সময়টাকে কীভাবে কাজে লাগাতে পারি

নিজেকে সময় দেওয়াটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মডেল: অহনাছবি: অধুনা

নিজেকে সময় দেওয়াটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই তো সবাই বলেন নিজেকে জানো। নিজেকে চেনো। তোমার মধ্যে এমন কী আছে, যা অন্য সব কাজের থেকে অনেক বেশি শক্তিশালী, মজবুত, নিখুঁত ও খাঁটি, যা তুমি সব থেকে ভালো পারো। আবার এই কথাগুলোর উল্টোও ভাবো। অর্থাৎ এমন কী আছে, যা তোমার এই সৃজনশীলতাকে বাধা দিচ্ছে। খুবই সমস্যা হচ্ছে তুমি যেমনটা চাও, তা পেরে উঠছ না। কোন বিষয়গুলো তোমার সমাধান করতে হবে। এমন কী করতে হবে, যা থেকে তুমি সব সমাধান খুঁজে পাবে। আর হ্যাঁ, এটার জন্য চাই নিজেকে জানা, নিজের ভালো, মন্দ, দোষ, গুণ সব বিষয়ে পরিষ্কার থাকা। বলো দেখি, তোমার সব থেকে ভালো আর মন্দ দিক কোনটা? একটু হলেও আমরা তা ভেবে উত্তর দিই। সবার মধ্যেই ভালো, মন্দ আছে। এগুলোকে বোঝা আর তার চর্চা বা মন্দ কাজগুলো থেকে বেরিয়ে আসাটা কিন্তু সম্পূর্ণ নিজের কাজ। আর তার জন্য সব থেকে আগে যে কাজটা করা উচিত, তা হলো নিজেকে সময় দেওয়া।

আমার জন্য আমি কতটুকু সময় দিচ্ছি? মানে আমার এই শরীর ও মন কেমন আছে, কী অবস্থায় আছে, সুস্থ আছে না অসুস্থ আছে? নিজেকে আমি কতটুকু সময় দিয়েছি? আমার মনটা আমি সব কাজে শান্ত রাখতে পারছি কি না? কী কারণে মন ও শরীর চঞ্চল হয়ে ওঠে আর যার কারণে আমরা আমাদের ভুলের শিকার হই।

আমরা কি বলতে পারি, আমি আমাকে প্রতিদিন কতটুকু সময় দিই? ঘুম থেকে ওঠে ঘুমাতে যাওয়া পর্যন্ত আমরা কোনো না কোনো কাজে ব্যস্ত থাকি। অর্থাৎ পরিবার, অফিস, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন, পড়াশোনা, জীবনে বড় হওয়ার স্বপ্ন, অতীত, ভবিষ্যৎ আরও কতশত জায়গায় আমরা ব্যস্ত থাকি। কিন্তু আমার জন্য আমি কতটুকু সময় দিচ্ছি? মানে আমার এই শরীর ও মন কেমন আছে, কী অবস্থায় আছে, সুস্থ আছে না অসুস্থ আছে? নিজেকে আমি কতটুকু সময় দিয়েছি? আমার মনটা আমি সব কাজে শান্ত রাখতে পারছি কি না? কী কারণে মন ও শরীর চঞ্চল হয়ে ওঠে আর যার কারণে আমরা আমাদের ভুলের শিকার হই। যখন যোগব্যায়ামের ক্লাসে বা বিভিন্ন লেকচারে এই কথাগুলো বলি যে আপনি আপনাকে, শুধুই আপনাকে কতটুকু সময় দিয়েছেন? বেশির ভাগ উত্তরই আসে, আমি তো আমাকে সময় দেওয়ার সময়ই পাই না। এত এত কাজের মধ্যে শুধু নিজেকে সময় দেব কোথা থেকে? আর আমরা যখন ঘণ্টার পর ঘণ্টা ট্রাফিক জ্যামে বসে থাকি, তখন বলি আমার এত সময় শুধু শুধুই নষ্ট হয়ে গেল। এই সময়ে আমি কত কাজ করে ফেলতে পারতাম।

ট্রাফিক জ্যাম কী তা আমি বুঝতেই পারি না। কারণ, আমি সারা ঢাকা শহর বাইসাইকেলেই চলাচল করি। যদি কোনো কারণে আমার প্রিয় বাহনটি ছাড়াই বেরিয়ে পড়ি, সেদিন আমি আমাকে সব থেকে বেশি সময় দিতে পারি।

ট্রাফিক জ্যামে নিজের মন আর শরীরের খুঁটিনাটি খুঁজতে থাকি। শরীর আর মনের যত্ন নিতে নিতে কখন যে সময়ই চলে যায়, তা বুঝতেই পারি না। মনে হয়, কেন আরেকটু জ্যামে পড়লাম না? আমার এই লেসনটা যে ইনকমপ্লিটই থেকে গেল। আর বাকিটা লেসন ফেরার জ্যামের জন্য অপেক্ষা করি।

এবার আসা যাক এই জ্যামে আমরা আমাদের মন ও শরীরকে কীভাবে চার্জ দিতে পারি। কীভাবে খুঁজে পেতে পারি শান্তি আর আনন্দের মূল উৎস।

