যার পোড়ে সে বোঝে, বাকিরা তো গল্প খোঁজে

অলংকরণ: তুলি
উৎসর্গ: গল্পটি আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধুর জীবন থেকে নেওয়া। লেখার পর তাকে দেখিয়েছিলাম। সে বলল, আমার হৃদয় পোড়ে আর তোমরা গল্প খুঁজে বেড়াও? আমি বললাম, ‘যার পোড়ে সে বোঝে, বাকিরা তো গল্প খোঁজে।’

এক সপ্তাহ ধরে সামিহার কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। না ফোনে, না সাক্ষাতে! বাধ্য হয়ে আন্টির নম্বরে ফোন করলাম। যা শুনলাম, ঘটনাটা আমাকে অবাক করে দিল। তিন-চারটা ঘুমের ওষুধ খেয়ে নাকি মেয়েটা বিছানায় পড়ে আছে! এখন ওর সঙ্গে কথা বলার মতো কোনো অবস্থাই নেই। ফোনের ওপাশে আন্টির চোখের পানি যে টলমলিয়ে পড়ছে, তা ঠিকই বুঝতে পারলাম।

সব সময় হাসিখুশি থাকা মেয়েটা হঠাৎ এমন করবে কেন! প্রেমসংক্রান্ত কোনো ব্যাপার নিশ্চয়ই আছে। আজকাল তো এমন অহরহই হচ্ছে। কিন্তু আমার জানামতে সামিয়ার কারও সঙ্গে কখনোই কোনো সম্পর্ক ছিল না। ছোট থেকেই আমরা এত কাছের বান্ধবী যে একে অপরের জীবনের সব ঘটনাই জানি। সামিয়া সাধারণ মেয়ে। এমন একটা মেয়ের জীবনে আর কী–ই বা ঘটনা থাকতে পারে! তবে, ঘটনার পেছনেও ঘটনা থাকে, যা হয়তো যে মানুষের জীবনে ঘটে, শুধু তার হৃদয়ের কোনো গহিন কোণেই থেকে যায়। বলা হয় না কাউকে। কিন্তু ভীষণ একাকিত্বের সময়, অভিমানের সুরে কোনো একজনকে মনের সব না বলা গল্প বলে দিতে চায়।

আন্টির সঙ্গে কথা হওয়ার পরদিন মেসেঞ্জারে হঠাৎ সামিয়ার মেসেজ, ‘আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে স্যারের সঙ্গে।’
ব্যস! এইটুকু মেসেজ!!

আমাদের বান্ধবীদের পাঁচজনের একটা দল আছে। খুব আড্ডা চলত! যখনই আমরা সবাই বিয়ে নিয়ে আমাদের পরিকল্পনা, স্বপ্ন আলোচনা করতাম; সামিয়া শুধু একটা কথাই বলত, ‘আমার বিয়ে অনেক দেরি, তোরা নাতি-নাতনি নিয়ে আমার বিয়ে খেতে আসবি।’

সামিয়ার বিয়ে দেরিতে কেন হবে, তার কারণটা আমাদের অজানা নয়। সামিয়া তখন খুব ছোট আর দ্বীপ (ওর ছোট ভাই) আন্টির গর্ভে, সে সময় ওর বাবা মারা যান। আন্টি অনেক কষ্ট করে, ত্যাগ স্বীকার করে সামিয়া আর দ্বীপকে বড় করছেন। আন্টি সামিয়াকে একটা কথা সব সময় বলতেন, ‘আজ যদি আমার পড়ালেখাটা একটু বেশি থাকত, তাহলে একটা চাকরি করে হয়তো সংসারটা চালানো যেত।’ সেই থেকে সামিয়ার প্রতিজ্ঞা, আর যা–ই হোক, আগে পড়াশোনা শেষ করবে, চাকরি করবে, নিজের একটা পরিচয় হবে, তারপর বিয়ে।

