায়ও অপুকে নিয়ে স্বর্গীয় সুখের সংসার সাজিয়েছিল দুজনে। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে একমাত্র সন্তান কাজল হওয়ার পর মৃত্যু হয় অপর্ণার। অপুকে আবার আপনজন চলে যাওয়ার শোক পেতে হয়েছিল।
ভবঘুরে আর ব্যাচেলর–জীবনে অপর্ণা এসেছিল অপুর জীবনে আশীর্বাদ হয়ে। সেটাও বেশি দিন স্থায়ী হয়নি।

সংসারের মায়া ত্যাগ করে অপু কয়েক দিন বিশ্বভ্রমণে বেরিয়ে পড়ে। নিজের সন্তান কাজলকে তার মা অপর্ণার চলে যাওয়ার পেছনে দায়ী ভেবেছিল। কিন্তু পরে রাগ–অভিমান ভুলে বেরিয়ে পড়ার আগে অপু শ্বশুরবাড়িতে নিজের সন্তান কাজলকে একনজর দেখতে গিয়েছিল। বয়সে ছোট্ট হলেও বাবার অল্প সময়ের আদর তার মনে দাগ কেটেছিল।

কাজলের জীবনটা সবচেয়ে কষ্টকর মনে হয়েছে। জন্মের পর মা মারা যাওয়া, দিদার আদরে বড় হওয়া, দিদার হঠাৎ মৃত্যুতে জীবনে কালো মেঘ চলে আসা, মা বলতে কী সেটা না বোঝা, মামার বাড়িতে সারাক্ষণ দাদুর শাসন, মামিমাদের খারাপ ব্যবহার, ছাদের নির্জন ঘরে ভয়ে ভয়ে একা থাকা, অসুস্থ বা জ্বর হলে অনাদরে পড়ে থাকা, মা-বাবাহীন শিশুকে বাড়ির কর্মরত মুহুরির পর্যন্ত অত্যাচার সহ্য করা, যা সত্যিই বেদনাদায়ক। বাবা নামক ব্যক্তির সহিত কাজলের মামার বাড়িতে কমই দেখা হয়েছে। কিন্তু বাবার অবহেলার কারণে উঠতে–বসতে শুনতে হয়েছে তাদের ঘাড়ে বসে অন্ন ধ্বংস করার মতো কথাও। বালক বয়সে এসব কথা ও আচরণগুলো ধারালো তিরের মতো বিদ্ধ হয়েছে তার কমল হৃদয়ে। কিন্তু কাজল জানত না, কার কাছে সে এগুলোর অভিযোগ দেবে। কেই–বা তাকে এসব থেকে রক্ষা করবে। একটু বয়স বাড়ার পর কাজল বাবার অপেক্ষায় থাকত, বাবা এলে তার সঙ্গে চলে যেতে চাইত। একসময় অপুও তাকে এই অনাদর আর অবহেলার জায়গা থেকে নিয়ে যায় কলকাতায়। অপুর পুরো জীবনে সরল আর বিশ্বস্ত বন্ধু মনে হয় কাজলকে।

কাজলকে নিজের কাছে নেওয়ার আগে অপু দিল্লিসহ কয়েকটি জায়গা ঘুরে আসে। ছোটবেলা থেকে বই পড়ে পড়ে যেসব জায়গা আর প্রকৃতির কথা অপু পড়েছিল, সেসব নিজ চোখে দেখে মুগ্ধ হয় সে। অর্থ শেষ হয়ে যাওয়ার কারণে চাকরি নিয়ে অর্থ উপার্জন করে খরচ করে বিভিন্ন জায়গা, বনজঙ্গল আর পাহাড়-পর্বত ঘুরে আবার কলকাতায় আসে অপু।