শুরুতেই শান্ত হয়ে বসুন। ভাবুন, চালকের আসনে যে বসেছে সে খুব সাবধানে সময় অপচয় না করেই সঠিক সময়ের মধ্যে পৌঁছে যাবে আপনার গন্তব্যের স্থানে। এবার আপনি চোখ বন্ধ করে একটা লম্বা শ্বাস নিন। তবে রাস্তায় ঘন ঘন দীর্ঘশ্বাস নেওয়া শরীরের জন্য ক্ষতিকর। কারণ, ঢাকা শহরের বাতাসে যা আছে, তা খুব কমই আমাদের উপকারে আসে।

অবসর সময়ে বই পড়তে পারেন
ছবি: বন্ধুসভা

চোখ বন্ধ করে শান্ত হয়ে বসে আপনার মেরুদণ্ডের দিকে লক্ষ করুন। আপনার মেরুদণ্ড যেন সোজা থাকে। বলা হয়, যারা মেরুদণ্ড সোজা করে বসে, তাদের ৮০ শতাংশের অসুখবিসুখ হয় না। ২৪ ঘণ্টায় দুই থেকে চার ঘণ্টা যদি জ্যামের কারণে আমি মেরুদণ্ড সোজা করে বসতে পারি, এর থেকে ভালো থাকার উপায় কী আছে? শুধু সোজা হয়ে বসে থাকার কারণে আপনার কোমরব্যথা, কুঁজো ভাব, নার্ভের সমস্যা চিরদিনের মতো চলে যাবে। এবার শান্ত হয়ে বসে শুধু শ্বাস-প্রশ্বাসে মনোযোগ দিন। দেখুন কেমন করে তা যাওয়া-আসা করছে, কতটা স্বাভাবিক গতিতে যাওয়া-আসা করছে। সেই সঙ্গে বাইরের অবস্থা সম্পর্কেও সজাগ থাকুন। সময় করে চোখ খুলে দেখে নেন আপনি কোথায় আছেন, আনুমানিক আর কতটা সময় লাগবে। এতে আবার আপনার সিকসেন্সকে চর্চা করা হয়। বলা হয়, যারা দিনে এক ঘণ্টা চোখ বন্ধ করে সজাগ আর শান্ত থাকে, তারা ধীরস্থির হয়, সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে, বাড়ে তাদের ধৈর্য। এই পদ্ধতিটা ধ্যান করার প্রথম অবস্থা। ধীরে ধীরে শরীরের অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গের সঙ্গেও এক হয়ে যান। শুধুই শরীরের ভেতর মনোযোগ দেন। শরীরের ভালো, মন্দ, আরাম লাগা, ব্যথা লাগা—সব দেখতে থাকুন। কিন্তু কোনো বিচার করবেন না, শুধুই দেখতে থাকুন। শুধু এইটুকু অভ্যাস করলেই আপনার উচ্চ রক্তচাপ, দুশ্চিন্তা, অনিদ্রা ইত্যাদি থেকে সম্পূর্ণভাবে মুক্তি পেতে পারেন।

বলা হয়, কেউ যদি মস্তিষ্কের ব্যায়াম করতে চায়, তাকে বেশি করে চোখের ব্যায়াম করতে হয়। চোখ খুলে অথবা বন্ধ করে চোখের মণিকে ডানে, বাঁয়ে, ওপরে, নিচে, ঘড়ির কাঁটার দিকে আবার ঘড়ির কাঁটার বিপরীত দিকে ঘোরানো, চোখের পাতা জোড়া বন্ধ করা আবার বড় করে খোলা ইত্যাদি আরও অনেক ব্যায়াম আছে, যা আপনার চোখকে সুস্থ রাখবে। আর যদি কারও চোখের সমস্যা শুরু হয়ে যায়, তাহলে তা খুব তাড়াতাড়িই সেরে যাবে।

এ ছাড়া ইয়োগিক বিভিন্ন মুদ্রা আছে, যা শুধু হাতের আঙুলের মাধ্যমেই আপনার গ্যাস্ট্রিক, ডায়াবেটিস, অতি ওজন, হার্টের সমস্যা, কিডনির সমস্যাসহ আরও জটিল রোগের সমাধান করতে পারে। আর সঙ্গে যদি হালকা মেডিটেশনের মিউজিক শোনা যায়, তাহলে তো ষোলোকলাই পূর্ণ হলো।

তাহলে আজ থেকে শুরু হোক সময়ের সঠিক ব্যবহার শুরু করা। ট্রাফিক জ্যাম বিরক্তির কারণ না হয়ে, হয়ে উঠুক আমাদের সব থেকে মূল্যবান আনন্দের সময়। এই একটাই সময়, যেখানে আমি আমাকে সময় দিতে পারি। যেটা হবে আমার একান্ত সময়, আমার আত্মিক সাধনা, দিনের সব থেকে শান্তিপূর্ণ সময়।

প্রতিষ্ঠাতা, জয়সান ইয়োগা অ্যান্ড ওয়েলনেস সেন্টার, ধানমন্ডি, ঢাকা

প্রথম আলো বন্ধুসভা জাতীয় পরিচালনা পর্ষদের প্রকাশনা ‘তারুণ্য’, অষ্টম সংখ্যা, ফেব্রুয়ারি ২০১৯ থেকে নেওয়া।