সামিয়ার মেসেজ পাওয়ার পরদিনই সোজা ওর বাসায় গিয়ে উঠলাম। বেলা ১১টা। আন্টি রান্নাঘরে, সামনের ঘরে সামিয়ার নানুকে দেখলাম। নানুকে দেখে আমি একটু অবাকই হলাম! বুঝলাম, বিয়ের কথা তাহলে বেশ জোরেশোরেই চলছে।
সামিয়ার ঘুম থেকে উঠতে বেশ কষ্ট হলো। আবারও ঘুমের ওষুধ খেয়েছে, বুঝতে বাকি রইল না। আমাকে কিছু না বলেই বাইরে যাওয়ার জন্য নতুন একটা কাপড় নিয়ে সোজা ওয়াশরুমে চলে গেল। এদিকে, আন্টি জানতে চাইলেন, আমরা বের হব কি না। সামিয়ার হাবভাব দেখে বুঝে গেছি, ও আমাকে নিয়েই বের হবে। তাই আমিও বললাম, ‘জি আন্টি, বের হব।’
কোথায যাব জানতে চাইলে, অনুমান করে বলে দিলাম, প্রেমার বাসায়।
সামিয়া ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে সোজা ঘর থেকে বের হয়ে যাচ্ছিল। আন্টি আর নানু জলদি ওকে আটকাল। আমি বুঝলাম, আন্টির ভয় হচ্ছে যে সামিয়া হয়তো রাগ করে ঘর ছেড়েই চলে যাচ্ছে। কিন্তু আমি জানি, সে যথেষ্ট পরিণত। এ কাজ কখনোই করবে না।

আন্টির চোখে পানি। নানু প্লেটে করে ভাত নিয়ে এলেন। গতকাল থেকে কিছুই খায়নি মেয়েটা। সামিয়াকে দেখেও আমার মনে হচ্ছিল, কোনোরকমে দাঁড়িয়ে আছে। একটু পরপর যেন ঢলে পড়ছে। আমি ওর হাতটা ভালো করে ধরলাম, আন্টিকে আশ্বস্ত করলাম যে আমরা বাইরে কোথাও খেয়ে নেব। এটা বলে ঘর থেকে বের হলাম দুজন।

সামিয়ার শরীর যথেষ্ট দুর্বল। ধরে ধরে রিকশায় বসালাম। সোজা চলে গেলাম প্রেমার বাসায়। চারতলা ভবনের চিলেকোঠায় থাকে ও। বেশ সুন্দর এক রুমের বাসা। বাসার নিচ থেকে সামিয়ার জন্য কেক আর কলা কিনে নিলাম। ও ফোনে কথা বলছে।
আমি আর প্রেমা এতক্ষণ কী কী হলো, এসব নিয়ে কথা বলছিলাম।
ফোনে কথা বলা শেষ করে সামিয়া রুমে এল। কার সঙ্গে কথা বলল এতক্ষণ, তা জানতে চাইলাম, ‘কীরে, স্যার নাকি? ওহ, সরি, উনি তো এখন আমাদের হবু দুলাভাই!’ এই নিয়ে আমি আর প্রেমা একটু ঠাট্টা করে নিলাম।
—আরে না, রাহুল ফোন করেছিল। ওর সঙ্গেই কথা বলছিলাম!
রাহুল পাল, সামিয়ার অনেক ভালো বন্ধু। আমাদের দলে শুধু প্রিয়াঙ্কাই হিন্দু ছিল। তাই প্রিয়াঙ্কার সঙ্গে রাহুলকে নিয়ে খুব মজা করা হতো। একটু পরই বাকি বান্ধবীরা এসে হাজির। আমি, সামিয়া, প্রেমা, প্রিয়াঙ্কা আর জ্যোতি।

এবার আসল কাহিনিতে আসি, এই বলে পাঁচজন গোল হয়ে বসলাম।
স্যার সামিয়াকে পড়াতেন ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে। টানা সাত বছর পড়িয়েছেন। এখন পড়াচ্ছেন ওর ছোট ভাইকে। সে এবার এইচএসসি দেবে। আর সামিয়া পড়ছে স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষে।

