সোনাই চরিত্রে চঞ্চল চৌধুরী দক্ষ অভিনেতা। ভেতরের অনেক গভীর ও চিন্তাশীল সৃষ্টিশীল অভিনয়সত্তা বাইরে তাঁর সুনিপুণ দক্ষতায় প্রকাশিত হয়।
রাধা-কৃষ্ণ থেকে সাজু-রুপাই বিরহ–বেদনা বিজড়িত প্রেমকাহিনি আমাদের বাঙালি জাতির সম্পদ। যে প্রেমের প্রকৃত পরিণতিতে মিলন নেই অথবা মিলনের পরও বিচ্ছেদ-বিরহের দংশনে দয়িত অথবা দয়িতা কোনো একজন কিংবা দুজনেই হারিয়ে যায়, সেই প্রেমকাহিনি মনে দাগ কাটে, অমর হয়। যদিও বাস্তবে তেমন করুণ পরিণতি কখনো কারও হোক, আমরা চাই না। কিন্তু বাস্তব জীবনেও এমন ঘটনা বারবার ঘটে বলেই তো তা নিয়ে গল্প, সাহিত্য-উপন্যাস, চলচ্চিত্র হয়। মনপুরা দ্বীপে সোনাই আর পরির তেমনই এক অমর প্রেম কাহিনি বুনেছেন গিয়াস উদ্দিন সেলিম। নিজের পরিচালনায় অসাধারণ মুনশিয়ানায় চলচ্চিত্রায়িত করেছেন ২০০৯ সালে।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় দেশভাগের ফলে উদ্বাস্তু হয়ে পড়া জীবনের স্মৃতির প্রেক্ষাপটে ‘সাঁকোটা দুলছে’ নামের একটা বেদনা বিজড়িত কবিতা লিখেছিলেন। সেই কবিতায় ‘দুনিয়াদারির রাজা’ এক হারানো বন্ধুর স্মৃতি আছে, যে বন্ধু কিনা দোষ না করেও পিঠ পেতে সাজা নিত। ‘মনপুরা’ চলচ্চিত্রেও সোনাই নামের চরিত্রটিকে পাওয়া গেল। সে অনাথ। গাজী সাহেবের বাড়িতে থাকে। গাজীর মানসিক প্রতিবন্ধী ছেলে হালিম ঝড়বাদলের রাতে এক নারীকে খুন করে বসে। হালিমের মা একটা কূটনৈতিক সমাধান বের করে সোনাইকে দ্বিপান্তরী করে। গাজী সাহেব প্রথম দিকে সোনাইয়ের প্রতি যথেষ্ট সহানুভূতিশীল থাকলেও ধীরে ধীরে তার সামন্ততান্ত্রিক চরিত্র প্রকট হয়ে ওঠে। থানা–পুলিশসহ সবার মধ্যে প্রচার করে দেওয়া যায়, সোনাই খুন করে পালিয়েছে। সোনাইও বিষয়টা বুঝতে পারে। কিন্তু পালক পিতা-মাতা ও মানসিক প্রতিবন্ধী স্নেহের হালিমের কথা ভেবে দোষ না করেও পিঠ পেতে সাজা নেয়।
এই মনপুরা দ্বীপে নির্বাসনে এসে সোনাই নদী, প্রকৃতি ও নির্বোধ পশু-পাখিদের সংস্পর্শে থেকে প্রকৃত অর্থেই যেন দুনিয়াদারির রাজা হয়ে ওঠে। যদিও মনুষ্যহীন অঞ্চল, মানুষের সঙ্গে কথা বলতে না পারার যন্ত্রণা তাকে খুব ভোগায়। বাবার সঙ্গে এই মনপুরা দ্বীপের কূলে মাছ ধরতে আসে ওপারের উজানতলী গাঁয়ের পরি। প্রথম দর্শনের পূর্বরাগ, ধীরে ধীরে তীব্র গভীর অনুরাগে পরিণত হয়। মা মরা পরিও মনপ্রাণ উজাড় করে দিয়ে সোনাইকে ভালোবেসে ফেলে। মনপুরা আর উজানতলী গ্রামের মধ্যবর্তী গাঙ, গাঙের স্রোত আর গাঙের পানিকে সাক্ষী রেখে দুজন দুজনের জীবন–মরণের সাথি হয়ে ওঠে।