সবাই বিয়ে করার কথা বললেও অপু আর বিয়ে করেনি। একজীবনে অনেকের ভালোবাসাই পেয়েছিল অপূর্ব। লীলা, নির্মলা, রানুদি, লীলাদি—এমন অনেকে আত্মীয় বা বংশগত না হয়েও পরম আত্মীয় হিসেবে জীবনে এসেছিল অপূর্বের। অপর্ণার আগমনেও অপুর মাতৃস্নেহ, ভালোবাসা—সবকিছুর অভাব দূর হয়েছিল। চাকরি, ছেলে পড়িয়ে উপার্জন করার পরও অপুর জীবনে অভাব লেগেই থাকত। অবশ্য শেষের দিকে বই লিখে ভালো নাম-ডাক আর অর্থ উপার্জনও করেছিল অপু। শত অভাবে থেকেও সে বিশ্বপ্রকৃতির বিভিন্ন রূপ দেখেছিল। সেসবের স্বাদ সে নিয়েছিল পরম আনন্দে।

স্ত্রী অপর্ণার গহনা বিক্রি করে প্রথম বই নিজের খরচে প্রকাশ করেছিল অপু। মায়ের দীর্ঘদিনের অনুরোধ ও শেষ ইচ্ছেতে নিশ্চিন্দিপুরের আমবাগানটাও অপু কিনেছিল সতুর কাছ থেকে।

মা, বাবা, দিদি, স্ত্রী মারা যাওয়ার পরও লীলাদি, রানুদি, জেঠিমা, মেজ ঠাকুরানসহ অনেকের আদর–স্নেহ–ভালোবাসায় অপুর মনে ভক্তি জেগেছিল।

নিশ্চিন্দিপুরের বন্ধুদের থেকে শুরু করে বোডিং স্কুলের, কলকাতার বিভিন্ন মেসের, কলেজের বন্ধুদের সঙ্গে থেকে জীবনের নানা রূপ অপু দেখেছে এই সমাজজীবনের। অভাবে থাকার পরও কবিরাজ বন্ধু ও বন্ধুপত্নী থেকে যে স্নেহ পেয়েছিল অপু, ঠিক বিপরীতও ঘটেছিল অভাবে পড়ে সুবিধা নেওয়ার ধান্দা করা বন্ধু হরেন থেকে। আবার কলেজের বন্ধুরা মিলে টাকা তুলে অপুর বকেয়া পরিশোধ করেছিল; সেটাও সারা জীবন মনে রাখবে অপু।

নিশ্চিন্দিপুর থেকে কাশী, কাশী থেকে রায়চৌধুরীর বাড়ি, সেখান থেকে মনসাপোতা, সেখান থেকে কলকাতা, আবার কলকাতা থেকে নিশ্চিন্দিপুর। জীবনের স্রোতে চলমান আপুদের সংসার কোথাও স্থায়ী হয়নি। অপু পড়াশোনা আর জীবিকার তাগিদে আরও থেকেছে কয়েক জায়গায়। তবু এর মধ্যে জীবনসংসারে নানা সুখ, দুঃখ ও বিভীষিকাময় অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে কেটে গেছে জীবনরেখা।

‘অপরাজিত’ উপন্যাসে উঠে এসেছে গ্রামের সহজ–সরল জীবন, বাংলার সুন্দর প্রকৃতির রূপ, সহজ জীবনের নানা রং, গ্রামের মানুষের স্নেহ, আদর আর ভালোবাসা। আবার ইট–পাথরের শহরের দম বন্ধ হওয়া পরিবেশ, শহরের আত্মীয়দের তিক্ত ব্যবহার, যান্ত্রিকতার নানা জটিলতা, গঙ্গার ধারের শীতল বাতাস, অপরিচিতদের সহযোগিতার হাত ইত্যাদি।

প্রকৃতির লীলাময় এই মানবজীবনে অপূর্ব রায়ের মতো যারা নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে, নানা স্থান ঘুরে সব জটিলতার মধ্যে সুন্দর কিছু খুঁজে বের করতে পারে, তারাই অপরাজিত হয়ে থাকে এই ত্রিভুবনে।

হাজীপুর, নরসিংদী