স্যারের সঙ্গে আন্টি আর দ্বীপের অনেক ভালো সম্পর্ক। অনেক খেয়ালও রাখে তাদের। তাই দুজনই স্যারকে খুব পছন্দ করে। তবে সামিয়ার ভীষণ অপছন্দের উনি। চেহারায় নাকি রাগী রাগী ভাব! ও অনেক ভয়ও পেত ওনাকে। আগে যখন ওদের বাসায় স্যার সামিয়া আর দ্বীপকে পড়াতেন, আমি যেতাম। হিন্দি সিরিয়ালের রাগী নায়কদের মতো চেহারা। আমি দেখে ক্রাশড্! এখনো মনে আছে, দ্বীপকে সামনের রুমে পড়াচ্ছিলেন, সামিয়া আমার জন্য পর্দা ফাঁক করে লুকিয়ে স্যারের একটা ছবি তুলে দিয়েছিল। তখন আমরা এইচএসসি পরীক্ষার্থী। কলেজে বসে সবাই আড্ডা দিচ্ছিলাম। কথায় কথায় সামিয়া বলল, ‘স্যার মেসেজ পাঠিয়েছে ফোনে। লেখা, তুমি কি আমার অজান্তে এমন কোনো কাজ করেছ যেটা জানতে পারলে আমি খুব কষ্ট পাব?’

বুঝতে বাকি রইল না। সামিয়াকে আমরা ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খুলে দিয়েছিলাম। ও খুলতে চায়নি। স্যার নিষেধ করেছেন। এতে নাকি পড়াশোনার ক্ষতি হবে।
সামিয়ার ফেসবুক চালানোর ব্যাপারটা স্যার কোনোভাবে জানতে পেরেছিলেন, তাই মনখারাপ করেছেন। আমরা বললাম, ‘আচ্ছা, স্যার তোকে পছন্দ করে না তো?’ এ কথা শুনে ও সেদিন খুব রেগে গেল। এটা ছিল কলেজের সময়কার ঘটনা।
প্রেমার বাসায় বসে বসে আগের ঘটনাগুলোর স্মৃতিচারণা করে নিলাম।
আচ্ছা, এখন তাহলে সর্বশেষ খবর কী?
সামিয়া বলল, ‘সর্বশেষ খবর হলো, আমার বিয়ে (রাগান্বিত স্বরে)। স্যারের বাড়ি থেকে প্রস্তাব পাঠিয়েছে। আগামীকাল দেখতে আসবে। এ সপ্তাহের মধ্যেই বিয়ের তারিখ ঠিক করবে। দোস্ত, আমি মরে যাব!’ এই বলে কেঁদে ফেলল সামিয়া।
আমাদের পরামর্শ ছিল, পরিবার ভালো, তোর পরিবারেরও সবাই রাজি, তোরও পছন্দ নেই; তাহলে সমস্যা কোথায়?
—সমস্যা হলো, ওনাকে আমার পছন্দ না। কখনো ওই নজরে দেখিনি। ওনাকে দেখলেই আমার কেমন যেন ভয় ভয় লাগে। সত্যি বলতে কি, আমি মনে মনে যেমন ছেলে কল্পনা করি, তার ধারেকাছেও উনি নেই।

এখন সামিয়ার পরিবারে বলেও আর লাভ নেই। সে তো আগেই এই প্রস্তাবে না করে দিয়েছে। কিন্তু আন্টি এই বিয়ে দেবেনই। ওনার একটাই কথা, ‘আমার কষ্টের কী মূল্য দিলি তুই?’
আচ্ছা, তাহলে স্যার বাদ। অন্য কোনো ছেলেকে বিয়ে করবি? সেটাও না করে দিল সামিয়া। কারণ? কারণটা এবার বদলে গেছে। আগে বলত, লেখাপড়া শেষ করে বিয়ে। এখন বলছে, কখনোই বিয়ে করবে না! ওর এমন সিদ্ধান্তের পেছনে কী কারণ থাকতে পারে? আমাদের কিছুই বলল না সেদিন। পরদিন সামিয়াকে দেখলে এল। অনেক বুঝিয়ে–শুনিয়ে পাত্রপক্ষের সামনে নিয়ে যাওয়া হলো। ও যে খুব বিরক্ত, তা ওর চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছিল। আন্টি খুব ভয়ে ছিলেন, কখন কী বেয়াদবি করে বসে মেয়েটা! নাহ, মেয়েটা তেমন কিছুই করেনি। মায়ের সম্মান সবার সামনে নষ্ট হতে দিতে পারে না। এইটুকু ও বোঝে। তবে পরিবারের সবার সঙ্গে কথা বলা একদম বন্ধ করে দিয়েছে। খাওয়াদাওয়া করছে না ঠিকমতো। আমাদের সঙ্গে বাইরে গেলে যা খায়, ওইটুকুই। এই কয়দিনে শরীরের চামড়া মনে হচ্ছে, হাড়ের সঙ্গে লেগে গেছে।