সোনাই চরিত্রে চঞ্চল চৌধুরী দক্ষ অভিনেতা। ভেতরের অনেক গভীর ও চিন্তাশীল সৃষ্টিশীল অভিনয়সত্তা বাইরে তাঁর সুনিপুণ দক্ষতায় প্রকাশিত হয়। বাংলাদেশের টেলিভিশন ধারাবাহিক নাটকে দীর্ঘদিন ধরে অভিনয় করছেন। পুরোনো নাটকে একজন দুরন্ত অস্থির গ্রাম্য যুবকের উত্তেজনার দৃশ্যে, ঝগড়ার দৃশ্যে, কান্নার দৃশ্যে চঞ্চলের টুকরা টুকরা অভিনয় দেখে আমিও নানা সময়ে মুগ্ধ হয়েছি। এই চলচ্চিত্রেও তেমন দৃশ্যগুলোতে চঞ্চল বরাবরের মতো অভিনয় করে গেছেন। দুই হাত মেলে পাখির মতো ওড়া চঞ্চল এই চলচ্চিত্রে একজন অন্তর্গভীর প্রেমিক চরিত্রে নবদিগন্তে উড়াল দিলেন। মনপুরা দ্বীপ ‘মনপুরা’ চলচ্চিত্র প্রকৃতই হয়ে উঠল চঞ্চলময়। চঞ্চলের সঙ্গে পরি চরিত্রে পাল্লা দিয়ে অভিনয় করেছেন নবাগত ফারহানা মিলি। তাঁর কালো মেঘের মতো চুল, কাজলকালো চোখ, আলতারাঙা চরণ, কমলা লেবুর কোয়ার মতো রাঙানো পুরুষ্টু ঠোঁট, কুমড়া ফুলের মতো ত্বকের রং, শাড়ি পরিহিত, যাকে আমাদের বাঙালি ঘরের চিরাচরিত লক্ষ্মীমন্ত মেয়েটি মনে হয়।
বাণিজ্যসফল এই চলচ্চিত্র আর দশটা বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের মতো নয়। যথেষ্ট শিল্পগুণে সমৃদ্ধ এবং মননশীল এই সৃষ্টি শহর থেকে গ্রাম—প্রতিটি শ্রেণির মানুষের ভালো লাগার মতো।
গিয়াস উদ্দিন সেলিমের সুন্দর চিত্রনাট্য, সংলাপ, কামরুল হাসান খসরুর দক্ষ চিত্রগ্রহণ এই চলচ্চিত্রের বেশ কিছু প্রণয়দৃশ্যকে কাব্যময় করে তুলেছে। অচিন মানুষের কাছে নাম না-জানা কন্যার বিরহে অস্থির চিত্তে দেখা করতে আসা, শুকপাখিকে সোনাইয়ের পরি নাম শেখানো, পরি বুলি ফুটলে তাকে মুক্তি দেওয়া। গাঙের কূলে, গাঙের স্রোতে নৌকায়, বেড়ার ঘরের জানালা দিয়ে দুজনের খুনসুটির মতো প্রণয়দৃশ্য ধারণ, অন্ধকার রাতে মশাল হাতে পরির উজানতলী গ্রামে গাঙের কূলে অধীর অপেক্ষা, দ্বীপে বাস করেও নৌকা না থাকা সোনাইয়ের নদী সাঁতরে পরির সঙ্গে দেখা করতে যাওয়া যেন কবিতার পর কবিতা লিখে চলা।