পাত্রপক্ষ মেয়ের পরিচয় জানতে চাইলে সামিয়া উত্তরও দিয়েছে। সবই ঠিক চলছিল, বিপত্তি বাধান স্যারের চাচা। উনি বললেন, ‘মা, তোমার পা দুইটা দেখাও তো একটু।’ সামিয়া এই অদ্ভুত কথা শুনে অবাক হয়ে একবার আমার দিকে তাকাল। নিজেকে কোনোমতে সামলে নিয়ে শাড়ি উঁচু করে ধরে পা দুটি দেখিয়ে দিল। তারপর যা হলো, সেটার জন্য আমরা কেউই প্রস্তুত ছিলাম না। সামিয়া হুট করে বলে বসল, ‘আরও কিছু দেখবেন নাকি? দেখাই?’ এই বলে অন্য রুমে চলে গেল।
সামিয়ার এমন কাণ্ডের জন্য যদি পাত্রপক্ষ বিয়েটা ভেঙে দিত, তাহলে তো ভালোই হতো! কিন্তু লাভ হয়নি। আমার বান্ধবী রাজি না। যে করেই হোক, বিয়েটা বন্ধ করতে হবে। আবারও আমাদের গোলবৈঠক চলছে...

আচ্ছা, স্যার কি জানে যে সামিয়া এই বিয়েতে রাজি না? আমরা পরিকল্পনা করলাম যে সামিয়া স্যারের সঙ্গে দেখা করে সব বুঝিয়ে বলবে। বুঝিয়ে বললে স্যার নিশ্চয়ই বুঝবেন!
পরিকল্পনা অনুযায়ী দুজনের দেখা করার ব্যবস্থা করা হলো। আমি আর প্রিয়াঙ্কা দূরে বসে আছি। হঠাৎ রাহুলের দেখা পেলাম। ছেলেটা দূর থেকে একপলক সামিয়ার চোখে চোখ মেলাল। তারপর এসে বসল আমাদের পাশে। কথা চলছিল সামিয়াকে নিয়েই। আচ্ছা, এত ভালো একটা ছেলেকে এভাবে ফিরিয়ে দেওয়াটা কি ঠিক হচ্ছে? আমাদের তো মনে হয়, স্যার ওকে সুখেই রাখবেন। রাহুল চুপচাপ শুনছিল কথাগুলো। হঠাৎ বলে উঠল, ‘সামিয়ার বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পেছনের গল্প তোদের বলব।

‘সামিয়ার বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে মামা-খালাদেরই প্রভাব বেশি ওদের পরিবারের ওপর। তাঁরাই আসলে পরিবারটাকে দেখাশোনা করেছেন। ওরা খালার বাসায় ভাড়া থাকে। পাশের বাড়িটায় থাকেন খালাতো বোন আর বোনজামাই। ধরতে গেলে, এরা সবাই মিলেই একটা পরিবার। তবে সামিয়াদের ওপর তাঁদের একটু দাপট আছে।’
‘আচ্ছা, এসব তো আমরা জানি! এর সঙ্গে বিয়ে না করার সম্পর্ক কোথায়?’
রাহুল আবার বলতে শুরু করল, ‘সামিয়া বেশ কয়েকবার যৌন হেনস্তার শিকার হয়েছে। খুব কাছের কোনো আত্মীয়ই হয়তো....!’ আমি আর প্রিয়াঙ্কা যেন আকাশ থেকে পড়লাম। কথাটা সামিয়া আমাদের একবারও বলেনি! আর ও এটা সহ্য করলই বা কীভাবে! আমরা চাচ্ছিলাম মানুষটার নাম জানতে। রাহুল বলেনি। খেয়াল করলাম, তার চোখে পানি।

সামিয়া স্যারের সঙ্গে কথা শেষ করে চলে এল। অদ্ভুত ব্যাপার, ওর চোখেও পানি! রাহুল সামিয়ার দিকে আর তাকাল না। সোজা উঠে চলে গেল।
এবার সামিয়াকে ধরলাম আমরা। তার আগে শুনি, স্যারের সঙ্গে কী কথা হলো। স্যারকে ও সব কথা খুলে বলেছে। বিয়েতে রাজি না, কারণ, মানুষকে আর বিশ্বাস করা যায় না! ওর সঙ্গে ঘটে যাওয়া হেনস্তার ভয়ংকর বর্ণনাও দিয়েছে। কিন্তু স্যার একটা কথাও বলেননি। চুপ করে শুনে গেছেন।
হঠাৎ একটা মেসেজ এল সামিয়ার ফোনে। স্যার পাঠিয়েছেন।
‘সামিয়া,
অনেক আগে থেকেই পছন্দ করি তোমাকে। প্রচণ্ড ভালোবাসি! তোমাকে এতটা ভালোবাসি যে তোমার এই ঘটনা মেনে নেওয়াটা আমার কাছে নিতান্তই তুচ্ছ ব্যাপার। আমি জানি, তোমার স্বপ্ন আকাশ ছোঁয়ার। তোমাকে আমি সেই স্বপ্ন পর্যন্ত পৌঁছে দিতে চাই। তোমার লক্ষ্যে পৌঁছে যাওয়ার পর, কখনো সময় পেলে এই মানুষটার কথা একটু ভেবো, এতেই আমি খুশি।’

এই মেসেজ দেখে আমি আর প্রিয়াঙ্কা দারুণ খুশি। আবার আফসোসও হচ্ছে, এমন একটা মানুষ যদি আমাদের জীবনে পেতাম! বললাম, ‘সামিয়া, দেখিস আমাদের মধ্যে সবচেয়ে রোমান্টিক ভালোবাসার গল্প হবে তোর।’ এটা শুনে ও যেন জোর করে একটু হাসার চেষ্টা করল। আচ্ছা এখনো ওর কিসের এত চিন্তা? আর তো কোনো দুশ্চিন্তা থাকার কথা নয়।

বিয়ের প্রস্তুতি শুরু! বান্ধবীরা সবাই মিলে নেচে উঠলাম। কেনাকাটা শুরু করে দিলাম। বিয়ের শাড়ি কিনতে গেলাম। খেয়াল করলাম, স্যার বাইক থেকে নামলেন। আচ্ছা, উনি আবার বাইক চালান কবে থেকে? সামিয়া জানাল, একদিন ও ফেসবুকে একটা পোস্ট করেছিল যে একদিন কোনো একজনের বাইকের পেছনে বসে দূরে চলে যেতে চায়। এরপরই স্যার বাইকটা কিনে ফেলেন। এটা শুনে আমি আর প্রিয়াঙ্কা নিজেদের জন্য আফসোস করতে লাগলাম!
শাড়ির দোকানে দামাদামি চলছে। আন্টি শাড়ি দেখছেন। সামিয়া আমার গলা ধরে একপাশে দাঁড়িয়ে। খেয়াল করলাম, স্যার দোকানের বাইরে দাঁড়িয়ে সামিয়ার দিকে তাকিয়ে আছেন। একটু পর তিনিও দোকানের ভেতর এলেন। স্যারকে দেখেই আগের মতো ‘আসসালামু আলাইকুম, স্যার’ বলে উঠল। বলেই জিহ্বায় কামড়! বেচারি স্যার বলে ডাকা ছাড়তে পারছে না!

আমাদের সামিয়ার হলুদসন্ধ্যা! হলুদে আমাদের বড় একটা পরিকল্পনা ছিল, সেই লম্পটকে শায়েস্তা করার। রাহুলের কাছ থেকে জেনে নিলাম, লোকটা সামিয়ার খালাতো বোনের স্বামী। হলুদের সময় জ্যোতিকে লাগিয়ে দিলাম ওই লোকের পেছনে। যাক, ওই লোকের চোখে জ্যোতি পড়েছে। জ্যোতি একা একটা রুমে গেল। লোকটাও তার পিছু নিল। তখনই জ্যোতি দরজা বন্ধ করে চিত্কার। কিছুক্ষণ এই নাটক চলল। সামিয়া এ ব্যাপারে কিছুই জানত না। এবার সবার সামনে মুখোশ খুলে দিলাম। সুযোগ বুঝে সামিয়ার সঙ্গে হওয়া ঘটনাটাও আমরা সবাইকে বলে দিলাম। খালাতো বোন তার স্বামীকে বাড়ি থেকে বের করে দিল। এই ঘটনার পর পরিবেশ একদম থমথমে হয়ে যায়। সামিয়ার খালাতো বোন বলল, ‘এটা আনন্দের দিন। গায়েহলুদ আবার শুরু করতে হবে।’ আমরা খুব নাচানাচি করলাম। সামিয়ার অনুরোধে গান ছিল ‘আলো আলো’। সবাই মিলে একসঙ্গে গাইলাম। অজানা কোনো একজনকে উৎসর্গ করে সামিয়াও একটা গান গাইল। হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হলো। সবাই দৌড়ে ঘরে চলে এলাম। সামিয়ার দিকে কারও খেয়ালই নেই। বৃষ্টিতে ভিজছে আর কী যেন ভাবছে! সবাই চলে গেলেও আরেকটা মানুষ সেখানে দাঁড়িয়ে ছিল। দ্বীপ! সে ধীরে ধীরে সামিয়ার হাত ধরে বলল, ‘আপুনি, তোকে কোলে করে নিয়ে যাই?’
শীতের রাতে বৃষ্টি! সামিয়ার ভাগ্য ভালো হবে নিশ্চয়ই। ওকে শিখিয়ে দিলাম, ‘কবুল বলতে সময় নিবি। প্রতি কবুলে এক হাজার টাকা নেব। টাকা না দিলে কবুল বলবি না।’

বর চলে এল। কিছুক্ষণ পর বিয়ে পড়ানো শুরু হলো। কাজী কী যেন বলল, তা শুনে সবাই আলহামদুলিল্লাহ বলল। তারপর রেজিস্ট্রার খাতায় সামিয়ার স্বাক্ষর। ব্যস, হয়ে গেল বিয়ে!
‘কিরে, তোকে না বললাম, টাকা না দিলে কবুল বলবি না?’
—দোস্ত, আমি তো একবারও কবুল বলিনি।
—কবুল বলিসনি? তাহলে বিয়ে হলো কীভাবে?
—কাজী বলল, আলহামদুলিল্লাহ পড়তে। আমি তা–ই পড়েছি।
—আরে বিয়েতে কবুলের বদলে আলহামদুলিল্লাহও বলা যায়।
—আগে বলবি না? আমি কি জানি নাকি? ধুর!
বিয়ে শেষ, এবার বিদায়। সামিয়ার সঙ্গে যাব আমি আর প্রিয়াঙ্কা। খুব কান্না করছে আন্টি আর সামিয়া। আমরা গাড়িতে বসে পড়লাম। গাড়ির কাচ ধরে দাঁড়িয়ে আছে দ্বীপ।
সামিয়ার শ্বশুরবাড়িতে সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে ঘুমাতে গেলাম আমরা। শুয়ে শুয়ে গ্যালারির ছবি দেখছিলাম। হঠাৎ পাশের রুম থেকে গিটারের শব্দ এল। সামিয়ার গিটারের খুব শখ ছিল। যা বোঝার বুঝে নিলাম। স্যার নিশ্চয়ই ওর জন্য গিটার কিনে রেখে দিয়েছেন।
ঘুমিয়েই পড়েছিলাম। হঠাৎ প্রিয়াঙ্কা আমাকে ডেকে তুলল। রাহুল কারও চিঠির ছবি ‘মাই ডে’তে দিয়েছে, সেটা দেখার জন্য।
‘২৯ ডিসেম্বর, ২০১৯
হুমায়ূন আহমেদ একটা কথা বলেছেন। তুমি যদি তোমার ভালোবাসার মানুষকে পেয়ে যাও, তাহলে সারা জীবন মানুষটা তোমার সঙ্গে থাকে। তবে ভালোবাসাটা থাকে না। আর যদি তাকে না পাও, তাহলে মানুষটা থাকে না। কিন্তু ভালোবাসাটা রয়ে যায় সারা জীবন।’
চিঠিতে হাতের লেখাটা যে সামিয়ার ছিল, তা আর বুঝতে বাকি রইল না। পরিবার আর সমাজকে কী মুখ দেখাবে, সেটা ভেবে হিন্দু ছেলেটার প্রতি যে ভালোবাসা ছিল, সেটা কবর দিয়ে দিল!

শিক্ষার্থী, আইন ও বিচার বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়