গাজী সাহেবের চরিত্রে বাংলাদেশের প্রগতিশীল চিন্তাধারার অভিভাবক, নাট্যকার, শিক্ষক মামুনুর রশীদকে দেখে একবারও মনে হয়নি তিনি একটা চলচ্চিত্রে অভিনয় করছেন। এতটাই সহজ–সরল স্বাভাবিক তাঁর অভিনয়সত্তা। মানসিক প্রতিবন্ধী হালিম চরিত্রে মনির খান শিমুল বেশ মজার অভিনয় করেছেন, শিকল পরা পায়ে অসুস্থ যুবককে দেখে কষ্টও লেগেছে। পরিদের প্রতিবেশী নানি, গ্রামীণ গানের দলের প্রধান চরিত্রে দিলারা জামান অনন্য। গান শুরুর আগে বাদ্যযন্ত্র ঠিক করে নেওয়ার যে শব্দ হয়, চলচ্চিত্রে দৃশ্যের আবহে সেই শব্দ ভেসে আসছিল, যা একেবারে অভিনব ও যথার্থ।
পরির বাবা হাকিম মাঝি চরিত্রে ফজলুর রহমান বাবু অনবদ্য। বাড়ির উঠানে বসে লুঙ্গি পরে যখন মাছ ধরার জ্বাল মেরামত করছিলেন, গায়ের গেঞ্জিটা পেটের ওপরে ওঠানো ছিল। চরিত্রকে যথাযত ফুটিয়ে তুলতে এভাবেই অতি সূক্ষ্ম নিরীক্ষণে চরিত্রের সঙ্গে মিশে যেতে হয়। সংগীতপ্রধান এই চলচ্চিত্রে গানেও কণ্ঠ দিয়েছেন এই গুণী শিল্পী।
এ ছাড়া চন্দনা মজুমদার, কৃষ্ণকলি ইসলাম, অর্ণব, মমতাজের কণ্ঠে ‘নিথুয়া পাথারে নেমেছি বন্ধুরে..’, ‘যাও পাখি বলো তারে সে যেন ভোলে না মোরে..’, ‘আমার সোনার ময়না পাখি কোন দ্যাশেতে গেলা উইড়ারে..’, ‘সোনাই হায়রে..’, ‘আগে যদি জানতাম..’ গানগুলো শুধু ভালো নয়, গানের যথাযথ ব্যবহার চলচ্চিত্রে বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে দৃশ্যকে সমৃদ্ধ করেছে।
কাহিনির পরিণতি হৃদয়বিদারক। পরি আর সোনাইয়ের মিলন হয় না। পুলিশ এসে খুনের দায়ে সোনাইকে ধরে নিয়ে যায়। পরির সঙ্গে হালিমের বিয়ে হয়। শাশুড়ি কৌশলে পরিকে জানায়, সোনাইয়ের ফাঁসি হতে চলেছে। পরি বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করে। সোনাই জেল থেকে ছাড়া পেয়ে এসে দেখে, পরি হারিয়ে গিয়েছে। পরির কবরের পাশে বসে সোনাইয়ের বুকফাটা আর্তনাদ, কান্না, চিরকালের প্রণয়গাথার মতো কাহিনিকে অমরত্বের দিকে নিয়ে যায়।
বাণিজ্যসফল এই চলচ্চিত্র আর দশটা বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের মতো নয়। যথেষ্ট শিল্পগুণে সমৃদ্ধ এবং মননশীল এই সৃষ্টি শহর থেকে গ্রাম—প্রতিটি শ্রেণির মানুষের ভালো লাগার মতো। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকে বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দেওয়ার মতো। বিগত দেড় দশকে বিশ্বপ্রাণের হৃদয় টেনেছে এই চলচ্চিত্র। মনপুরা দ্বীপের তানপুরা বুকের ভেতর বাজতেই থাকবে।
হাওড়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত